শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

অন্ধকারে যুবসমাজের ভবিষ্যৎ

পরিবারে চলছে নীরব কান্না : পারিবারিক ও সামাজিকভাবে সচেতনতা সৃষ্টির তাগিদ

আনোয়ারুল হক আনোয়ার | প্রকাশের সময় : ২৯ ডিসেম্বর, ২০২০, ১২:০০ এএম

পরিবারের আদরের মেধাবী সন্তান শামীম হায়দার চৌধুরী। কলেজ জীবনে বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে মাদকাসক্ত হয়েছে। ধীরে ধীরে নেশা টাকা জোগারে শান্ত ছেলেটি হয়ে ওঠে হিংস্র। বাবা ও মাকে প্রতিনিয়ত টাকার জন্য চাপ দিতে থাকে। টাকা না পেলে মাঝে মাঝে ঘরের জিনিসপত্র বিক্রি শুরু করে সে। ছেলেকে বাঁচাতে অসহায় বাবা মায়ের ছুটে আসেন মাদক নিরাময় কেন্দ্রে। কিন্তু তাতেও সংশোধন হয়নি শামীম। মাদকের করাল গ্রাসে তার শরীরে এক সময় বিভিন্ন রোগের উপসর্গ দেখা দেয়। এতে ধীরে ধীরে আদরে সন্তানটি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। নিভে যায় বাবা মার স্বপ্নের প্রদীপ।
ব্যাংক কর্মকর্তা তাজুল ইসলামের একমাত্র সন্তান নাজিম। পাড়ার ছেলেদের সাথে আড্ডা দিতে গিয়ে মাদকের নেশায় ঝুঁকে পড়ে। অসহায় পিতা ব্যাংক ঋণ নিয়ে ছেলের চিকিৎসা দিলেও ফলোদয় হয়নি। মাদকাসক্ত ছেলের কর্মকান্ডে সামজিকভাবে কোনঠাসা এই সম্মানি ব্যক্তি শেষতক হার্ট অ্যাটাকে মারা যায়। স্বামীর মৃত্যু আর সন্তানের মাদকাসক্তির কষ্ট সইতে না পেরে একমাস পর তার স্ত্রীও মারা যায়। এছাড়া মাদকাসক্ত ছেলে কারণে পারিবারিক ও সামজিকভাবে একঘরে হন ৭০ বছর বয়সি অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম। চরম দুঃখ নিয়ে কোনক্রমে বর্তমানে দিনাতিপাত করছেন তিনি। এভাবে নোয়াখালীতে শত শত পরিবারের তাদের মাদকাসক্ত সন্তানকে নিয়ে দুর্বিষহ জীবন যাপন করছে। তাদের পরিবারে চলছে নীরব কান্না।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, নোয়াখালীর ৯টি উপজেলার প্রতিটি জনপদে একই পরিস্থিতি বিরাজ করছে। সন্ধ্যার পর দলবদ্ধভাবে নির্জনস্থানে মাদক সেবন নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার। পরিবারের অসর্তকতার কারণে নোয়াখালী অঞ্চলে মাদকসেবীর তালিকাও দীর্ঘ হচ্ছে। কোনক্রমেই রোধ করা যাচ্ছে না মাদকের ভয়ানক ছোবল। মাদক সেবনের কারণে পারিবারিক অশান্তিও বৃদ্ধি পেয়েছে সমানতালে। স্বামী স্ত্রীর বিরোধ, বিবাহ বিচ্ছেদ, মাদকাসক্ত ব্যক্তির স্ত্রীর পরকীয়াসহ পারিবারিক অশান্তি দিন দিন প্রকট হচ্ছে। বাড়ছে স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদের ঘটনা। আদালতে নারী নির্যাতনের শত শত মামলা বিচারাধীন রয়েছে।
জেলা ও উপজেলায় ১০জন নিকাহ রেজিস্ট্রার সূত্রে জানা গেছে, মাদকাসক্তের কারণে পরিবারে অশান্তির প্রেক্ষিতে গত পাঁচ বছর তিন শতাধিক বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটেছে। এছাড়া স্বামী মাদকাসক্ত হওয়ায় স্ত্রী পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ারও ঘটনা ঘটছে। তেমনিভাবে মাদকাসক্ত পুত্রের অত্যাচার কিংবা লোকলজ্জার ভয়ে পিতা কিংবা মাতা হৃদযন্ত্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুর একাধিক ঘটনার খবর পাওয়া গেছে। আর্থিকভাবে সচ্ছল পরিবারগুলো তাদের মাদকাসক্ত সন্তানকে মাদক নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসা করাচ্ছে। কিন্তু আর্থিকভাবে দুর্বল পরিবারের মাদকাসক্ত সন্তানরা ক্রমান্বয়ে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে।
মাদক গ্রহণের ফেলে শারীরিকভাবে রোগাক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর খবরও পাওয়া যাচ্ছে। নোয়াখালীর একজন চিকিৎসকের ২৮ বছর বয়সী ছেলে প্যাথিড্রিনে আসক্ত হয়ে বাথরুমে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। সোনাপুর এলাকার একটি ক্লাবে নিয়মিত মাদক সেবন করত ৫০ বছর বয়সী তিন ব্যক্তি। পরবর্তীতে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে এক এক করে তারা মারা যায়। রেজেস্ট্রি অফিসের কর্মচারী জনৈক মাঝবয়সী ব্যক্তি একই পরিস্থিতির শিকার হন। এছাড়া ১৮ থেকে ৪০ বছর বয়সী অর্ধ শতাধিক কিশোর যুবক মাদকের পাশর্^প্রতিক্রিয়ায় মৃত্যুর প্রহর গুনছে।
এক সময় নোয়াখালী অঞ্চলে মাদক সরবরাহের প্রধান রুট ছিল সড়ক ও রেলপথে কুমিল্লা-লাকসাম হয়ে নোয়াখালী এবং সড়ক পথে ফেনী হয়ে নোয়াখালী। কিন্তু এতদ্বঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নতির পাশাপাশি মাদক সরবরাহের রুটও বৃদ্ধি পেয়েছে। পাশ্ববর্তী দেশ মিয়ানমার থেকে সড়ক ও নৌপথে ইয়াবা এ অঞ্চলে প্রবেশ করছে। এক কথায় মাদক সরবরাহকারীরা এখন প্রায় নিশ্চিন্তে একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্তে পৌছে দিচ্ছে। জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর প্রতিমাসে ৬০/৭০টি অভিযান পরিচালনা করেও ক‚ল কিনারা পাচ্ছেনা।
জেলা প্রশাসন ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনী তৎপরতায় কোন কাজ হচ্ছেনা। মাদকের ভয়াবহতা তুলে ধরে নোয়াখালীর ৫০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাদকবিরোধী কমিটি সক্রিয় রয়েছ বলে জানালেন, নোয়াখালী মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক বিপ্লব কুমার মোদক। এ প্রসঙ্গে নোয়াখালীর কয়েকজন সচেতন নাগরিক ইনকিলাবকে জানান, মাদকের বিস্তাররোধ ও এর পরিণতি সম্পর্কে সামজিকভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে তার পাশাপাশি মাদকের গডফাদাদেরও চিহিৃত করে সরবরাহ রুট বন্ধ করতে হবে। এছাড়া পারিবারিক ও সামাজিকভাবে মাদক বিরোধী সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। অন্যথায় মাদকের ভয়াল থাকা থেকে কিশোর ও যুবসম্প্রদায়কে রক্ষা করা কঠিন হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন