শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

কৃষিপণ্য রফতানির ধারা অব্যাহত রাখতে হবে

দিলীপ কুমার আগরওয়ালা | প্রকাশের সময় : ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ১২:০৭ এএম

বাংলাদেশের কৃষিপণ্য রপ্তানি হচ্ছে। বর্তমান সরকার পণ্য সংরক্ষণ ও পণ্য রপ্তানিতে কিছু সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করেছে। আর এই খাতের ব্যবসায়ীদের যুগোপযোগী উদ্যোগে কৃষিপণ্য রপ্তানির পরিমাণ দ্রুত বাড়ছে। গত চার বছরে এই খাতে রপ্তানির পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী তিন বছরের মধ্যে কৃষিপণ্য রপ্তানির পরিমাণ পাঁচ থেকে ছয় গুণ বৃদ্ধি পেতে পারে এবং রপ্তানি আয়ের দিক থেকে তৈরি পোশাক খাতের পরেই এর স্থান হতে পারে।

কৃষিপণ্য রপ্তানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, ইউরোপ, আমেরিকার বিভিন্ন দেশসহ বর্তমানে ১৪৪টি দেশে কৃষিজাত পণ্য রপ্তানি হয়। একই সঙ্গে বাড়ছে রপ্তানীকৃত পণ্যের তালিকাও। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য মতে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে কৃষিপণ্য রপ্তানি হয়েছিল মাত্র ৫৫ কোটি ডলারের। ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ কৃষিপণ্য রপ্তানি থেকে আয় করেছে ১০৩ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসেই (জুলাই-আগস্ট) কৃষিপণ্য রপ্তানি হয়েছে ২১ কোটি ডলারের। গত অর্থবছরের একই সময়ে আয় হয়েছিল ১৭ কোটি ৮২ লাখ ডলার। অর্থাৎ রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৬ শতাংশের বেশি। সেই হিসাবে বছর শেষে এই খাতের রপ্তানি আয় ১২৫ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে। ব্যবসায়ীরা তিন বছরে বাজার ছয় গুণ করার যে সম্ভাবনা দেখছেন, তা মোটেও অবাস্তব নয়। এ জন্য সরকারকে নীতি সহায়তা জোরদার করতে হবে। পুঁজির জোগান নিশ্চিত করতে ব্যাংকিং খাতকে এগিয়ে আসতে হবে। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পথে উন্নততর পরিবহন সুবিধা বাড়াতে হবে। রপ্তানিযোগ্য কৃষিপণ্যের যে তালিকা রয়েছে, তা এখনো খুবই সংকীর্ণ। এর সম্প্রসারণের অনেক সুযোগ রয়েছে এবং তা করতে হবে। বিদেশে বাংলাদেশ মিশনগুলোকে অনেক বেশি তৎপর হতে হবে। বিভিন্ন দেশে এখনো শুল্ক-অশুল্ক যেসব বাধা রয়েছে, সেগুলো দূর করার উদ্যোগ নিতে হবে। পণ্যের গুণগত মান বাড়ানোর ওপর আরো বেশি জোর দিতে হবে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্র জানায়, বাংলাদেশ বেশ কয়েকটি কৃষিপণ্য উৎপাদনে বিশ্বে শীর্ষ দশে রয়েছে। সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয়। বছরে উৎপাদন হয় ১ কোটি ৬০ লাখ টন। যদিও মান নিয়ে কড়াকড়ির কারণে ২০১৭ সালের মার্চে ইইউতে সবজি রপ্তানি প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ২০১৮ সালের জুলাইয়ে সে নিষেধাজ্ঞা শিথিল হয়েছে। আলু উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে ষষ্ঠ। ৫০ বছরে আলু উৎপাদন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ গুণ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) হিসাবে, গত অর্থবছরে আলু উৎপাদিত হয়েছে ১ কোটি ২ লাখ টন। এবার কৃষকরা ব্রোকলি উৎপাদন করে দাম পায়নি। দাম না পেয়ে বিভিন্ন স্থানে তা গরুকে খাওয়ানো হয়েছে। ফল উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ। বছরে ফল চাষের জমি বাড়ছে ১০-১১ শতাংশ হারে। কাঁঠাল উৎপাদনে বিশ্বে দ্বিতীয় ও আমে সপ্তম স্থানে আছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) ফলের রপ্তানি বাড়াতে গত জুনে একটি পরিকল্পনা তৈরি করেছে। রপ্তানির জন্য উৎপাদিত শস্যের গুণগত মানের অভাব, নিরাপদ শস্য উৎপাদনের অভাব, অতিরিক্ত রাসায়নিক ব্যবহার, চুক্তিভিত্তিক কৃষক না থাকা, অ্যাক্রেডিটেশন ল্যাবরেটরি না থাকা, তদারকি ও মান সনদের দুষ্প্রাপ্যতা, রপ্তানির জন্য বিশেষ অঞ্চল না থাকাসহ ২০ ধরনের প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত করেছে বারি।
বাংলাদেশ থেকে বিদেশে সবজি রপ্তানি বাড়াতে হলে বিষমুক্ত সবজি উৎপাদনে নজর দিতে হবে। বাংলাদেশ থেকে পাঠানো কয়েকটি সবজিতে কীটনাশক থাকায় কয়েকটি দেশ সবজি নেওয়া বন্ধ করে দেয়। কীটনাশকমুক্ত সবজি উৎপাদনের মাধ্যমে সে সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে। সবজি রপ্তানি বাড়াতে বিমানভাড়া সহনশীল করার তাগিদ দিয়েছেন রপ্তানিকারকরা। কীভাবে তা সম্ভব হবে সে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে পর্যালোচনা করা দরকার। উন্নত দেশগুলো কৃষিজাত খাদ্যপণ্য আমদানির ক্ষেত্রে অনেক বেশি সতর্ক থাকে। এ কারণে তারা পণ্যের আন্তর্জাতিক মান সনদের ওপর খুব বেশি গুরুত্ব আরোপ করে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অ্যাক্রেডিটেশন বোর্ডকে সঠিক ভূমিকা পালন করতে হবে। আমদানিকারক দেশগুলোর চাহিদা অনুযায়ী কৃষিপণ্য উৎপাদনেও স্বাস্থ্যকর পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। অনেক কৃষিপণ্যে দ্রুত পচন ধরে এবং জীবাণুর দ্রুত বংশবৃদ্ধি হয়। দেশব্যাপী সেসব পণ্যের সঠিক সংরক্ষণব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। একইভাবে পচনরোধী পরিবহনব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। আমরা আশা করি, বাংলাদেশের কৃষিপণ্য রপ্তানিতে যে গতি এসেছে, উত্তরোত্তর তা আরো শক্তিশালী হবে। এতে দেশ যেমন সমৃদ্ধ হবে, দেশের কৃষকরাও লাভবান হবে।
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার একটি বড় কৃষির ওপর নির্ভরশীল। প্রযুক্তির উৎকর্ষে বাংলাদেশের কৃষিতে বিপ্লব ঘটেছে। কৃষি উৎপাদন বেড়েছে কয়েক গুণ। ১৯৭২ সালের কৃষি উৎপাদনের চেয়ে এখনকার উৎপাদন ২৫ গুণেরও বেশি। এখন আমাদের কৃষকদের ৮০-৯০ শতাংশই প্রযুক্তিনির্ভর। খাদ্যশস্য উৎপাদনে আমরা পেছনে ফেলে দিয়েছি অনেক বড় বড় দেশকে। কৃষিপণ্য রপ্তানিতেও বাংলাদেশ দ্রুত সফলতা অর্জন করছে। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ ৬৭৮ মিলিয়ন ডলার কৃষিপণ্য রপ্তানি করেছে। বেশ কিছু বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য রপ্তানি করে বিপুল সুনাম অর্জন করেছে। এ সবই সরকারের ইতিবাচক প্রণোদনামূলক নীতির কারণে সম্ভব হচ্ছে। কৃষকদের জন্য এক কোটিরও বেশি ১০ টাকার ব্যাংক হিসাব, দুই কোটিরও বেশি কৃষি উপকরণ কার্ড, সাত কোটিরও বেশি মোবাইল ব্যাংক হিসাব, প্রত্যেক কৃষকের ঘরে বিদ্যুৎ, ১৫ হাজারেরও বেশি সৌর সেচ প্লান্টসহ নানা ধরনের সুযোগ সৃষ্টি করেছে শেখ হাসিনার সরকার। অনেক দিনের চেষ্টায় বাংলাদেশের কৃষিতে এমন বিপ্লব এসেছে। সারাবিশ্ব যখন করোনাকালে মহামন্দায় ভীতসন্ত্রস্ত, তখন আমাদের চাঙ্গা কৃষি আশার ক্ষেত্রকে প্রসারিত করে চলেছে।

করোনার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে কৃষকের জন্য তিন হাজার কোটি টাকার বিশেষ পুনরর্থায়ন তহবিল গঠন করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ তহবিল থেকে জামানতবিহীন সহজ শর্তে মাত্র ৪ শতাংশ সুদে ঋণ নিতে পারবেন কৃষকরা। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের কৃষিঋণ বিভাগ থেকে এসংক্রান্ত নীতিমালা দিয়ে একটি সার্কুলার জারি করা হয়েছে। সার্কুলারে বলা হয়েছে, দ্বিতীয় পর্যায়ে বিশেষ প্রণোদনায় পুনরর্থায়ন স্কিমের আওতায় কৃষিখাতের জন্য তিন হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠন করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব এই তহবিলের মেয়াদ হবে আগামী বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত। এই স্কিমের আওতায় অংশগ্রহণকারী ব্যাংক নিজস্ব নেটওয়ার্কের মাধ্যমে কৃষক ও গ্রাহক পর্যায়ে ঋণ বিতরণ নিশ্চিত করবে। কৃষকের জন্য স্বল্পসুদে ঋণ এই উদ্যোগটি নিঃসন্দেহে কল্যাণমুখী। এই উদ্যোগের সাফল্য কামনা করি।
লেখক: পরিচালক, এফবিসিসিআই, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড লিমিটেড।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন