চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নিয়ে বিরোধ আর সংঘাত-সহিংসতায় নগরবাসীর মধ্যে উদ্বেগ শঙ্কা বিরাজ করছে। ভোটের বাকি আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা। কিন্তু পরিবেশ শেষ পর্যন্ত কতটুকু শান্তিপূর্ণ হবে- তা নিয়ে সন্দেহ-সংশয় ভোটারদের মধ্যে। করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি নিয়েও উদ্বিগ্ন অনেকে। দলীয় বিরোধে বেশিরভাগ ওয়ার্ডে মুখোমুখি আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর প্রার্থী ও বিদ্রোহীরা। ভোটের প্রচারে প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থীর প্রচার মিছিল, পথসভা ও ক্যাম্পে হামলার ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। বিএনপির পক্ষ থেকে ধানের শীষের প্রচারে সরকারি দলের কর্মীদের হামলা, ভাঙচুর এবং নেতাকর্মীদের পুলিশি হয়রানি, ধরপাকড়ের অভিযোগ করা হচ্ছে।
তবে গতকাল চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক বৈঠকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা দাবি করেছেন, ভোটের পরিবেশ সুষ্ঠু রয়েছে। দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনে ছয়টি রাজনৈতিক দলের মেয়র প্রার্থী মাঠে। তবে মূল লড়াই সরকারি দল আওয়ামী লীগের প্রার্থী এম রেজাউল করিম চৌধুরী ও মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির ডা. শাহাদাত হোসেনের মধ্যে। বড় দুই দলের মর্যাদার এ লড়াইয়ে জয়-পরাজয় নিয়েও নানামুখী আলোচনা-বিশ্লেষণ শুরু হয়েছে।
নৌকার প্রার্থী এম রেজাউল করিম চৌধুরী মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক। ধানের শীষের প্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেন নগর বিএনপির আহ্বায়ক। স্থানীয় রাজনীতিতে সজ্জন এবং সদালাপী হিসেবে দুজনেই সমাদৃত। এ কারণেই ভোটের প্রচারে দুই প্রার্থীর মুখে নেই কোন কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি।
তবে ভোটের মাঠে দুই পক্ষকেই নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হচ্ছে। ঘরের আগুনে পুড়ছে আওয়ামী লীগ। ৪১টি সাধারণ ও ১৪টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডসহ ৫৫টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৩৪টিতে সক্রিয় বিদ্রোহী প্রার্থী। ১৭টি ওয়ার্ডেই বিদ্রোহীদের মুখোমুখি সরকারি দলের প্রার্থীরা। ভোটের মাঠে নিজেদের বিরোধে লাশ হয়েছে তিনজন। সংঘাত-সহিংসতা লেগেই আছে প্রার্থী ও বিদ্রোহীদের মধ্যে। দলের পক্ষ থেকে হুমকি-ধমকি দিয়েও বিদ্রোহীদের বাগে আনা যায়নি। দলীয় বিরোধে নৌকার ভোটে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন দলের নেতারা। প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থীদের মারমুখি অবস্থানের কারণে নির্বাচন কমিশন নগরীর ১৪টি ওয়ার্ডকে অতি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এসব ওয়ার্ডে হত্যা, অস্ত্র ও মাদক মামলার বেশ কয়েকজন আসামি প্রার্থী হয়েছেন।
নৌকার পক্ষে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয়, মহানগর ও জেলার প্রায় সব নেতা মাঠে নামলেও মনোনয়ন বঞ্চিতদের মাঝে কিছুটা মান-অভিমান রয়েই গেছে। তারা নৌকার বিজয়ের ব্যাপারে কতটুকু আন্তরিক তা নিয়েও দলের ভেতরে নানামুখী আলোচনা চলছে। দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন নির্বাচনে প্রধান সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করছেন। আচরণবিধির কারণে মন্ত্রী-এমপিরা সরাসরি ভোটের প্রচারে না থাকলেও তারা নৌকার পক্ষে আছেন।
বিএনপির তৃণমুলে কলহ-বিরোধ তেমন না থাকলেও নির্বাচন কমিশন এবং প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে উদ্বিগ্ন দলের নেতারা। বিএনপির প্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেনের অভিযোগ, নির্বাচন কমিশন সবার জন্য সমান পরিবেশ নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। সরকারি দলের ক্যাডার-মাস্তানেরা বিএনপির প্রচারে হামলা-ভাঙচুর এবং প্রকাশ্যে অস্ত্রবাজি করলেও ইসি এবং পুলিশ প্রশাসন দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। পুলিশ উল্টো বিএনপি নেতাকর্মীদের গ্রেফতার এবং বাসাবাড়িতে গিয়ে এলাকা ছাড়ার হুমকি-ধমকি দিচ্ছে। ভোটের আগে বৈধ-অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার এবং সন্ত্রাসীদের গ্রেফতারের দাবি জানালেও তা আমলে নেয়া হয়নি।
ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন- ইভিএম নিয়েও আপত্তি বিএনপির। বিএনপির প্রার্থী ইভিএমে কারসাজি রোধে বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলীদের নিয়ে ভোটের আগে এসব মেশিন পরীক্ষা করারও দাবি জানিয়েছেন। সিটি নির্বাচনে বিএনপির পক্ষ থেকে প্রধান সমন্বয়কারীর দায়িত্ব পালন করছেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। ধানের শীষের প্রচারে তিনিসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকে শরিক হয়েছেন। তবে চট্টগ্রামের প্রভাবশালী দুই নেতা আবদুল্লাহ আল নোমান ও মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দীনের অনুপস্থিতি নিয়ে দলের ভেতরে-বাইরে নানা গুঞ্জন চলছে। চট্টগ্রামের কয়েকজন নেতাকে ধানের শীষে প্রচারে দেখা যাচ্ছে না।
চসিক নির্বাচনী প্রচারের শুরু থেকেই আচরণবিধি ভঙ্গের হিড়িক পড়লেও কঠোর হাতে তা দমন করত পারেনি নির্বাচন কমিশন। বিশেষ করে সরকারি দলের নেতারা হর-হামেশা আচরণবিধি ভাঙ্গছেন। লিখিতভাবে সতর্ক করা ছাড়া এখনো পর্যন্ত কারো বিরুদ্ধে কঠোর কোন ব্যবস্থা নেয়নি কমিশন। গতকাল পর্যন্ত রিটার্নিং কর্মকর্তার দফতরে প্রায় ৬০টির মত অভিযোগ জমা পড়ে। যার বেশিরভাগই নিষ্পত্তি হয়নি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কমিশনের ব্যর্থতায় নির্বাচনের পরিবেশও বিঘিœত হচ্ছে।
যদিও রিটার্নিং কর্মকর্তা মোহাম্মদ হাসানুজ্জামান দাবি করেন, বিধি ভঙ্গের কারণে কাউকেই ছাড় দেয়া হচ্ছে না। পুলিশের ভ‚মিকা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। ভোটের প্রচারে নগরীতে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যাসহ অস্ত্রবাজির ঘটনা ঘটেছে। তবে কোন অস্ত্রই উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ। নির্বাচন সামনে রেখে অস্ত্র উদ্ধার এবং সন্ত্রাসী গ্রেফতারে বিশেষ কোন অভিযানও পরিচালনা করা হয়নি। নগর পুলিশের কর্মকর্তারা জানান, তারা নিরপেক্ষ ভ‚মিকা পালন করছেন। আজ মধ্যরাত থেকে বন্ধ হচ্ছে ভোটের প্রচার। শেষ সময়ে প্রার্থীরা ব্যস্ত ভোটারদের মন জয়ে। গতকালও নৌকার প্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরী, ধানের শীষের ডা. শাহাদাত হোসেন এবং হাত পাখার প্রার্থী জান্নাতুল ইসলাম নগরীতে গণসংযোগ করেন।
নির্বাচন স্বচ্ছ গ্রহণযোগ্য হবে -সিইসি
প্রধান নির্বাচন কমিশনার সিইসি কে এম নুরুল হুদা বলেছেন, চসিক নির্বাচনের পরিবেশ এখনো শান্তিপূর্ণ রয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য হওয়ার বিষয়ে আমাকে আশ্বস্ত করেছেন। তিনি গতকাল চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় শেষে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন।
সিইসি বলেন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের বক্তব্য শুনেছি। নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে সবাই সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। প্রত্যেকে আশাবাদী ২৭ জানুয়ারি ভোট শান্তিপূর্ণ হবে। এবারের নির্বাচনে সাধারণ ছুটি থাকছে না জানিয়ে তিনি বলেন, নির্বাচন বৃহস্পতিবার বা রোববার হলে সেখানে আমাদের আশা থাকে ভোটাররা ভোট দেবে। কিন্তু দেখা যায় ছুটি পেয়ে তারা সবাই বাড়ি চলে যায়, ভোট দেয় না। সেকারণে আমরা মাঝখানে রাখি। কেবিনেট থেকে একটা নির্দেশনা জারি আছে, যারা ব্যক্তিগত বা সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োজিত থাকবেন তাদের যেন ভোট দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। এ কারণে সাধারণ ছুটি রাখি না।
নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েনের বিষয়ে বিএনপির দাবি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সেনাবাহিনী মোতায়েনের কোনো পরিকল্পনা আমাদের নেই, কোনো প্রয়োজনীয়তাও কমিশন অনুভব করছে না। নেতাকর্মীদের হয়রানির বিষয়ে বিএনপির মেয়র প্রার্থীর অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাড়ি বাড়ি গিয়ে নিষ্প্রয়োজনে হয়রানি করছে এমন কোন অভিযোগ আমাদের জানা নেই। বিভাগীয় কমিশনার এবিএম আজাদের সভাপতিত্বে মতবিনিময় সভায় সিএমপির কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর, ডিআইজি আনোয়ার হোসেন, পুলিশ সুপার এস এম রশিদুল হকসহ বিভিন্ন সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন