শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

উপ সম্পাদকীয়

সংবিধান, মোশতাকের প্রেসিডেন্সি এবং ৩রা নভেম্বরের রুদ্ধশ্বাস কাহিনী-(১)

প্রকাশের সময় : ১ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মোবায়েদুর রহমান
আজ পহেলা নভেম্বর মঙ্গলবার। একদিন পর ৩রা নভেম্বর। ৩রা নভেম্বর থেকে পরবর্তী পাঁচ দিন, অর্থাৎ ৩রা নভেম্বর থেকে ৭ই নভেম্বর বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি টার্নিং পয়েন্ট। আরো একটু পেছনে গেলে দেখা যায়, বাংলাদেশের ঘটনাবলি মারাত্মক বাঁক নিতে শুরু করেছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে নভেম্বরের ৩ তারিখ। নভেম্বরের ৩ তারিখ থেকে ৭ই নভেম্বরÑ বাংলাদেশের রাজনীতি, আদর্শ এবং ইতিহাসের মোড় ঘুরে যায়। এসব ঘটনাবলি এক একটি রাজনৈতিক দল এক একটি দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করেছে। একটি স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক দেশে ব্যাখ্যার ভিন্নতা থাকতেই পারে। কিন্তু সে ব্যাখ্যার মাঝে যেন মূল ঘটনাবলি হারিয়ে না যায়, ইতিহাস এবং ঘটনাবলির বিকৃতি যাতে না ঘটে সেদিকে তীক্ষè নজর দিতে হবে সমাজবিজ্ঞানী এবং ইতিহাসবেত্তাদের। এসব বিষয়ে অতীতে আমি বহুবার লিখেছি। আজকের লেখায় সেগুলোর কিছুটা পুনরাবৃত্তি থাকবে। তার পরেও সেই ঘটনাবলি নিয়ে লিখছি। কারণ এসব ঘটনা ঘটেছিল আজ থেকে ৪১ বছর আগে। অর্থাৎ আজ যার বয়স ৪০ বছর তখন অর্থাৎ এসব ঘটনা ঘটার সময় তার জন্মই হয়নি। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের সময় যার জন্ম হয়েছিল তাদের বয়স তখন ছিল ৩ বছর ৮ মাস। সুতরাং তাদেরও এসব ঘটনাবলি ভালোভাবে জানার কথা নয়। শুধুমাত্র ভালোভাবে জানলেই চলবে না, সঠিক ব্যাকগ্রাউন্ডও জানতে হবে। সে জন্যই কিছু কিছু ক্ষেত্রে অতীত ঘটনাবলির পুনরাবৃত্তির প্রয়োজন।
বাংলাদেশে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটেছিল চারটি। যারা ১৫ই আগস্ট ঘটিয়েছিলেন তারা এটিকে সামরিক অভ্যুত্থান হিসেবে দাবি করেন। তবে এর মধ্যে ১৫ আগস্ট সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ চূড়ান্ত রায় দিয়েছেন। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে এটিকে হত্যাকা- বলা হয়েছে। এই আলোকে বলা যায় যে, বাংলাদেশে সামরিক আইন জারি হয় ৩ বার এবং ৪ জন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক (সিএমএলএ) ক্ষমতায় আসেন। রেকর্ড থেকে দেখা যায় যে, খন্দকার মোশতাক আহমেদ নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক (সিএমএলএ) হিসেবে ঘোষণা করেননি। যাই হোক, সর্বোচ্চ আদালতের রায় মোতাবেক এটি যেহেতু হত্যাকা- হিসেবে ঘোষিত হয়েছে তাই সেটি আর আজকের আলোচনায় আনছি না।
ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যাচ্ছে, ১৫ আগস্ট খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে যে সরকার গঠিত হয়েছিল সেটি সংবিধান সম্মত ছিল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও ইতিহাস থেকে এটিও দেখা যাচ্ছে যে, সেই সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছিল ভারত এবং আমেরিকাসহ পৃথিবীর সমস্ত রাষ্ট্র। উচ্চ আদালতের রায়ে ক্ষমতার অবৈধ দখলদারদের তালিকায় এসেছে চারটি নাম। সেই চারটি নাম হলোÑ খন্দকার মোশতাক আহমেদ, প্রধান বিচারপতি সায়েম, জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। বিচারপতি সায়েম দৃশ্যপটে এসেছেন ১৯৭৫ সালের ৬ নভেম্বর সন্ধ্যা রাতে। জেনারেল জিয়া দৃশ্যপটে এসেছেন ৭ই নভেম্বর দিনের বেলায়। কিন্তু মাঝখানে একটি ছোট্ট সময় রয়ে গেছে। দেখা যাচ্ছে যে, সেই সময়টি মহামান্য আদালতের সুদীর্ঘ ও সারগর্ভ রায় থেকে হারিয়ে গেছে। ইতিহাসকে তার সঠিক অবস্থানে ফিরিয়ে আনার জন্য এই হারিয়ে যাওয়া সময়টুকু পুনরুদ্ধার করতে হবে।
১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর থেকে ৭ই নভেম্বরÑ এই সাড়ে ৫ দিনের একেবারে শুরুতেই ঘটেছে আরেকটি সামরিক অভ্যুত্থান, এসেছে একটি সামরিক শাসন, যে অভ্যুত্থানের কথা আমাদের অতি সাম্প্রতিককালে রচিত ইতিহাস থেকে হারিয়ে গেছে। আসুন, এবার ৪১ বছর পেছনে ফিরে যাই এবং ৪১ বছর আগের অতীত খুঁড়ে ছোট্ট ইতিহাসটিকে টেনে বের করে আনি।
॥ দুই ॥
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট একটি রক্তাক্ত অভ্যুত্থানের মাধ্যমে যখন আওয়ামী লীগের প্রথম সরকারের পতন ঘটে তখন কিন্তু জেনারেল জিয়া বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন না। তখন সেনাবাহিনী প্রধান ছিলেন জেনারেল শফিউল্লাহ। কর্নেল সাফায়াত জামিল ছিলেন ঢাকার ব্রিগেড কমান্ডার। ওই অভ্যুত্থান ঠেকানোর মূল দায়িত্ব ছিল কিন্তু সেনাপ্রধান এবং ঢাকার ব্রিগেড কমান্ডারের ওপর। ইতিহাসকে তার সঠিক অবস্থানে রাখার জন্য উল্লেখ করা দরকার যে, খন্দকার মোশতাক সামরিক শাসন জারি করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু সংবিধান স্থগিত করেননি এবং জাতীয় সংসদও ভেঙে দেননি। আগেই বলেছি যে, তিনি নিজেকে সিএমএলএ হিসেবে ঘোষণা করেননি। ডামি হিসেবে মোশতাককে সামনে রাখা হয়। তার পেছনে আসল শক্তি ছিলেন কর্নেল ফারুক, কর্নেল রশিদ ও মেজর ডালিমসহ ১৭ জন কর্নেল ও মেজরের গ্রুপটি।
৮৩ দিন খন্দকার মোশতাক আহমেদ ক্ষমতায় ছিলেন। এই ৮৩ দিনের মধ্যে একদিনও তিনি ঢাকার বাইরে বের হননি। অষ্টপ্রহর বঙ্গভবনে তিনি সাঁজোয়া বাহিনী দ্বারা পরিবষ্টিত ছিলেন। সেনাবাহিনীর অপেক্ষাকৃত জুনিয়র অফিসারদের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা থাকায় সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনীতে অসন্তোষ ধূমায়িত হতে থাকে। এই পুঞ্জীভূত ধূমায়িত অসন্তোষের বিস্ফোরণ ঘটে ওই বছর অর্থাৎ ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বরের পাল্টা অভ্যুত্থানে। কিন্তু এটিও কোনও সুপরিকল্পিত অভ্যুত্থান ছিল না। ১৯৯০ সালের ৭ই নভেম্বর দৈনিক ‘ইনকিলাবে’ প্রকাশিত একটি রচনা থেকে জানা যায়, একটি পাল্টা অভ্যুত্থানের খবর ১৯৭৫ সালের ১৭ অক্টোবর থেকেই উচ্চ পর্যায়ে ভেসে বেড়াতে থাকে। এমনকি পাল্টা অভ্যুত্থানের দুই দিন পূর্বে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট খোন্দকার মোশতাক আহমেদের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা জেনারেল ওসমানী ও তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে এই ষড়যন্ত্রের কথা জানানো হলে তারা তা বিশ্বাস করেননি।
৩ নভেম্বর গভীর রাতে পদাতিক বাহিনীর একাধিক ইউনিট বঙ্গভবন অভিমুখে মার্চ করে। পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটতে যাচ্ছে, সেটি টের পেয়ে ট্যাংক রেজিমেন্টের একটি ইউনিট সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পজিশন নেয়। এভাবে পদাতিক বাহিনীর কয়েকটি ইউনিট এবং ট্যাংক রেজিমেন্ট মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়ায়। কর্নেল ফারুকের ইউনিটও নাকি পাল্টা জবাব দেয় যে, তারাও প্রয়োজনে ট্যাংক থেকে গোলাবর্ষণ করবে। বলাবাহুল্য, পাল্টা অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ এবং কর্নেল সাফায়াত জামিল। এটিই ছিল পাল্টা অভ্যুত্থান বা প্রতিবিপ্লব। এটির নেতৃত্বে ছিলেন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ। ক্ষমতা গ্রহণের পর তিনি দেশে সামরিক আইন জারি করেন, সংবিধান বাতিল করেন এবং জাতীয় সংসদ ভেঙে দেন, নিজেকে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত করেন এবং নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বা সিএমএলএ ঘোষণা করেন।
এভাবে সেনা এবং বিমানবাহিনীর একাধিক ইউনিট যখন মুখোমুখি অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে তখন সেনাবাহিনী এবং নাগরিক সমাজের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন। তারা বিলক্ষণ বুঝতে পারেন যে, যদি সশস্ত্র বাহিনীর বিবদমান ইউনিটগুলোকে সংযত করা না যায় তাহলে ভয়াবহ রক্তপাত ঘটবে। এমন একটি পরিস্থিতিতে কর্নেল ফারুক এবং খালেদ মোশাররফের মধ্যে নেগোসিয়েশন শুরু হয়। তখন জনশ্রুতি ছিল যে, তৎকালীন নৌবাহিনী প্রধান রিয়াল অ্যাডমিরাল এম এইচ খান এবং বিমান বাহিনী প্রধান এম জি তাওয়াব রক্তাক্ত সংঘর্ষ পরিহারের জন্য কর্নেল ফারুক-রশীদ গ্রুপ ও খালেদ-জামিল গ্রুপের মধ্যে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে দূতিয়ালি করেন। তাদের মধ্যেকার আলাপ-আলোচনা শেষে যে ফয়সালা হয় সেটি ছিল নিম্নরূপ ঃ
মোশাররফ ও জামিলের ইউনিট ফারুকদের ইউনিটকে আক্রমণ করবে না। বিনিময়ে ফারুক গ্রুপ দেশের বাইরে চলে যাবে। তবে তারা যেন নিরাপদে দেশের বাইরে যেতে পারেন, সেই গ্যারান্টি দিতে হবে খালেদ মোশাররফকে। এই ফয়সালা মোতাবেক একটি বিশেষ বিমানে ফারুক-রশিদ গ্রুপকে ব্যাংকক পাঠিয়ে দেয়া হয়। ওই সময় বাজারে এ মর্মে গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল যে, যাতে করে ওয়াদা ভঙ্গ করা না হয় সে জন্য ওয়ার্ড অব অনার হিসেবে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের স্ত্রী ওই বিমানে ফারুক-রশিদদের সহযাত্রী হবেন। ব্যাংককে ফারুক গ্রুপ নিরাপদে অবতরণ করেন এবং সেই সময়কার গুঞ্জন মোতাবেক বেগম খালেদ মোশাররফও নিরাপদে দেশে ফিরে আসেন। এই গুঞ্জন কতদূর সত্য ছিল সেটি আমরা কনফার্ম করতে পারিনি।
এরপর তিন দিন কেটে যায়। এই তিন দিন বাংলাদেশে কার্যত কোনো সরকার ছিল না। খন্দকার মোশতাক নামকাওয়াস্তে প্রেসিডেন্ট ছিলেন। কিন্তু কার্যত তিনি ছিলেন কর্নেল সাফায়াত জামিলের নিয়ন্ত্রণাধীন জওয়ানদের হাতে চার দেয়ালের মাঝে বন্দি। (পরবর্তী কিস্তি আগামী মঙ্গলবার ৮ নভেম্বর ২০১৬)।
Journalist15@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন