রংপুরের বিভিন্ন বাজারে এক জোড়া কপি বিক্রী হচ্ছে পাঁচ টাকায়। এরপরও ক্রেতা পাওয়া যাচ্ছে না। ১৫ দিন আগেও এক কেজি বাঁধাকপি বা ফুলকপি ১৫ থেকে ২০ টাকায় বিক্রী হয়েছে। এত অল্প সময়ের মধ্যে দামে এই আকাশ-পাতাল ব্যবধানে কপি চাষীরা রীতিমত বিপাকে পড়ে গেছে। জমি তৈরি থেকে শুরু করে চারা লাগানো, সার-পানি দেয়া, সেবা-যত্ন করা এবং জমি থেকে তুলে বাজারে নেয়া পর্যন্ত একটি কপির জন্য একজন চাষীর কী পরিমাণ খরচ হয়েছে, তা অনুমান করা কঠিন নয়। পত্রিকান্তরে একজন চাষী জানিয়েছেন, তিনি ২০ শতাংশ জমিতে বাঁধাকপির চাষ করেছেন। খরচ হয়েছে প্রায় আট হাজার টাকা। কপির এখন যা দাম, তাতে বিক্রী করলে সর্বোচ্চ চার হাজার টাকা আসতে পারে। লাভ তো পরের কথা, যেখানে উৎপাদন খরচের অর্ধেকও উঠছে না, সেখানে চাষীদের চরমভাবে হতাশ হওয়াই স্বাভাবিক। অন্যান্য তরিতরকারি ও শাক-সবজির দামও এখন অবিশ্বাস্য রকম কম। এবার আবহাওয়া অনুকূল থাকায় উত্তরাঞ্চলে ব্যাপক তরিতরকারি ও শাক-সবজির আবাদ হয়েছে। অন্যান্য অঞ্চলেও একইভাবে তরিতরকারি ও শাক-সবজির বাম্পার উৎপাদন হয়েছে। ভালো দাম পাবে বলে চাষীরা যে আশা করেছিল, এখন তা হতাশ্বাসে পরিণত হয়েছে। বেগুন, টমেটো, গাজর, শিম প্রভৃতির দামও অনেক কম। শুরুর দিকে রাজধানীতে একটি ফুলকপি ৬০-৭০ টাকায়, প্রতিকেজি বেগুন ৭০-৮০ টাকায়, টমেটো ১০০-১২০ টাকায়, গাজর ৮০-১০০ টাকায় এবং শিম ১০০-১২০ টাকায় বিক্রী হয়েছে। এখন ফুলকপি বা বাঁধাকপি প্রতিটা ১২-১৫ টাকা এবং বেগুন, গাজর, টমাটো, শিম প্রতিকেজির দাম ১৫-২৫ টাকা। চাষী পর্যায়ে এসবের দাম একেবারেই পড়ে গেছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের স্থানীয় বাজারে প্রতি কেজির দাম মাত্র পাঁচ-সাত টাকা। তাও ক্রেতা মিলছেনা। তরিতরকারি, শাক-সবজি বেশিদিন ক্ষেতে রাখা যায় না। সময় মত না তুললে নষ্ট হয়ে যায়। বলা যায়, উৎপাদিত তরিতরকারি, শাক-সবজি এখন চাষীদের গলার কাঁটায় পরিণত হয়েছে। অনেকে ব্যাংক ঋণ বা মহাজনী ঋণ নিয়ে আবাদ-উৎপাদনে লাগিয়েছে। তাদের অবস্থা বেশি শোচনীয়। কীভাবে ঋণ পরিশোধ করবে, তা নিয়ে তাদের দুশ্চিন্তার অবধি নেই।
কৃষিপণ্যের ন্যায্য দাম না পাওয়া আমাদের দেশে খুবই সাধারণ ব্যাপার। মওসুমের শুরুতে দাম বেশি বলে প্রতীয়মান হলেও পরে তা নি¤œতম অবস্থায় চলে যায়। শুরুতে দাম বাড়া ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না। কারণ, তখন সরবরাহ অত্যন্ত কম থাকে। যখন সরবরাহ বাড়ে তখন দামও পড়ে যায়। কৃষিপণ্যের ন্যায্য দাম থেকে চাষী বঞ্চিত হয়। শুধু তাই নয়, প্রতি বছর উৎপাদিত কৃষিপণ্যের একটা বড় অংশ নষ্ট হয়ে যায় কিংবা চাষীরা ফেলে দিতে বাধ্য হয়। এ থেকে এ বিষয়টি অত্যন্ত স্পষ্ট আমাদের দেশে কৃষিপণ্যের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ভারসাম্য নেই। কোন কৃষিপণ্যের কতটা চাহিদা, তার ভিত্তিতে উৎপাদনের জমির পরিমাণ নির্ধারিত হলে ওই পণ্যের ক্ষেত্রে চাহিদা ও সরবরাহের সামঞ্জস্য বা ভারসাম্য থাকে। তখন পণ্যের উৎপাদকের ন্যায়সঙ্গত দাম থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশংকা থাকেনা। অর্থনীতির পরিভাষায়, দাম বাড়া-কমা নির্ভর করে চাহিদা ও সরবরাহের নিয়মের ওপর। সরবরাহ কম হলে দাম বাড়ে, বেশি হলে দাম কমে। বর্তমানে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার বাজারে তরিতরকারি ও শাক-সবজির সয়লাব বয়ে যাচ্ছে। বুঝাই যাচ্ছে, উৎপাদন বেশি হয়েছে। বলাবাহুল সরবরাহও। সেই তুলনায় চাহিদা কম। ফলে, দামও কম। এতে বড় রকমের বঞ্চনার শিকার হচ্ছে চাষীরা। অথচ চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে যদি ভারসাম্য থাকতো তাহলে এমন অবস্থা সৃষ্টি হতে পারতো না। নিত্যপ্রয়োজনীয় ও নিত্যব্যবহার্য যে কোনো পণ্যের দাম বাড়লে আমরা সিন্ডিকেটের কারসাজির কথা বলি। সত্য বটে, আমাদের দেশে সিন্ডিকেটবাজি আছে, পণ্য মজুদ করে বা আটকে রেখে দাম বাড়ানোর ব্যবসায়ী আছে; কিন্তুু দাম বাড়ার ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট বা ব্যবসায়ীরাই একমাত্র দায়ী নয়, চাহিদা ও সরবরাহের অর্থনৈতিক নিয়মটিও এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করে। চাহিদানুপাতে উৎপাদন আমদানি বা সরবরাহ সচল থাকলে কোনো সিন্ডিকেট বা ব্যবসায়ীঘোঁটই কাজে আসেনা।
বিশেষজ্ঞরা সব সময়ই বলে আসছেন, প্রতিটি কৃষিপণ্যের দৈশিক বার্ষিক চাহিদা মোতাবেক উৎপাদনের পরিকল্পনা ও ব্যবস্থা নেয়া উচিৎ। কোনো পণ্যের উৎপাদন সম্ভাব্যতা কম প্রতীয়মান হলে সেই পণ্যের চাহিদার অবশিষ্টাংশ আমদানির মাধ্যমে পূরণ করতে হবে। তাহলে ওইপণ্যের স্বাভাবিক সরবরাহ অব্যাহত থাকবে এবং দামের ক্ষেত্রেও থাকবে স্থিতিশীলতা। সব পণ্যের ক্ষেত্রেই একথা সমানভাবে প্রযোজ্য। তাদের মতে, কোন্ পণ্য দেশের কোথায় কোথায় ভালো হয়, সেটা দেখে কী পরিমাণ জমিতে তা আবাদ করা যায়, তা নির্ধারণ করে দিতে হবে। নির্ধারিত জমির বাইরে যাতে কোনো চাষী তা উৎপাদন করতে না পারে, সেটাও দেখতে হবে। দেশে কোন পণ্যের কি পরিমাণ বার্ষিক চাহিদা, তা দেখার বা নির্ণয় করার কর্র্তৃপক্ষ আছে। অভিযোগ রয়েছে, এই কর্তৃপক্ষ নিখুঁতভাবে চাহিদা নির্ধারণ করতে পারে না। তা নিয়ে তার কোনো গবেষণা বা সরেজমিন পর্যবেক্ষণ নেই। ফলে কাগজে-কলমে যে চাহিদা দেখানো হয়, বাস্তবে তার কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। দেশে কৃষির জন্য মন্ত্রণালয় আছে, তার বিভিন্ন বিভাগ আছে। এই মন্ত্রণালয় ও বিভাগসমূহের দায়িত্বের অন্যতম হচ্ছে বার্ষিক চাহিদার ভিত্তিতে বিভিন্ন পণ্য, উৎপাদনের পরিকল্পনা নেয়া এবং উৎপাদন কার্যক্রমে কৃষকদের সহায়তা দেয়া। কিন্তু এই দায়িত্ব পালনে সংশ্লিষ্ট বিভাগ বা বিভাগগুলো বরাবরই শোচনীয় ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে আসছে। সঠিক চাহিদার ভিত্তিতে উৎপাদন ও সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারলে বাজারে কোনো দুর্ঘট ঘটতে পারে না। আরো একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, আমাদের পণ্য বাজারজাতকরণ ব্যবস্থা খুবই দুর্বল। এ নিয়ে অনেক কথা বলা হয়েছে। কোনো কাজ হয়নি। একটি সুচারু বাজারব্যবস্থা গড়ে উঠলে কৃষক ও ভোক্তা পর্যায়ে পণ্যের দামে বিশাল হেরফের হওয়ার বাস্তবতা দূর হতো। একই সঙ্গে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যের অবসান ঘটতো। এদিকে আমরা সংশ্লিষ্ট সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি এবং এমন একটা সমন্বিত কার্যব্যবস্থা আশা করছি, যাতে পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে না বাড়ে, ভোক্তারা পণ্যসংকটে না পড়ে এবং চাষীরা ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত না হয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন