কৃষক উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য খুব কমই পায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পায় না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পায়। যেমন, এবার পাটের দাম ভালোই পেয়েছে। উৎপাদন খরচ উঠিয়েও বেশ লাভ করেছে। প্রায় প্রতিবছরই দেখা যায়, উৎপাদিত অনেক ফসলের উৎপাদন খরচ পর্যন্ত কৃষক পায় না। এমন কি কোনো কোনো ফসলের মাঠ থেকে তোলার কিংবা বাজারে নেয়ার খরচও ওঠে না। এরকম পন্ডশ্রম ও লোকসান কৃষকদের হতাশ ও ক্ষুব্ধ করে। কখনো কখনো এর জের হিসেবে তারা ফসল ফেলে দেয়, গবাদী পশুকে খাইয়ে দেয় কিংবা পুড়িয়ে ফেলে। পাট ও আখের ক্ষেত পোড়ানোর কথা কিংবা মূলা-বেগুন-টমাটো ফেলে দেয়ার কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়। এটা বলাই বাহুল্য, কৃষক যখন কোনো ফসলের ন্যায়সঙ্গত মূল্য পায় না, তখন সেই ফসলের আবাদ-উৎপাদন পরবর্তীতে কমিয়ে দেয়। পাট ও আখের উৎপাদন কমে যাওয়ার এটাই মূল কারণ বলে মনে করেন পর্যবেক্ষকরা। গতকাল বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের তরফে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনের খবর প্রকাশিত হয়েছে। ওই সংবাদ সম্মেলনে অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে আলু নিয়ে কৃষক, মজুদকারীরা ও ব্যবসায়ীদের ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কার কথা ব্যক্ত করা হয়েছে। জানানো হয়েছে, দেশে আলুর বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৯০ লাখ টন। এবার উৎপাদিত হয় ১ কোটি ১০ লাখ টন। এই হিসাবে আলু উদ্বৃত্ত রয়েছে ২০ লাখ টন। মোট উৎপাদিত আলু থেকে দেশের ৪০০ কোল্ড স্টোরেজে ৪০ লাখ টন আলু সংরক্ষণ করা হয়। এই আলুর অধিকাংশই বিক্রী হয়নি। উৎপাদন ও স্টোরেজের খরচ প্রতিকেজিতে ১৮ টাকা পড়লেও কৃষক ও মজুদদাতরা পাচ্ছে ৯ টাকা। এই বিরাট ক্ষতির কারণে কোল্ড স্টোরেজ থেকে অনেকেই আলু তুলছে না। আগামী তিন মাসের মধ্যে অন্তত ২০ লাখ টন আলু বিক্রী নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছে আলুর মালিকেরা। আশঙ্কা করা হচ্ছে, কমপক্ষে ১০ লাখ টন আলু অবিক্রীত থেকে যেতে পারে। দু’মাস পরেই আলুর নতুন মওসুম শুরু হবে। তখন নতুন আলু কোল্ড স্টোরেজে রাখা নিয়েও সমস্যা দেখা দেবে।
কোল্ড স্টোরেজের মালিক ও ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি অনেক কৃষকও কোল্ড স্টোরেজে আলু রেখেছে অফ সিজনে ভালো দাম পাবে বলে। তাদের বেশির ভাগের আলু রাখার খরচ যোগাতে ঋণ-দেনা করতে হয়েছে। বাজারে আলুর চাহিদা ও দাম কম হওয়ার কারণে তাদের এখন মাথায় বাড়ি। শেষ পর্যন্ত আলু ফেলে দেয়া কিংবা গবাদী পশুর খাদ্য বানানো ছাড়া বোধহয় উপায় থাকবে না। ঋণ-দেনার কী হবে, সেটাও একটা বড় প্রশ্ন। যারা ব্যবসায়ী এবং কোল্ড স্টোরেজের মালিকদের যারা আলু মজুদ করেছেন, তারাও বড় রকমে ক্ষতির মুখে পড়বে। এই ক্ষতি ভবিষ্যত আলু মজুদ ও সংরক্ষণে তাদের নিরুৎসাহিত করতে পারে। আলুর আবাদ-উৎপাদনেও এর বিরূপ প্রভাব দেখা দিতে পারে। আলু নিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য করোনা মহামারির উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে সবকিছু বন্ধ থাকায় আলুর বাজারজাতকরণ ও রফতানি ব্যহত হয়েছে। স্বাভাবিক অবস্থা থাকলে আলুর এত মজুদ থাকতো না। দামও এত কম হতো না। যা হোক, পরিস্থিতি উত্তরণে কার্যকর পদক্ষেপ অবিলম্বে নিতে হবে। যে কোনো মূল্যে এবং যত শিগিরির সম্ভব, ২০ লাখ টন আলু বিক্রীর ব্যবস্থা করতে হবে। বলা হয়েছে, যদি তা না করা যায়, তবে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হবে। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, এই ক্ষতি ঠেকাতে সরকারকে কৃষক ও ব্যবসায়ীদের পাশে এসে দাঁড়াতে হবে। উপযুক্ত দামে আলু কিনতে হবে। দরিদ্রদের জন্য সরকার খাদ্যপণ্য বিতরণ করে থাকে। এই পণ্যের মধ্যে আলুকে যুক্ত করা যেতে পারে। টিসিবির মাধ্যমে বিভিন্ন খাদ্যপণ্য কমমূল্যে বিক্রী করা হচ্ছে। সেখানে আলুও থাকতে পারে। দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষ দরিদ্র হয়ে পড়েছে। তাদের মধ্যে হতদরিদ্রও আছে, যাদের ১০ টাকায়ও এককেজি আলু কেনার সামর্থ্য নেই। তাদের কথা বিবেচনায় আনা যেতে পারে। আলু বিভিন্ন দেশে প্রধান খাদ্যও বটে। তাছাড়া আলু দিয়ে চিপস-সহ অনেক আইটেম তৈরি হয়। বিশ্বে আলুর যথেষ্ট চাহিদা আছে। তাই আলু রফতানি জোরদার করার পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে। নানা দেশে খাদ্য সঙ্কট, পুষ্টিসঙ্কট প্রকট। আফগানিস্তান তার মধ্যে অন্যতম। আফগানিস্তান এখন কার্যত বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন। বিভিন্ন দেশ তাকে খাদ্য ও ত্রাণ সহায়তা দিচ্ছে। বাংলাদেশও দেশটিতে আলুসহ খাদ্য ও অন্যান্য জরুরি সহায়তা পাঠাতে পারে।
এবার প্রলম্বিত বন্যা, নদীভাঙন জোয়ার-জলোচ্ছ্বাস এবং কোথাও কোথাও খরার কারণে ঘর-বাড়ি, জমিজিরাত ও ফসলাদির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। যুগপৎ বন্যা ও খরার শিকার হয়েছে দেশের উত্তরাঞ্চল। জোয়ার-জলোচ্ছ্বাসে বিপর্যস্ত হয়েছে উপকূলীয় বিস্তীর্ণ এলাকা। এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ-বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক ও সাধারণ মানুষ ঘুরে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে। রবিশস্য ও শীতকালীন শাক-সব্জি আবাদে তারা উঠে পড়ে লেগেছে। উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চল থেকে পাওয়া খবরে জানা গেছে, ওই দু’অঞ্চলে শাক-সব্জি ও তরিতরকারী আবাদে ব্যাপক আয়োজন হয়েছে। আগাম আবাদের শাক-সব্জি ও তরিতরকারী ইতোমধ্যে বাজারে আসতে শুরু করেছে। বাজারে চাল, ডাল, আটা, তেল, চিনি, মুরগী, ডিম ইত্যাদির দাম হু হু করে বাড়ছে। শাক-সব্জি, তরিতরকারীর দামও সাধারণ মানুষের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। মধ্যবিত্ত থেকে বিত্তহীন পর্যন্ত বিপুল সংখ্যক মানুষ এই দুর্মূল্যের বাজারে কীভাবে জীবন অতিবাহিত করছে তা ভুক্তভোগী ছাড়া কারো পক্ষে বলা সম্ভব নয়। নানা দুর্বিপাক অতিক্রম করে দেশের কৃষক নতুন উদ্যমে আবাদে মেতেছে। তাদের ফসল ও উৎপন্নদ্রব্যের ন্যায্যমূল্য যাতে নিশ্চিত হয়, সরকারকে তার ব্যবস্থা অবশ্যই করতে হবে। আলু চাষিদের মতো পরিস্থিতির মুখোমুখী যাতে তাদের না হতে হয় তার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। বাজারের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। প্রক্রিয়াজাতকরণের ব্যবস্থা বাড়াতে হবে। পচনশীল ও সংরক্ষণযোগ্য পণ্যের সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে। সুষ্ঠু ও আধুনিক বাজারব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে। মধ্যসত্ত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য দূর করতে হবে এবং তদারকি বাড়াতে হবে। মোটামুটি এসব ব্যবস্থা নেয়া হলে কৃষকদের ন্যায্যমূল্য দেয়া সম্ভবপর হবে বলে আশা করা যায়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন