বুড়িগঙ্গা নদী বাঁচাতে হাজারীবাগ থেকে ট্যানারিশিল্প সাভারের হেমায়েতপুরে স্থানান্তর করা হলেও, তা এখন ধলেশ্বরী ও বংশী নদীসহ আশপাশের এলাকার জন্য বিপর্যয়কর হয়ে উঠেছে। কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার (সিইটিপি) পুরোপুরি প্রস্তুত এবং পরিবেশবান্ধব না করে সেখানে কারখানা স্থানান্তরের বিষয় নিয়ে শুরুতেই প্রশ্ন উঠেছিল। সরকার বিভিন্ন সময়ে আল্টিমেটাম দিয়ে ট্যানারি মালিকদের সেখানে স্থানান্তরে বাধ্য করে। স্থানান্তরের পর থেকেই চালু হওয়া ট্যানারির বিষাক্ত বর্জ্য শোধনের অপর্যাপ্ততার কারণে ভয়াবহ দূষণ ছড়াতে থাকে। এসব বর্জ্য সরাসরি ধলেশ্বরী নদীতে গিয়ে পড়তে শুরু করে। এতে শুধু এই নদী নয়, বংশী নদীসহ পুরো এলাকার জীববৈচিত্র্য, আশপাশের কৃষিজমি দূষিত হয়ে পড়েছে। স্থানীয় লোকজন নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। দূষণ এতটাই তীব্র হয়ে উঠেছে যে, মানিকগঞ্জের সিংগাইর পর্যন্ত গিয়ে তা পৌঁছেছে। ইতোমধ্যে দূষণের তীব্রতা রোধে শিল্পমন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটি সুপারিশ করেছে, পরিবেশ ছাড়পত্র না পাওয়া পর্যন্ত শিল্পনগরী বন্ধ রাখতে। পরিবেশ মন্ত্রণালয়ও তাতে সম্মত হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, শিল্পনগরী পুরোপুরি প্রস্তুত না করে কেন ট্যানারিশিল্প স্থানান্তর করা হলো? ইতোমধ্যে ধলেশ্বরী, বংশী নদীসহ পুরো এলাকায় যে ক্ষতি সাধিত হয়েছে, তার দায়দায়িত্ব কে নেবে?
শিল্পনগরীতে ধীরে ধীরে কারখানার সংখ্যা বাড়তে থাকায় দূষণের মাত্রাও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। ট্যানারির বিষাক্ত গ্যাস, তরল বর্জ্য ও দুর্গন্ধে আশপাশের পুরো পরিবেশ বাসঅযোগ্য হয়ে পড়েছে। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, সেখানে কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজ এখনো শেষ হয়নি। কোটি কোটি টাকা খরচ করে সিইটিপি কেন পুরোপুরি কার্যকর হচ্ছে না, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সক্ষমতা অর্জিত হচ্ছে না, তা জরুরি ভিত্তিতে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন। শিল্পনগরীতে স্থাপিত অনেক ট্যানারির যথাযথ পরিবেশ ছাড়পত্র নেই বলে অভিযোগ রয়েছে। কয়েকটি ট্যানারি পরিবেশ ছাড়পত্র নিলেও বেশিরভাগই ছাড়পত্র নেয়নি। এতে ট্যানারির বর্জ্য যেভাবে খুশি সেভাবে ফেলা হচ্ছে। এসব ট্যানারি থেকে প্রতিদিন ৪০ হাজার ঘনমিটার বর্জ্য উৎপাদিত হচ্ছে। কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারের শোধনের সক্ষমতা রয়েছে ২৫ হাজার ঘনমিটার। এ হিসেবে, দৈনিক ১৫ হাজার ঘনমিটার বর্জ্য অপরিশোধিত অবস্থায়ই ধলেশ্বরী নদী ও আশপাশে গিয়ে পড়ছে। স্থানীয় লোকজন জানিয়েছে, মিষ্টি পানির উৎস ধলেশ্বরী ও বংশী নদী এক সময় কৃষিকাজ ও জেলেদের জীবিকার অন্যতম উৎস ছিল। এর পানি গোসলসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হতো। ট্যানারির বিষাক্ত বর্জ্যরে কারণে নদী দুটি দূষিত হয়ে পড়ায় পানি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এমনকি বুড়িগঙ্গার মতোই নদী দুটিতে এখন আর মাছ পাওয়া যায় না। এলাকাবাসী বলেছে, এক নদী বাঁচাতে গিয়ে দুই নদী মেরে ফেলা হচ্ছে। দূষণ বন্ধ করা না গেলে এ অঞ্চলের কৃষকরা জীবিকা হারিয়ে ফেলবে। ট্যানারি থেকে উৎপাদিত কঠিন, তরল ও বায়বীয়-এই তিন ধরনের বিষাক্ত বর্জ্যরে কারণে সেখানের পুরো জনপদ এখন অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। এসবই হচ্ছে, অপরিকল্পিত কর্মকা-ের কারণে। ট্যানারি শিল্প স্থানান্তরের শুরুতেই অপরিকল্পিত ও অসম্পূর্ণ হওয়া নিয়ে পরিবেশবিদরা প্রতিবাদ করেছেন। এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া নিয়ে পত্র-পত্রিকায় প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়েছে এবং হচ্ছে। তবে এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোনো টনক নড়েনি। সেখানের বংশী নদী রক্ষায় উচ্চ আদালত আদেশ দিলেও তা প্রতিপালন করা হয়নি। সেখানের ট্যানারি মালিকরা অভিযোগ করে বলেছেন, খরচ বাঁচাতে সিইটিপি বন্ধ রেখে তরল বর্জ্য বংশী নদীতে ফেলা হচ্ছে। এমন অনিয়মের ফলে পুরো পরিবেশই বিষাক্ত হয়ে গেছে।
যেকোনো শিল্পনগরী গড়ে তোলার আগে তার সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা অপরিহার্য। পরিবেশ ও মানুষের জীবনজীবিকার উপর কী ধরনের ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে, তা যথাযথ পরীক্ষা-নিরীক্ষা, সমীক্ষা এবং পর্যবেক্ষণ করে স্থাপন করতে হয়। শিল্পনগরী বিশেষ করে ট্যানারির মতো অধিক বিষাক্ত শিল্পনগরী গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অধিক সতর্ক ও সচেতনতা বাধ্যতামূলক থাকতে হয়। সাভারের ট্যানারি শিল্পনগরী গড়ে তোলার শুরু থেকেই এসব সতর্কতার ব্যত্যয় ঘটেছে। নানা অনিয়ম ও অসর্তকতার মধ্যেই স্থানান্তর করা হয়েছে। তার বিষময় ফলাফল এখন দেখা যাচ্ছে। এ সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটিও এখন শিল্পনগরীটি আপাতত বন্ধ করে দেয়ার সুপারিশ করেছে। পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ হলে এ ধরনের সুপারিশ করা হয়, সেটা সহজেই অনুমেয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্যানারি বন্ধ করে দেয়া কোনো সমাধান হতে পারে না। মাথাব্যাথার জন্য মাথা কেটে ফেলা সঙ্গত নয়। সমস্যার সমাধানের দিকে নজর দিতে হবে। কেন ও কি কারণে সমস্যার সমাধান হচ্ছে না, তা খতিয়ে দেখতে হবে। নদী ও পরিবেশের যে ক্ষতি হচ্ছে, তা প্রতিরোধে অবিলম্বে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। কোনো ধরনের বিষাক্ত ট্যানারি বর্জ্য যাতে নদীতে না পড়ে এবং পরিবেশ দূষণ না করে, সে ব্যবস্থা করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন