শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

কৃষিপণ্যের রপ্তানি সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হবে

মো. মাঈন উদ্দীন | প্রকাশের সময় : ১ নভেম্বর, ২০২১, ১২:০৫ এএম

দেশে সম্পদ বলতে মানবসম্পদ, প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদ, কৃষি ও জলজ সম্পদই প্রধান। মানুষের দৈনন্দিন জীবন, জীবনের চাহিদা, খাদ্য নিরাপত্তা, শিল্পের কাঁচামাল, সরবরাহসহ অর্থনীতির বড় অংশ হলো কৃষি ও কৃষিজাত পণ্য। আমাদের দেশ আয়তনে ছোট এবং ঘনবসতিপূর্ণ হলেও স্বাধীনতা-পরবর্তী ৫০ বছরে সীমিত সাধ্য নিয়ে অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে গৌরবোজ্জ্বল অগ্রগতি রয়েছে। মহামারি করোনায় যেখানে পুরো বিশে^র অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়েছিল, সেখানে বাংলাদেশ লক্ষনীয়ভাবে ভালো করার চেষ্টা করেছে। এক্ষেত্রে আমাদের কৃষি ও কৃষিজাতপণ্য উৎপাদন, বিতরণ ও প্রয়োজনীয় সরবরাহের কারণে মানুষের খাদ্য ও খাদ্য নিরাপত্তায় বিরাট সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। বৈশি^ক মহামারিতে যদিও আমাদের টিকা সরবরাহে ঘাটতি রয়েছে তারপরও অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে আমাদের কলকারখানা ব্যবসা বাণিজ্য তাড়াতাড়ি খোলা সম্ভব হয়েছে। এর সুফল আমরা ইতিমধ্যেই পেতে শুরু করেছি। আমাদের রপ্তানি বাড়তে শুরু করেছে। এ অর্থবছরে (২০২১-২০২২) সেপ্টেম্বর মাসে আমাদের মোট রপ্তানি বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৪.১৬ বিলিয়ন ডলার। গত বছর সেপ্টেম্বর থেকে ৩৮ শতাংশ বেশি। জুলাই-সেপ্টেম্বর এ আমাদের পোশাক রপ্তানি হয়েছে ৯.০৫ বিলিয়ন ডলার। চলতি অর্থবছরে (২০২১-২০২২) কৃষি ও কৃষিজাত পণ্য রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে প্রায়- ২১ কোটি ডলার বা ১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। গতবছর একই সময়ে যা ছিল ১৭ কোটি ৮২ লাখ ডলার।

কৃষি ছিল একসময় বাংলাদেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি। মোট দেশজ উৎপাদনের অর্ধেকের বেশি আসত কৃষি থেকে। কৃষির উপর নির্ভরশীল ছিল ৭০ শতাংশের বেশি মানুষ। শিল্পের অবদান ছিল ১২-১৩ শতাংশ। ধীরে ধীরে কৃষির অবদান কমে শিল্প ও সেবাখাতের অবদান বাড়তে শুরু করে বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্পের প্রসারের কারণে। কিন্তু শিল্পের কাঁচামাল কৃষি থেকেই আসে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দৈনন্দিন জীবন পরিচালনার স্বার্থে, খাদ্য চাহিদা পূরণে, প্রয়োজনীয় পুষ্টি যোগান দিতে কৃষি ও কৃষিজাত পণ্যের বিকল্প নেই। এখনও কৃষিখাতের উপর নির্ভরশীল শ্রমশক্তির ৩৮ শতাংশ। দেশের অভ্যন্তরে যেমন কৃষি ও কৃষিজাত পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে, তেমনি বিদেশেও এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। ইপিবির তথ্য থেকে জানা যায়, দেশের ৪৭৯টি প্রতিষ্ঠান ১৪৪টি দেশে প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য রপ্তানি করছে। প্রাণ আরএফএল, স্কয়ার, বিডিফুডের মতো অনেক প্রতিষ্ঠানের রপ্তানি বাজার বড়। কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্যের অভ্যন্তরীণ বার্ষিক বাজার ৫০ হাজার কোটির বেশি। কাজ করছে এখাতে ২০ লাখ শ্রমিক। ২০০০ সালের পর থেকে এখাতের রপ্তানি শুরু হয়ে বর্তমানে প্রতিবেশী দেশ ভারত, এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোতেও রপ্তানি দ্রুত বেড়ে চলেছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য মতে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে কৃষি পণ্য রপ্তানি হয় মাত্র ৫৫ কোটি ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছরে কৃষিপণ্য রপ্তানি থেকে ১০৩ কোটি ডলার আয় এসেছে। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৯ শতাংশের বেশি ২০২১-২০২২ অর্থবছরে প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) কৃষি ও কৃষিজাত পণ্যের রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে প্রায় ২১ কোটি ডলার। তাছাড়া ২০১৮ সালে বাংলাদেশ ৬৭৮ মিলিয়ন ডলার কৃষিপণ্য রপ্তানি করেছে। আমাদের দেশে উৎপাদিত কৃষি ও কৃষিজাতপন্য বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক টেকসই ও সমৃদ্ধ। উৎপাদনের দিক থেকেও বিশ্বের সেরা দশের মধ্যে আমাদের অনেক কৃষিপণ্য রয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও), কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশ ধান উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ, আলু উৎপাদনে ষষ্ঠ, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, আম ও পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম, মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে তৃতীয়।

ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা বিভিন্ন দেশে আমাদের দেশিজাত পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এসব দেশে মুড়ি, চানাচুর, বিস্কুট ও রপ্তানি হচ্ছে। রপ্তানি হচ্ছে জ্যাম-জেলি, সস, নানারকম মসলা, জুস, সরিষার তেল, আচার , সুগন্ধি চালসহ আরো অনেক পণ্য।

ফল উৎপাদনে ও বাংলাদেশ অতীতের তুলনায় অনেক ভাল করছে। একসময় বিদেশি ফল হিসাবে আপেল, নাসপাতি, আঙ্গুর, কমলা, খেজুর, স্ট্রবেরি, ড্রাগন সাধারণ মানুষের হাতের নাগালের বাইরে ছিল। এখন এ সকল ফল দেশের সর্বত্র পাওয়া যায়। দেশে অনেক দুর্লভ, সুস্বাদু নানা জাতের ফল উৎপাদিত হচ্ছে এবং বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। এখন মানুষ বাড়ির ছাদে, বাড়ির আঙ্গিনায়, অনাবাদী জমিতেও ফলের চাষ করছে। দেশের পাহাড়ি অঞ্চলে অনেক সুস্বাদু ফল উৎপাদিত হচ্ছে। এসব ফল সঠিক ভাবে প্রক্রিয়াজাত করলে, সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের সুযোগ রয়েছে। দেশে এখন প্রচুর পরিমাণে লিচু, তরমুজের উৎপাদন হচ্ছে। একসময় দেশে ফলের চাহিদা ৭১ শতাংশ আমদানি করা হতো। এখন ফল আমদানি অনেক কমেছে। এখন আমাদের দেশে কমলা, আঙ্গুর ও মালটার চাষ হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে সাতক্ষীরায় বিদেশি মালটা উৎপাদিত হচ্ছে। কিন্তু আমাদের কৃষকেরা অনেক পরিশ্রম করে কৃষি ফসল উৎপাদন করলেও সঠিক দাম পায় না। উৎপাদন ও ভোক্তার নিকট সরাসরি যেতে না পারার কারণে মধ্যস্বত্বভোগীরা চতুরতা দেখিয়ে অর্থ হাতিয়ে নেয়। বিদেশি বাজার সৃষ্টিতেও আমাদের অনেক সমস্যা রয়েছে। যে কোন পণ্যের বাজার ধরতে হলে উৎপাদনের গুণগত মান, সংরক্ষণ ব্যবস্থা, উৎপাদন খরচ ব্যবস্থাপনা গুরুত্বপূর্ণ। দেশীয় চাহিদা মিটানোর পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানির যে অফুরন্ত সুযোগ রয়েছে তা কাজে লাগানোর জন্য পরিকল্পিত চাষাবাদ, কৃষকদের বিশেষভাবে ভালো ফলনের ক্ষেত্রে সহায়তা ও প্রয়োজনীয় প্রণোদনা প্রদানের ব্যবস্থা করা উচিত। বাংলাদেশের কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকারী সংগঠনের (বাপা) মতে, প্রতিবেশী দেশগুলোতে অশুল্ক বাধা দূর করা গেলে এবং প্রয়োজনীয় নীতি সহায়তা পাওয়া গেলে আগামী তিন বছরের মধ্যে ৩০০ কোটি ডলার বা ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি রপ্তানি আয় করা সম্ভব। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে আয় বাড়াতে ব্র্যান্ড এবং গুণগত মান উন্নয়নে জোর দিতে হবে। বাংলাদেশের দূতাবাসগুলো কৃষি ও কৃষিপ্রক্রিয়াজাত পণ্যসহ আমাদের রপ্তানিমুখী পণ্যের রপ্তানি বাড়ানোর জন্য ভূমিকা পালন করতে পারে। সঠিকভাবে সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাত না করার কারণে কৃষকের উৎপাদিত বিভিন্ন ফসল ৩০% নষ্ট হয়ে যায়। এ জন্য আমাদেরকে প্রযুক্তির উৎকর্ষতার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে।

করোনা মহামারিতে যখন বিশ্ব স্তব্ধ তখনও মানুষের খাবার জুটানোর কাজটি করেছে আমাদের ক্ষুদ্র কৃষকরাই। সরকার কৃষি উৎপাদনকে অব্যাহত রাখার জন্য যে প্রণোদনা ঘোষণা করেছে তা পেতে কৃষকদের হয়রানি হতে হয়। সহজে কৃষিঋণ ও প্রণোদনা পাওয়ার ব্যবস্থা করা উচিত। বর্তমানে অনেক তরুণ উদ্যোক্তা শ্রেণি যারা কৃষি উৎপাদন, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, কৃষি ও কৃষিজাত পণ্য উৎপাদনে নতুন নতুন প্রকল্প নিয়ে শুরু করেছে। উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার, বাজারজাত সহজীকরণ, কৃষিপণ্য সরবরাহের পরিবহন খরচ, শুল্ক সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে নতুন নতুন আরো উদ্যোক্তা শ্রেণি তৈরি করা উচিত। মানসম্মত উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় কীটনাশক, সার, উন্নত বীজ, সরবরাহ সহজ করা উচিত। রপ্তানিমুখী কৃষিপণ্য মানসম্মতভাবে সংরক্ষণ, সরবরাহ ও বাজারজাতকরণে জেলা ভিত্তিক সুনির্দিষ্ট তদারকি করা ও প্রয়োজনীয় কারিগরি সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে এ খাতের টেকসই উন্নয়ন ঘটানো যেতে পারে। ৫০ বছরে দেশে খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তা অর্জনে অকল্পনীয় ও অভাবনীয় অবদানে এদেশের কৃষক, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অব্যাহতভাবে কাজ করে যাচ্ছে।

চলতি বাজেটে কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রে ১০ বছরের জন্য কর অবকাশ সুবিধা দেয়া হয়েছে। ফলে রপ্তানি আরও বাড়বে বলে আমাদের আশা। ১০ বছর আগে অর্থাৎ ২০১০-১১ সালে কৃষিপণ্য রপ্তানি থেকে আয় হয়েছিল ৪০ কোটি ডলার। ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে তা বেড়ে ১০২ কোটি ৮১ লাখ ডলারে পৌঁছে। আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতি দিনদিন উন্নত হচ্ছে। দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে আরও বেগবান করতে হলে গ্রামের কৃষি ও কৃষিভভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাঠামোগত দুর্বলতা দূর করে উন্নত প্রযুক্তি ও দক্ষ বাজার ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে। আমাদের জনশক্তির প্রায় অর্ধেক নারী। আর গ্রামের নারীরা কৃষি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ও কুটির শিল্পের সাথে সম্পৃক্ত। মৎস চাষ, ফলচাষ, ফুলচাষ, পাটচাষ, পান চাষ, পশুপালন, দুগ্ধ উৎপাদন, চা ও কাগজ শিল্পের উন্নয়ন অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করতে পারে। গ্রামের শিক্ষিত যুবক যুবতীদের সরকারি ও বেসরকারিভাবে প্রয়োজনীয় সহায়তার মাধ্যমে কৃষি ও কৃষিজপণ্য উৎপাদনসহ গ্রামীণ অর্থনীতির টেকসই উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব।
লেখক: অর্থনীতিবিদ

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন