বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

বাংলাদেশ ক্রিকেটের এই দুর্দিন কেন

মেহেদী হাসান পলাশ | প্রকাশের সময় : ১৩ নভেম্বর, ২০২১, ১২:০২ এএম

আমি নিজে ক্রিকেট বিশেষজ্ঞ নই। তবে আমাকে ক্রীড়ামোদী দর্শক বলা যায়। শুধু ক্রিকেট নয়, ফুটবলও আমার প্রিয় একটি খেলা। আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট ছাড়াও রাত জেগে ইউরোপিয়ান ফুটবলের খেলাগুলো দেখি। ক্রিকেট খেলা দেখা শুরু করেছি ১৯৮৮ সাল থেকে। সে সময়ে টেস্ট ক্রিকেট টুর্নামেন্ট বেশি হতো। দীর্ঘ পাঁচদিনের টুর্নামেন্ট নিয়মকানুন অনেক কিছুই বুঝতাম না। গ্রামের খেলার মাঠে টেপ টেনিস ক্রিকেট খেলেছিও ছোটবেলায়। ক্রিকেটের প্রতি আমার বিশেষ আগ্রহ শুরু হয় ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেট টুর্নামেন্ট থেকে। এই বিশ্বকাপে ইমরান খানের নেতৃত্বে অনেকটা ভাঙাচোরা একটি দল নিয়ে পাকিস্তান চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে প্রথমবারের মতো। এরপর থেকেই ফুটবলের চেয়ে ক্রিকেটের প্রতি অনুরাগ বাড়তে থাকে ধীরে ধীরে।

বাংলাদেশ ওয়ানডে স্ট্যাটাস, টেস্ট স্ট্যাটাস পেলে বাংলাদেশকে সমর্থন করা শুরু করি। আতাহার আলী খান, মিনহাজুল আবেদীন নান্নু, আকরাম খান, ফারুক আহমেদ, আমিনুল ইসলাম বুলবুলÑ বাংলাদেশের ক্রিকেটের স্বর্ণালি যুগের উজ্জ্বল তারকা। তাদের খেলা দেখতে ১নং জাতীয় স্টেডিয়ামে নিয়মিত গিয়েছি। সেই সময় বাংলাদেশ ক্রিকেট লীগে আবাহনী-মোহামেডান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দল ছিল। এই দলে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকাসহ বিভিন্ন দেশের ক্রিকেটাররা খেলত। আমি নিজে মাঠে থেকে আবাহনীর পক্ষে ওয়াসিম আকরামের খেলা ঢাকা স্টেডিয়ামে দেখেছি। বাংলাদেশের ক্রিকেটের অনেক উত্থান-পতন, গৌরব-লজ্জা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছি। সে কারণে বাংলাদেশ ক্রিকেটের এই চরম দুর্দিনে একজন সাধারণ দর্শক হিসেবে আমার অভিব্যক্তি তুলে ধরতে চাই। বিশ্বকাপ টি-টোয়েন্টি ২০২১ এ বাংলাদেশের লজ্জাজনক ফলাফলের পরে সোশ্যাল মিডিয়াতে যে সমস্ত লেখালেখি হয়েছে, আমার আলোচনা সেসবের প্রতিফলন থাকবে।

আমাদের কৈশোর ও তারুণ্যে ফুটবল নিয়ে উন্মাদনা বেশি ছিল। ক্রিকেট তখনও এতটা জনপ্রিয়তা পায়নি। এখন যেমন বিশ্বকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টের সময়ে সারাদেশে আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের জাতীয় পতাকায় ছেয়ে যায়, ঠিক তেমনি আমাদের ওই সময়ে আবাহনী-মোহামেডান ফুটবল খেলা সামনে এলে সারাদেশের ঘরবাড়ি, হাট-বাজার, দোকানপাট, যানবাহনে আবাহনীর নীল এবং মোহামেডানের সাদাকালো পতাকায় ছেয়ে যেতো। আমাদের কৈশোর ও তারুণ্যে গ্রামে রেডিওতে ফুটবলের ধারাভাষ্য শুনে দারুণভাবে আপ্লুত হতাম। মোহাম্মদ আব্দুল হামিদ, আলফাজ আহমেদ, মোহাম্মদ মুসা প্রমুখ ধারাভাষ্যকারের কণ্ঠস্বর আমাদের মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল। আরো পরে যখন দৈনিক ইনকিলাবে লেখালেখি শুরু করলাম, তখন ইনকিলার স্পোর্টস সেকশনে আব্দুল হামিদ এবং নিউজ সেকশনে মুসা ভাইকে দেখে আমার সে কী আনন্দ! গ্রামে গিয়ে যখন বন্ধুদের বলতাম, আমি হামিদ ভাই এবং মুসা ভাইয়ের সাথে কাজ করি তখন সবাই বিস্মিত হতো।

বাংলাদেশ ক্রিকেট জনপ্রিয় হওয়া শুরু করে ১৯৯৭ সালে আইসিসি ক্রিকেট টুর্নামেন্টে বিজয়ী হওয়ার মাধ্যমে। এই টুর্নামেন্টের বিজয়ী হয়ে বাংলাদেশ আইসিসির ওয়ানডে খেলার মর্যাদা লাভ করে এবং ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পায়। বাংলাদেশ একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম জয়ের দেখা পায় ১৯৯৮ সালে। ২২ খেলায় হারের পর মো. রফিকের অসাধারণ নৈপুণ্যে (৭৭ রান ও ৩টি উইকেট) কেনিয়ার বিপক্ষে ভারতে অনুষ্ঠিত খেলায় বাংলাদেশ এই জয়লাভ করে। পরবর্তীতে অক্টোবর মাসে আইসিসি নক-আউট ট্রফি আয়োজন করে বাংলাদেশ, যেখানে সকল টেস্ট খেলুড়ে দল এই একদিনের আন্তর্জাতিক নক-আউট প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে। ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি জেতার মাধ্যমে বাংলাদেশ ১৯৯৯ সালে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ খেলার অধিকার পায় এবং আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সংস্থার নিয়মিত সদস্য পদ লাভ করে। প্রথমবার বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করেই বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেয় বাংলাদেশ। দলের অসাধারণ ফিল্ডিং এবং খালেদ মাহমুদের ব্যক্তিগত বোলিং (৩/৩১) নৈপুণ্যে বাংলাদেশ ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপজয়ী পাকিস্তানকে ৬২ রানে পরাজিত করে। ম্যাচ সেরা বিবেচিত হন খালেদ মাহমুদ। স্কটল্যান্ড এবং পাকিস্তানকে হারানোর পরও বাংলাদেশ বিশ্বকাপের পরবর্তী রাউন্ডে যেতে ব্যর্থ হয়। কিন্তু এই জয় বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক টেস্ট দলের সদস্য হতে সহায়তা করে।

২০০০ সালের ১০ নভেম্বর বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দল টেস্ট খেলার মর্যাদা অর্জন করে। তাও আবার শক্তিশালী ভারতের বিপক্ষে খেলেছিল বাংলাদেশ নাঈমুর রহমান দুর্জয়ের অধিনায়কত্বে। নাঈমুর রহমান দুর্জয় বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট অধিনায়ক। বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট ম্যাচে ১৪৫ রান করে ইতিহাসে নাম লেখান আমিনুল ইসলাম বুলবুল। অধিনায়ক নাইমুর রহমানের ১৩২ রানে ৬ উইকেট অভিষেক টেস্টের প্রথম ইনিংসে কোনো বোলারের সেরা বোলিং। কিন্তু দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিং ব্যর্থতার কারণে ৯ উইকেটে হেরে যায় বাংলাদেশ। সেই থেকে শুরু হয় দেশে টেস্ট ক্রিকেটের পথচলা। বাংলাদেশ প্রথম টেস্ট জয় পায় ২০০৫ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে চট্টগ্রামে। ম্যাচ সেরা হন এনামুল হক জুনিয়র। শুধু ওয়ানডে ও টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়া বা বিজয় নয়, বাংলাদেশ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট সফলভাবে আয়োজন করে। এরমধ্যে আইসিসি ইন্টারন্যাশনাল টি-২০ বিশ্বকাপ এবং এশিয়া কাপ ক্রিকেট অন্যতম। এসব কারণে বাংলাদেশ ক্রিকেট জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে ফুটবলকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে এক নম্বর স্থান অধিকার করে। এতে করে বাংলাদেশ বিভিন্ন স্থানীয় ও বহুজাতিক কোম্পানি স্পন্সর হতে আগ্রহী হয়ে এগিয়ে আসে। ফলে বিসিবি আর্থিকভাবে সচ্ছল ক্রীড়া সংস্থায় পরিণত হয়।

বাংলাদেশের অন্য আর দশটি প্রতিষ্ঠানের মতো এ সময় বিসিবিকে দখল করার জন্য এই দেশের অর্থগৃধনু ও ক্ষমতালোভী প্রচারমুখী এবং দলান্ধ রাজনীতিবিদরা উঠেপড়ে লাগে। ফলে বিসিবির নিয়ন্ত্রণ সাবেক ক্রিকেটার ও ক্রিকেটবোদ্ধাদের হাত থেকে ফুলটাইম রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের হাতে চলে যায়। ব্যবসায়ীদের ধর্ম এই যে, তারা সবার আগে মুনাফাকে প্রাধান্য দেয়। আর এই মুনাফাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেটের পতনের সিঁড়ি তৈরি হতে থাকে। তবে এই সিঁড়ি এস্কেলেটরে পরিণত হয় যখন ক্রিকেটারদের রাজনীতির মাঠে টেনে নামানো হয় বা নামতে বাধ্য করা হয়। বিশ্বের আর কোনো দেশে একটি জাতীয় দলের অধিনায়ককে সংসদ সদস্যের নমিনেশন দেয়ার নজির আছে কি না আমার জানা নেই। সাকিবসহ অন্য আরো কয়েক ক্রিকেটার নমিনেশন চেয়ে ব্যর্থ হলেও নির্বাচনী প্রচারের মাঠে থাকেন। জাতীয় দলের সকল খেলোয়াড়কে নির্বাচনী প্রচারণার কাজে ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে যেদিন এভাবে রাজনীতিকীকরণ করা হয়েছে, সেদিনই এই দলটির পতনের বীজ বপন করা হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। এখন সেই বীজের অঙ্কুরোদগম ঘটেছে। ফলে তা আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে।

বিশ্বের অনেক দেশেই ক্রীড়াঙ্গনের মানুষ রাজনীতিতে এসে সফল হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় এর নজির ভুরিভুরি। তবে এক্ষেত্রে কিংবদন্তির পর্যায়ে পৌঁছে গেছেন পাকিস্তানের বিশ্বকাপ জয়ী অধিনায়ক ইমরান খান। অবশ্য তারা সকলে রাজনীতিতে এসেছেন অবসরের পরে।

বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের পতনের অন্যতম কারণ বিসিবি। বিশ্বের অন্যান্য ক্রিকেট খেলুড়ে দেশের ক্রিকেট নিয়ন্ত্রণ সংস্থা গঠিত হয় সাবেক ক্রিকেটার, ক্রীড়া সংগঠক ও ক্রিকেটবোদ্ধাদের নিয়ে। অথচ, বাংলাদেশের ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড নিয়ন্ত্রণ করছে কয়েকজন ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ। বাংলাদেশ ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড মূলত ব্যবসায়ীদের নাম প্রচারের একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। তারা ক্রিকেট রাজনীতি করতে গিয়ে জেলা পর্যায়ের ক্লাবগুলোকে নিয়ে নোংরা খেলায় মাতেন এমন অভিযোগ রয়েছে। ক্লাব ক্রিকেটে ম্যাচ গড়াপেটার এন্তার অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। অভিযোগ রয়েছে, বিসিবির নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে প্রায় খেলার অযোগ্য পিচ বানিয়ে বিভিন্ন দেশকে বাংলাদেশে নিয়ে এসে অনেকটা বিস্ময়কর ফলাফল অর্জন করেছে বিসিবি। এ কারণে দ্বিতীয় শ্রেণির দলেও আপত্তি করেনি তারা।

এ মুহূর্তে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের নেতৃত্ব দিচ্ছেন রমিজ রাজা, ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের নেতৃত্ব দিচ্ছেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। তাদের সকলেরই ক্রিকেটে দীর্ঘ আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার রয়েছে। শুধু তাই নয়, তারা নিজ দেশকে সুনামের সাথে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। বিসিবির নেতৃত্ব কারা দিচ্ছেন টিভির পর্দায় চোখ রাখলেই বোঝা যায়।

ক্রিকেটাররা খেলছেন, তাদের জন্য রাষ্ট্র কাড়িকাড়ি টাকা ঢালছে, যা মূলত জনগণের কষ্টের টাকা। তারা জিতবেন এটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু প্রতিবার জয়ের পর বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে অভিনন্দনের যেভাবে ফুলঝুরি ছড়ানো হতে থাকে তা বিশ্বে বিরল। কোনো কোনো সময় তো আবার নফল নামাজ, বিশেষ দোয়ার বরকতের কথাও শোনা যায়। এইভাবে ক্রিকেটকে রাজনীতির মাঠে টেনে আনার ফল, আজকের এই ভগ্নদশা। পাকিস্তান দলটির আজকের সফলতার জন্য সিনিয়র ক্রিকেটার মোহাম্মদ হাফিজ, শোয়েব মালিকের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বাংলাদেশে সিনিয়র ক্রিকেটারদের বাদ দিয়ে জি হুজুর বলতে পারে এমন জুনিয়র ক্রিকেটারদের দলে ভেড়ানো বিসিবির অন্যতম কাজ।

এবার দেখা যাক, বাংলাদেশ ক্রিকেটের করুণ দশার কারণ হিসেবে বিশ্বের খ্যাতনামা ক্রিকেটার ও ক্রিকেট বিশেষজ্ঞগণ কী বলছেন। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা গেছে, বাংলাদেশ ক্রিকেটের করুণ দশায় দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক ফাস্ট বোলার ডেল স্টেইন বলেছেন, ‘বাংলাদেশ মাঠে যেমন পারফরম্যান্স করেছে, ওরা এর চেয়ে ভালো দল। ম্যানেজমেন্টের দোষ নেই, খেলোয়াড়দের জবাবদিহির আওতায় আনা প্রয়োজন। হয় আপনি খেলতে চাইবেন কিংবা চাইবেন না, ওদের দেখে মনে হয়নি খেলতে চেয়েছে।’

পাকিস্তানি পেসার ওয়াহাব রিয়াজের কাছে মনে হয়েছে, বল না বুঝে মারতে গিয়ে আউট হয়ে ফিরছেন বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানেরা, ‘ওদের শরীরী ভাষা দেখলেই মনে হয় তারা জেতার জন্য খেলছে না, খেলতে হয় বলে খেলছে। বুঝলাম, তারা একটা ম্যাচও জেতেনি, সব ম্যাচ হেরেছে। কিন্তু শরীরী ভাষা একটা ম্যাচের ফলাফলে অনেক বড় প্রভাব ফেলে। আজ আমরা দেখলাম ওদের ব্যাটসম্যানরা শুধু এল আর গেল। কারোর খেলা দেখে মনে হয়নি তারা অনেকক্ষণ খেলতে চায়। বল মিস করছে তারা, ব্যাটের কানায় লাগছে। স্পিন বুঝতে পারছে না, গুগলি বুঝতে পারছে না। তাও তাকেই আক্রমণ করতে যাচ্ছে। দলের রসায়ন, জেতার ইচ্ছা, পরিকল্পনা কিছুই বোঝা যায়নি তাদের খেলায়।’ বাংলাদেশের ক্রিকেটের উন্নতি কীভাবে সম্ভব, পাকিস্তানের অন্যতম কিংবদন্তি ওয়াসিম আকরামের এমন প্রশ্নে ওয়াহাব বলেন, ‘ওরা অনেক বেশি বাঁহাতি স্পিনারের ওপর নির্ভরশীল। প্রতি দলে অন্তত দু’জন থাকে। পেস বোলার সেখানে তেমন পাওয়াই যায় না। এতদিন পর শরিফুল বলে একজন বোলার এসেছে, মোস্তাফিজ তো আছেই। কিন্তু এরা ছাড়া ওদের পেস বোলার তেমন কেউ নেই। ওদের যে অধিনায়ক ছিলেন মাশরাফি, তিনি দলটাকে অনেক ভালোভাবে আগলে রেখেছিলেন। অধিনায়কত্বেও (মাহমুদউল্লাহর) তেমন কিছু দেখিনি। দলের বাকিদের মধ্যেও সে ইচ্ছাটা দেখিনি।’

পাকিস্তানের বিশ্বকাপ জয়ী ম্যাচের ম্যান অব দ্যা ম্যাচ ওয়াসিম আকরামের চোখে পড়েছে দলে কবজির মোচড় দিয়ে বল করার কেউ না থাকার বিষয়টা। তিনি বলেছেন, ‘আইসিসির বোলিং র‌্যাংকিংয়ে প্রথম ১০ জনের মধ্যে ৬ জনই রিস্ট স্পিনার। জাম্পাও আলো ছড়াল। আমার মনে হয় এটা এমন এক তথ্য যেখান থেকে বাংলাদেশ শিক্ষা নিতে পারে, দলে রিস্ট স্পিনার খেলাও। পাকিস্তানের দিকে যদি তাকাই, অনেক রিস্ট স্পিনার আছে আমাদের। শাদাব আছে, বেঞ্চে উসমান কাদির আছে। যুব দল থেকেও অনেকে উঠে আসছে। কিন্তু আমার কাছে মনে হচ্ছে সমস্যাটা বাংলাদেশ ক্রিকেটের। হ্যাঁ, জিত-হার খেলার অংশ, তাই বলে এভাবে কেউ হারে না। সত্তরে অলআউট (৭৩), ছিয়াত্তরে অলআউট (৮৪)। ব্যাট করতে গেলে কারোর পা বের হচ্ছে না। জেতার ইচ্ছা নেই কারোর। বাংলাদেশের জন্য এটা অনেক লজ্জাজনক।’

আরেক পাকিস্তানি সাবেক অধিনায়ক মিসবাহর কাছে মনে হয়েছে, প্রতি দলে অন্তত একজন করে লেগ স্পিনারের পরিচর্যা করা উচিত, যা পাকিস্তান ২০১৯ সাল থেকে করে আসছে। ‘২০১৯ বিশ্বকাপের পর আমাদেরও এমন সমস্যা হচ্ছিল। আমরা লেগ স্পিন খেলতে পারছিলাম না। চায়নাম্যান বোলার খেলতে পারতাম না। বাংলাদেশ এখন একই সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। আপনাকে সময় দিতে হবে, ধৈর্য্য ধরতে হবে, খেলোয়াড়দের পরিচর্যা করতে হবে, এখন যেটা শ্রীলঙ্কা করছে। এ ব্যাপারটা বাংলাদেশে নেই, তারা ধৈর্য্য ধরতে চায় না। স্বল্প মেয়াদে সাফল্য খোঁজে তারা। এভাবে সফল হওয়া যায় না। আমরা যেমনটা করেছিলাম, ২০১৯ সালের পর আমরা প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে প্রতি স্কোয়াডে খুঁজে খুঁজে একজন করে লেগ স্পিনার খেলিয়েছি। আমরা দেখেছি, আমাদের দলগুলোর শক্তির জায়গা কোথায়। দীর্ঘমেয়াদে চিন্তা করতে হবে, পিচের উন্নতি করতে হবে। এসব হলে আপনাদের ব্যাটসম্যানদের টেকনিকও ভালো হবে।’

বাংলাদেশের এমন পারফরম্যান্স দেখে মার্ক ওয়াহ রীতিমতো ধুয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশকে। তিনি বলেছেন, ‘বিষয়টা লজ্জাজনক। এমন মানের ব্যাটিং আপনি পার্কের তৃতীয় শ্রেণির ক্রিকেটেও দেখতে পাবেন না।’ বাংলাদেশের ব্যাটিং হার্শা ভোগলেকে হতাশ করেছে। ম্যাচ শেষে বাংলাদেশকে নিয়ে হতাশা লুকাতে পারেননি ভোগলে, ‘বাংলাদেশ খুব হতাশ করল। এই টুর্নামেন্ট দুটি জয়ের সঙ্গে ৬টি হার দিয়ে শেষ করল। এখন ড্রয়িং বোর্ডে ফেরা ছাড়া উপায়ও নেই। দুশ্চিন্তার ব্যাপার হলো, প্রতিভাবান খেলোয়াড়েরা তাদের প্রত্যাশিত মানে উঠে আসছে না।’ ক্রীড়া লেখক টিম উইগমোর বলেছেন, ‘বাংলাদেশ খুবই জঘন্য খেলল, সম্ভবত সুপার টুয়েলভের সবচেয়ে বাজে দল তারা।’

বাংলাদেশের সমস্যা দেখাতে গিয়ে খুব সহজ-সরল এক টুইট করেছেন ক্রিকেট বিশ্লেষক ফ্রেডি ওয়াইল্ড। ‘টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সবচেয়ে বড় হতাশার নাম বাংলাদেশ। তাদের বোলিং ভালোই ছিল, কিন্তু ব্যাটিং একদম ছন্নছাড়া। বিশ্বকাপের জন্য দায়টা হয়তো কোচিং দলকে দেওয়া হবে। তাদের জন্য খারাপ লাগছে। কিন্তু যারা পেস ও বাউন্সের বিপক্ষে খেলতে পারে না এবং যাদের জোরে শট খেলার সামর্থ্য নেই, তাদের নিয়ে আপনি কীই-বা করতে পারেন।’ অস্ট্রেলিয়ান সংবাদমাধ্যম কোডের ক্রীড়া সাংবাদিক ডেনিয়েল চেরনি বাংলাদেশের ক্রিকেট সংস্কৃতি নিয়েই টুইট করেছেন, ‘গত ২৫ বছরে বাংলাদেশের উন্নতি দেখলে মনে হয়, ওরা সাত ধাপ এগোলে ছয় ধাপ পেছায় এবং এটা চলতেই থাকে। কিছু উন্নতি আছে, কিন্তু সেটা যন্ত্রণাদায়কভাবে ধীরগতির।’

উইজডেনের বর্ষসেরা বই ‘ক্রিকেট টু পয়েন্ট জিরো’র লেখক টিম উইগমোরের ভাষায়, সুপার টুয়েলভের সবচেয়ে বাজে দল বাংলাদেশ।

উদ্ধৃত মন্তব্যগুলো থেকে বোঝা যায়, বিশ্বকাপে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের বাজে পারফন্সের জন্য শুধু বোর্ড বা ক্রিকেট কর্তারা একা দোষী নয়। খেলোয়াড়দেরও দোষ রয়েছে। হারজিত খেলার অংশ। কিন্তু বাংলাদেশ যেভাবে খেলেছে তাতে জয়ের লক্ষ্যে খেলছে, এটা কখনই মনে হয়নি।

বিশ্বকাপ খেলা যেকোনো ক্রিকেটারের সারা জীবনের স্বপ্ন। কিন্তু টুর্নামেন্টের শুরুতে যেভাবে তামিম সরে গিয়েছে তা কোনোভাবেই স্বাভাবিক ছিল না। এখানে কার দোষ সেটি এখনো আলোর মুখ দেখেনি। কিপিং থেকে মুশফিককে সরিয়ে দেয়া নিয়েও নানা কথা আলোচিত হয়েছে। সিনিয়র ক্রিকেটারদের মধ্যে গ্রুপিংয়ের বিষয়টি আলোচিত হয়েছে। মুস্তাফিজ, সাকিব আইপিএলে যেভাবে খেলেছে তার ছিটেফোটাও ছিলো না জাতীয় দলে। বরং ডট বল দেয়ায় যার খ্যাতি সেই মুস্তাফিজ ছিলেন দলের অন্যতম খরুচে বোলার। বলের লাইন, লেন্থ কিছুই ঠিক ছিলো না। ওয়াইড বল দিয়েছেন লজ্জাকর হারে। তাসকিনের মতো বোলারকে বেঞ্চে বসিয়ে রাখা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। শুধু মুশফিক নন, অধিকাংশ ব্যাটসম্যান রিভার্স সুইপ, স্কুপ শট খেলতে গিয়ে যত না রান করেছে তার চেয়েও বেশি আউট হয়ে দলকে বিপদে ফেলেছে। বিশ্বকাপের মতো মঞ্চে দলের ক্রশিয়াল মোমেন্টে মুশফিক যেভাবে একের পর এক স্কুপ শট খেলে আউট হয়েছেন তা মেনে নেয়া কঠিন। এমনিতেই বাংলাদেশ দল বিগ শট খেলতে পারে না, তার উপর কোয়ালিটি পেস বা কোয়ালিটি স্পিন কোনোটার বিরুদ্ধেই বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা সাবলিল নয়। আফগানিস্তান, স্কটল্যান্ডের ব্যাটসম্যানরা যখন বিশাল বিশাল ছক্কা মেরে বলকে গ্যালারিতে, কিম্বা স্টেডিয়ামের ছাদে ফেলছে, বাংলাদেশ দল তখন ছক্কা মারতে গিয়ে অধিকাংশ সময়ই সীমানায় ধরা খেয়েছে। টি-২০ ক্রিকেটে ডাবলসগুলোকে ব্যাটসম্যানরা বাউন্ডারি বানায় এবং বাউন্ডারির বলকে ছক্কা বানায়। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানেরা ছক্কার বল বাউন্ডারি মারতে পারলেই যেন খুশি, আর বাউন্ডারির বল সিঙ্গেলস, ডবলস নিয়েই তৃপ্ত। টি-২০তে ফিল্ডাররা হাফ চান্স বলকে ব্যক্তিগত দক্ষতায় ক্যাচে পরিণত করে। আর বাংলাদেশের ফিল্ডারদের লোপ্পা ক্যাচ হাত গলিয়ে পড়ে যায়। প্রকৃতপক্ষে আধুনিক টি-টুয়েন্টি খেলার যে মান সেখান থেকে বাংলাদেশ দল অনেক দূরে। এর অনেক কারণ রয়েছে। প্রধান কারণ, বাংলাদেশে ঘরোয়া খেলায় টি-২০র তেমন টুর্নামেন্ট নেই। বিপিএল আয়োজন করা হলেও এর মান নিয়ে কেউ সন্তুষ্ট নয়। ফ্রাঞ্চাইজিরা খেলোয়াড়দের টাকা পরিশোধ না করায় বিশ্বখ্যাত খেলোয়াড়রা এখানে খেলতে আসতে চায় না।

এ অবস্থা থেকে বেরুতে চাইলে লিগ পর্যায়ে, বয়স ভিত্তিক, এবং জেলা পর্যায়ে টি-২০ লিগ চালু করা প্রয়োজন। কেননা, টি-২০ লিগের উত্তেজনা, গ্লামার, প্রতিযোগিতা সবকিছু দিয়ে প্রমাণ করেছে আগামীর ক্রিকেট মানেই টি-২০ লিগ। টেস্ট ক্রিকেট চললেও ওয়ানডে ফর্মেটের ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে টি-২০ লিগ। আশা করি, বিসিবি এ ব্যাপারে ভূমিকা রাখবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (9)
Farzana Faiza ১৩ নভেম্বর, ২০২১, ১:২৪ এএম says : 0
· হারলেও বাংলাদেশ জিতলেও বাংলাদেশ হাজারবার হারতে থাকলেও বাংলাদেশ
Total Reply(1)
abul kashem ১৬ নভেম্বর, ২০২১, ১১:৩৭ পিএম says : 0
Faltu
Shamima Shammi ১৩ নভেম্বর, ২০২১, ১:২৪ এএম says : 0
· বিবাহিতর সংখ্যা ক্রিকেটে বেড়ে যাওয়াতে এমন হচ্ছে।
Total Reply(0)
Upoma Akter Mithila ১৩ নভেম্বর, ২০২১, ১:২৫ এএম says : 0
· একটা বিশ্বকাপ দিয়ে কখনো আমাদের ক্রিকেটারদের মূল্যায়ন করবেন না আমাদের ক্রিকেটাররা নিজেরাই বিশ্বকাপের চেয়েও মূল্যবান
Total Reply(0)
Nakibul Hasan ১৩ নভেম্বর, ২০২১, ১:২৫ এএম says : 0
বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমকে কয়েক বছরের জন্য নিষিদ্ধ করা দরকার
Total Reply(0)
মুহাম্মদ মুহিদুজজামান ১৩ নভেম্বর, ২০২১, ১:২৬ এএম says : 0
খেলার নামে কোটি কোটি টাকা লুটপাঠের মহাউৎসব ।এই জাতির জন্য খেলা কোন কল্যান বয়ে আনতে পারবেনা ।১৫ জন খেলোয়ার এর সাথে আরো ৬০ জনের পিকনিক বহর ।এদের জন্য টাকা খরচ না করে দেশের কল্যানে টাকা গুলি খরচ করা হোক ।অনেক হয়েছে এবার সমাপ্তি ঘোষনা করা হোক ।আমাদের খেলার দরকার নেই খাবারের দরকার ।
Total Reply(0)
Adhara Jaman Chhoa ১৩ নভেম্বর, ২০২১, ১:২৬ এএম says : 1
সব দোষ সমালোচক দের, অতিরিক্ত সমালোচনা করতে গিয়ে টাইগারদের মন একেবারে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিয়েছে সমালোচক রা
Total Reply(0)
Omar Ibn Habib ১৩ নভেম্বর, ২০২১, ১:২৭ এএম says : 0
পুরো ক্রিকেট বোর্ডটাই প্রাইভেট খাতে ছেড়ে দিতে হবে।তখন বুঝা যাবে কত ধানে কত চাল।দলে চান্স পেতেও অনেকের কেয়ামত হয়ে যাবে তখন। শুধু শুধু দেশের টাকা অপচয় ছাড়া কোন লাভ নেই।
Total Reply(0)
Nahiduzzaman Kiyas ১৩ নভেম্বর, ২০২১, ১:২৭ এএম says : 0
আমরা হারতে শিখে গেছি আমাদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারবানা। জয় বাংলা।
Total Reply(1)
১৬ নভেম্বর, ২০২১, ১১:৪০ পিএম says : 0
Motiur Rahman Sagar ১৩ নভেম্বর, ২০২১, ১:২৮ এএম says : 0
শুধু ক্রিকেট সেক্টর নয়, প্রতিটি সেক্টরেই এইরকম ধ্বজভঙ্গ। পরিকল্পনার অভাব আর দুর্নীতি এইসবের কারণ।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন