নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের পূর্বাচল নতুন শহরের ৪ নম্বর সেক্টরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ এক্সিবিশন সেন্টরে বসেছে ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলার ২৬তম আসর। এর আগে ১লা জানুয়ারি গত শনিবার সকালে বাণিজ্যমেলার উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর থেকে ক্রমেই স্টলগুলো পণ্যে পরিপূর্ণ হতে থাকে। বাড়তে থাকে দর্শনার্থী ও ক্রেতা বিক্রেতার-ভিড়। তবে কর্তৃপক্ষের নজরদারি কম থাকায় খাবার হোটেল ও বিভিন্ন পণ্যের দাম রাখা হচ্ছে আকাশছোঁয়া। বাইরের বাজারের তুলনায় বাণিজ্য মেলার অভ্যন্তরীণ সব খাবারের দাম বেশি রাখায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন দর্শনার্থীরা।
সরজমিন ঘুরে দেখা যায়, মেলা উদ্বোধন হওয়ার ৪র্থ দিনেও প্রস্তুত হয়নি বেশ কয়েকটি স্টল। তবে পণ্য পরিপূর্ণ করে রাখা হয়েছে বেশির ভাগ স্টলেই। ফলে দর্শনার্থীরা তাদের চাহিদামতো পণ্য ক্রয়ে স্টলে স্টলে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। শুরুতে খুব একটা বেচাকেনা না হলেও দর্শনার্থীরা রসনাবিলাস কিংবা ক্ষুধা নিবারনে দারস্থ হচ্ছেন প্যাভিলিয়নে থাকা খাবার স্টলে। আর সেই সুযোগে অভ্যন্তরীন স্টলে দাম রাখা হচ্ছে আকাশ ছোঁয়া।
মধূখালীর বাসিন্দা দর্শনার্থী মাহিরা তাসফি প্রভা জানান, আমাদের ভুলতা গাউছিয়া মার্কেটে উন্নত খাবার হোটেলে একপিছ গ্রিল ও পারোটা যেখানে মাত্র ১শ’ টাকা রাখে সেখানে বাণিজ্য মেলায় ২৭০ টাকা করে রাখছে। প্রায় ৩গুন দাম দিয়ে পরিবারের সবাইকে নিয়ে কিনে খেতে হচ্ছে। এতে চরমভাবে ভোক্তা অধিকার ক্ষুন্ন হচ্ছে।
পিতলগঞ্জের বাসিন্দা মোবারক হোসাইন বলেন, বাণিজ্যমেলায় স্টল পেতে অতিরিক্ত টাকা গুনতে হয়েছে। তাই ক্রেতাদের কাছ থেকে বেশিদাম আদায় করা হচ্ছে। এতে সাধারণ লোকজন ঘুরতে গিয়ে হয়রানীর শিকার হচ্ছেন।
অভিযোগ রয়েছে এক শ্রেণির দালালরা রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো ইপিবি থেকে নির্ধারিত মূল্যে দোকান বরাদ্দ নিয়ে দ্বিগুন মূল্যে বিদেশি ব্যবসায়ী ও দেশি ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করছেন। এতে দোকান পেতে অতিরিক্ত টাকা খরচ হওয়ায় ওই টাকা তুলতে বেশি দাম রাখার সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে ব্যবসায়ীরা। এমন এক ব্যবসায়ী মিঠাই নামীয় ফাস্টফুড জাতীয় খাবার বিক্রেতা কোম্পানীর স্টলে সাধারণ মানসম্মত বাজারে ৫০ টাকা মুল্যের প্যাট্টিস রাখা হচ্ছে ৮০ টাকা, ব্রয়লার মুরগী দিয়ে তৈরি ৩ খন্ডের সাসলিকের দাম বাইরের বাজারে ৫০ টাকা হলেও ওখানে রাখা হচ্ছে ৮০ টাকা। একইভাবে বার্গার, পিৎজাসহ সব খাবারের দাম রাখা হচ্ছে আকাশ ছোঁয়া। অনেকটা সাধারণের নাগালের বাইরে।
এ বিষয়ে মিঠাই এর কোনো কর্মকর্তা মন্তব্য করতে না চাইলেও নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক কর্মচারী জানান, এখানে স্টল পেতে বেশি খরচ হয়েছে। ওই টাকা তুলতে মনগড়া দাম নেয়া ছাড়া উপায় নেই। পাশেই দেখা গেছে জান্নাতি তেহারী নামীয় অপর একটি প্রতিষ্ঠান। ওই প্রতিষ্ঠানে সাধারণ বাজারের পাকিস্তানী মুরগী দিয়ে করা মোরগ পোলাওর এর দাম যেখানে ১শ’ থেকে দেড়শত টাকা। ওই মেলার স্টলে রাখা হচ্ছে ২৫০ টাকা। একইভাবে পাশের পূর্বাচল রেস্টুরেন্ট নামীয় প্রতিষ্ঠানে এ পিছ কোয়াটার গ্রিল ও ১টি নান রুটির দাম রাখছে ২৭০ থেকে ৩৫০ টাকা। এভাবে প্রতিটি খাবার হোটেল এমনকি কাপড়সহ নানা পণ্যে দাম রাখা হচ্ছে সাধারণ বাজারের তুলনায় দ্বিগুনেরও বেশি।
নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক ব্যবসায়ীদের দাবি, এছাড়া বাণিজ্যমেলায় আগত স্টল কর্মকর্তা, কর্মচারীদের আবাসিক সুবিধা নিতে পূর্বাচলের আশেপাশে দুইকক্ষের ৫ হাজার টাকার ফ্ল্যাটের ভাড়ার নেওয়া হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা। যা কিনা রাজধানীর গুলশান, বনানী ও উত্তরাসহ বিভিন্ন আভিজাত এলাকা থেকেও অনেক বেশি। এসব অতিমুল্যের ক্ষতিপূরণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট গড়তে বাধ্য হয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশ রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইবিপি) সূত্র জানায়, এবারের বাণিজ্য মেলায় মোট ২২৫টি দোকান বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। স্কয়ার ফুট হিসেবে একেক দোকানের মূল্য একেক রকম ধরা হয়েছে। তবে বাণিজ্যমেলার ভেতরের ২০ স্কয়ার ফুট দোকান গুলো ৩ লাখ টাকার কাছাকাছি বা তার একটু বেশি দামে ১ মাসের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। আর ১০ স্কয়ার ফুটের দোকান গুলো বরাদ্দ হয়েছে দেড় থেকে দুই লাখ টাকায়। ফলে দালাল চক্রের মাধ্যমে ওই স্টল অন্য কাউকে বরাদ্দ দিয়ে থাকলে তাতে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্থ হবে।
সরজমিন ঘুরে আরো দেখা যায়, পুরো মেলায় বিভিন্ন ক্যাটাগরীর মোট ২৩টি প্যাভিলিয়ন, ২৭টি মিনি প্যাভিলিয়ন, ১৬২টি স্টল, ১৫টি ফুট স্টল দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এবছর দক্ষিণ কোরিয়া, ইরান, টার্কি, ভারত, থাইল্যান্ড, তুরস্কসহ ১১টি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
এদিকে হাতিম ফার্ণিচার মার্টের মেলায় দায়িত্বরত ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম বলেন, তিনি গত ১১ বছর ধরে বাণিজ্যমেলায় এসে ব্যবসা করছেন। তবে এবার পূর্বাচলে ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার আসর বসায় তারা কিছুটা হয়রানীর শিকার হচ্ছেন। এবারের আসরে তারা কাশ্মীর থেকে ২’শ জন লোক এসেছেন। তবে তিনি সরাসরি ইপিবির কাছ থেকে ১০ স্কয়ার ফুটের দুইটি দোকান বরাদ্দ নিয়েছেন। প্রতিটির মূল্য পড়েছে ২ লাখ ৫ হাজার টাকা। তবে সাথের অনেক ব্যবসয়ীরাই দোকান বরাদ্দ না পেয়ে বাধ্য হয়ে অধিক মূল্যে দালালদের কাছ থেকে দোকান কিনেছে। যার মূল্য পড়েছে ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা। ফলে এখান থেকে ক্ষতি কাটিয়ে ওঠতে কিছু দাম না বাড়ালে উপায় নেই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাণিজ্য মেলায় দায়িত্বরত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাকারী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্যট ও রূপগঞ্জ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আতিকুল ইসলাম জানান, খাবার পণ্যে কিংবা সাধারণ পণ্যে অতিরিক্ত দাম রাখা কিংবা ভেজাল প্রতিরোধে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। শুরুতে হয়তো কার্যকারিতা তেমন ছিলো না। এখন স্টলগুলো পরিপূর্ণ হচ্ছে। মেলা জমতে শুরু করেছে। ভোক্তা অধিকারসহ সকল বিভাগ সমানভাবে নজরদারি অব্যাহত রাখবো।
এ ব্যাপারে ইপিবির সচিব ও বাণিজ্য মেলার পরিচালক ইখতেখার আহমেদ চৌধুরী জানান, বিদেশি ব্যবসায়ীরা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ না করে দালালদের কাছ থেকে দোকান কিনবে কেন এমন প্রশ্নের উত্তর নেই। এটি সম্পূর্ণ তাদের দোষ। গত একমাস আগে স্টল বরাদ্দের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। তাদের উচিত ছিল আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে দোকান নেওয়া। অন্যদিকে ভোক্তা অধিকার রক্ষায় বাণিজ্য মেলা অভ্যন্তরীন ২টি ভ্রাম্যমাণ আদালত সচল রয়েছে। তাদের কাছে কোন দর্শনার্থী ও ক্রেতা অভিযোগ করলে তাৎক্ষণিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এসব নিয়ন্ত্রণে গতকাল ৪ জানুয়ারি দুপুরে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে বৈঠক হয়েছে। সেখানে ব্যবসায়ীরা যাতে কোন সিন্ডিকেট গড়ে ভোক্তা অধিকার ক্ষুন্ন করতে না পারে সে বিষয়ে কঠোর নজরদারি রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন