অনেক কাঠ-খর পুড়িয়ে পাওয়া একাদশ। পরীক্ষা-নীরিক্ষা আর কাটাছেঁড়ার পর যেন কষ্টিপাথরে পরখ করা এক একাদশ। আর তাতে টেস্ট ক্রিকেটে দীর্ঘ দিন পর স্বর্ণালী এক দিনই পেল বাংলাদেশও। মাহমুদুল হাসান জয়কে নিয়ে তামিম ইকবাল কাটালেন দীর্ঘ ওপেনিং খরা, নিজে পেলেন বহুল প্রতীক্ষিত শতক, অনুজ জয় তুলে নিলেন ফিফটি। মাঝে খেই হারানো দ্বিতীয় সেশনের পর দিনের শেষটা রাঙালেন মুশফিকুর রহিম ও লিটন দাস। তিন ফিফটি আর এক সেঞ্চুরিতে চট্টগ্রাম টেস্টের তৃতীয় দিনটা দারুণ কাটল বাংলাদেশের। গতকাল জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে গোটা দিনে খেলা হয়েছে ৮৮ ওভার, ৩ উইকেট হারিয়ে বাংলাদেশ যোগ করেছে ২৪২ রান।
তিন সেশনের দুটিতেই একচেটিয়া আধিপত্য দেখিয়েছে স্বাগতিকরা। সকালের সেশনে ২৮ ওভারে কোনো উইকেট না হারিয়ে তামিম ও জয় যোগ করেন ৮১ রান। পরের সেশনে ৩ উইকেট নিয়ে ঘুরে দাঁড়ায় শ্রীলঙ্কা। জয়ের বিদায়ে ১৬২ রানের উদ্বোধনী জুটি ভাঙার পর দ্রæত ফেরেন নাজমুল হোসেন শান্ত ও মুমিনুল হক। তবে শেষ সেশনে আর কোনো উইকেট হারাতে দেননি লিটন ও মুশফিক। এই সময়ে ৩৫ ওভারে আসে ৯৮ রান। দুই ব্যাটসম্যানই অপরাজিত আছেন ফিফটি করে। ক্র্যাম্পের জন্য চা-বিরতির পর ব্যাটিংয়ে নামেননি তামিম। ১৩৩ রান করা বাঁহাতি ওপেনারের জায়গায় ব্যাটিংয়ে নেমে লিটন দিন শেষে ১১৩ বলে ৮ চারে ৫৪ রানে অপরাজিত আছেন। ১৩৪ বলে ২ চারে ৫৩ রানে খেলছেন মুশফিক। চতুর্থ উইকেটে এই দুজনের অবিচ্ছিন্ন জুটির রান ৯৮। বাংলাদেশ পিছিয়ে আর ৭৯ রানে, হাতে উইকেট ৭টি।
তৃতীয় দিনেও উইকেট ছিল যথেষ্ট ব্যাটিং সহায়ক। খুব বেশি সুযোগ তৈরি করতে পারেননি শ্রীলঙ্কার বোলাররা। এর মধ্যে ক্যাচ ফেলার মাশুলও দিতে হয়েছে তাদের। বিশ্ব ফার্নান্দোর ‘কনকাশন সাব’ হিসেবে সুযোগ পেয়ে এদিন ২ উইকেট নেন কাসুন রাজিথা। মোটাদাগে এই ছিল গতকাল সাগরিকার ‘সারাংশ’। তবে সত্যিই কি এত ছোট দাগে বর্ণনা করা গেল দিনটির মাহাত্ব্য!
আগের দিন কোনো উইকেট না হারিয়েই দিনের খেলা শেষ করেছিল বাংলাদেশ। জয় আর তামিম তাদের উদ্বোধনী জুটিকে তৃতীয় দিনে টেনে নিলেন ১৬২ রান পর্যন্ত। জয় ফিফটি করে থামলেও তামিম তুলে নিলেন টেস্ট ক্যারিয়ারের দশম সেঞ্চুরি। হাতে পেশিতে টান লাগায় তিনি মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার পর দৃঢ়তা দেখালেন মুশফিকুর ও লিটন । শেষ সেশনে দুজনই হাফসেঞ্চুরি হাঁকিয়ে অবিচ্ছিন্ন থাকায় শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে শক্ত অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ দল।
চট্টগ্রামে সিরিজের প্রথম টেস্টের তৃতীয় দিনশেষে বাংলাদেশের সংগ্রহ ৩ উইকেটে ৩১৮ রান। অভিজ্ঞ মুশফিক ১৩৪ বলে ৫৩ ও সা¤প্রতিক সময়ে ছন্দে থাকা লিটন ১১৩ বলে ৫৪ রানে ক্রিজে আছেন। তাদের জুটির সংগ্রহ ২১১ বলে ৯৮ রান। এর আগে টস জিতে ব্যাটিংয়ে নামা শ্রীলঙ্কার প্রথম ইনিংস থেমেছিল ৩৯৭ রানে। ফলে হাতে ৭ উইকেট নিয়ে তাদের চেয়ে মাত্র ৭৯ রানে পিছিয়ে আছে টাইগাররা।
২১৭ বলে ১৫ চারে ১৩৩ রান করে আহত অবসরে গেছেন তামিম। সবমিলিয়ে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের এটি তার ২৫তম সেঞ্চুরি। চা বিরতির পর আর মাঠে নামেননি তিনি। ম্যাচের পরিস্থিতি বুঝে সেরে উঠে পরে কোনো এক সময় ব্যাট হাতে দেখা যেতে পারে তাকে। ১৬ ইনিংস পর ফের তামিম পেয়েছেন এই রাজকীয় স্বাদ। এর আগে ২০১৯ সালের ফেব্রæয়ারিতে হ্যামিল্টনে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তিনি খেলেছিলেন ১২৬ রানের ইনিংস। তামিমের অসাধারণ ব্যাটিংয়ে টেস্টে এদিন পাঁচ বছর পর ওপেনিংয়ে শতরানের জুটি দেখেছে বাংলাদেশ। সবমিলিয়ে ৬১ ইনিংস পর এসেছে শতরানের উদ্বোধনী জুটি। সবশেষ ২০১৭ সালের মার্চে এই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষেই গলে ১১৮ রানের ওপেনিং জুটি গড়েছিলেন তামিম ও সৌম্য সরকার।
সাগরিকায় দিনের প্রথম সেশনে ২৮ ওভার খেলে বাংলাদেশ কোনো উইকেট না হারিয়ে তোলে ৮১ রান। দ্বিতীয় সেশনে বাংলাদেশ হারায় ৩ উইকেট। যার দুটোই নিয়ে নেন কনকাশন বদলি হিসেবে নামা পেসার কাসুন রাজিথা। ২৫ ওভারে বাংলাদেশ আনে ৬৩ রান। চা বিরতির পর আর কোনো বিপদ ঘটতে দেননি মুশফিক ও লিটন। বিনা উইকেটে ১৫৭ রান নিয়ে লাঞ্চের পর নেমে আর ৫ রান যোগ করতেই প্রথম ধাক্কা খায় স্বাগতিকরা। জয়কে লেগ স্টাম্প বরাবর বাউন্সার দিয়ে আউট করার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন আসিথা ফার্নান্দো। লাঞ্চের আগে একবার ক্যাচ দিয়েও বেঁচে গিয়েছিলেন তিনি। বাউন্সারের এই ফাঁদই পরে ইতি টানে তার ইনিংসের। লেগ স্টাম্পের বেশ বাইরের বলে ব্যাট লাগিয়ে উইকেটের পেছনে ধরা দেন ১৪২ বলে ৯ চারে ৫৮ রান করা জয়।
তামিমের ব্যাট ছিল ছন্দময়। সেঞ্চুরি বের করতে তেমন একটা সময় নেননি তিনি। ১৬২ বলে ১২ চারে তিন অঙ্ক স্পর্শ করেন বাংলাদেশের সফলতম ওপেনার। সেঞ্চুরির পর গতি কিছুটা কমিয়ে আনেন তিনি, মন দেন টিকে থাকায়। অফ স্পিনার রমেশ মেন্ডিসের বলে আম্পায়ার তাকে আউট দিলেও রিভিউ নিয়ে রক্ষা পান তিনি। পরে পানিশ‚ন্যতায় পেশিতে টান লাগলে বিশ্রাম নিয়ে চাঙা হতে হয় তাকে।
তিনে নামা শান্ত প্রথম কয়েক বলে ছিলেন অতিরিক্ত ‘শান্ত’। বেশ ভালো উইকেটেও রান বের করতে ধুঁকতে থাকেন এই বাঁহাতি। তিনি আউট হন বেশ দৃষ্টিকটুভাবে। রাজিথার অফ স্টাম্পের অনেক বাইরের বল তাড়া করে ধরা দেন উইকেটরক্ষক নিরোশান ডিকভেলার গøাভসে। ২২ বলে ১ রানে শেষ হয় তার ইনিংস। মুমিনুল হক ক্রিজে ছিলেন না সাবলীল। গত কয়েক টেস্ট ধরে রান খরায় ভুগতে থাকা বাংলাদেশ অধিনায়ক নেমেছিলেন নিজের প্রিয় মাঠে। ক্যারিয়ারের ১১ সেঞ্চুরির সাতটি তিনি করেছেন এই সাগরিকায়। প্রিয় মাঠের মতো প্রতিপক্ষও ছিল প্রিয়। লঙ্কানদের বিপক্ষেই আছে তার চার সেঞ্চুরি। তবে এতকিছু পক্ষে থাকলেও রান পাওয়া হয়নি মুমিনুলের। সময় নিয়ে থিতু হওয়ার চেষ্টা করলেও লাভ হয়নি। রাজিথার ভেতরে ঢোকা এক ডেলিভারি ভুলভাবে পড়ে ১৯ বলে ২ করে স্টাম্প খোয়ান তিনি।
প্রথমে তামিমের সঙ্গে জুটি গড়ে ২২ রানের মধ্যে ৩ উইকেট খোয়ানোর চাপ সামলান মুশফিক। এরপর সঙ্গী হিসেবে তিনি পান লিটনকে। সাদা পোশাকের ক্যারিয়ারে নিজের দ্বাদশ ফিফটির স্বাদ নিয়েছেন লিটন। বছরের শুরুতে ক্রাইস্টচার্চে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে দ্বিতীয় ইনিংসে সেঞ্চুরির পর আবার পঞ্চাশ ছুঁলেন তিনি। মাঝে চার ইনিংসে সর্বোচ্চ ছিল ৪১।
কিছুক্ষণ পর ফিফটি দিয়ে মুশফিকও পৌঁছে যান একটি মাইলফলকে। ২৬তম টেস্ট হাফসেঞ্চুরি করে সাকিব আল হাসানের পাশে বসেছেন তিনি। ৩১টি ফিফটি করে চ‚ড়ায় আছেন তামিম।
সংক্ষিপ্ত স্কোর
শ্রীলঙ্কা ১ম ইনিংস : ৩৯৭
বাংলাদেশ ১ম ইনিংস : ১০৭ ওভারে ৩১৮ (আগের দিন ৭৬/০) (জয় ৫৮, তামিম ১৩৩ রিটায়ার্ড হার্ট, শান্ত ১, মুমিনুল ২, মুশফিক ৫৩*, লিটন ৫৪*; বিশ্ব ০/৪২, আসিথা ১/৫৫, রমেশ ০/৮৩, এম্বুলদেনিয়া ০/৩৯, ধনঞ্জয়া ০/৩৯, রাজিথা ২/১৭)।
তৃতীয় দিন শেষে
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন