‘দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জীবনের অর্ধেক সময় কাটে ফেরি ঘাটে’। স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাস্তব রূপ লাভের মধ্যে দিয়ে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার সাড়ে ৩ কোটি মানুষের দীর্ঘ ৬০ বছরের দূর্ভোগ আর বঞ্চনার সাথে এ প্রবাদেরও অবশান ঘটতে যাচ্ছে। শণিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধনের পরে রোববার সকাল থেকে সেতুটি যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হচ্ছে। ফলে বরিশাল ও খুলনা বিভাগ সহ ফরিদপুর অঞ্চলের ২১ জেলার সাথে রাজধানী সহ পদ্মার পূর্ব অংশের সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগেরও ফেরিবিহীন সরাসরি সড়ক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। অবশান ঘটছে বিগত প্রায় ষাট বছরের পদ্মায় ফেরি পারাপারের বিড়ম্বনার। দেশের সবগুলো বিভাগীয় সদর এবং দ্বীপজেলা ভোলা বাদে সবগুলো জেলার মধ্যে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করছে পদ্মা সেতু।
ষাটের দশকে আরিচা ও দৌলতদিয়ার মধ্যে তৎকালীন ‘পূর্ব পাকিস্তান শিপিং করপোরেশন’ কয়েকটি ‘স্মল টাইপ’ ও ‘মিডিয়াম টাইপ’ ফেরির মাধ্যমে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সড়ক যোগাযোগ চালু করে। কিন্তু সে ফেরি পারাপার খুব সুখকর ছিল না কখনোই। এমনকি পারপারের অভাবে ঘরমুখি বহু মানুষ নিকটজনের সাথে ঈদের নামাজ পর্যন্ত আদায় করতে পারতেন না। অনেক সময়ই ঘরমুখি মানুষ ফেরি ঘাটেই ঈদের জামাতে নামাজ আদায়ে বাধ্য হয়েছেন।
স্বধিনতার পরে উন্নয়ন সহযোগী ‘অক্সফাম’র কাছ থেকে ৭টি ‘কে-টাইপ’ ফেরি নিয়ে যানবাহন পারপারে কিছুটা গতি আসলেও এ বিশাল সড়ক পথে বিড়ম্বনার শেষ ছিলনা। ১৯৮০ সালে ডেনমার্কের সহায়তায় দেশে প্রথম দুটি ‘রোল অন রোল অফ ফেরি’ চালু হলে পরিস্থিতির কিছুটা ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটে। পরবর্তিতে দেশেই এধরনের একাধীক ফেরি তৈরী হয়। কিন্তু যানবাহনের বাড়তি চাপ সামাল দেয়া কখনো সম্ভব ছিলনা।
পরবর্তির্তে রাজধানীর সাথে দক্ষিণ ও দক্ষিণÑপশ্চিমাঞ্চলের দুরত্ব হ্রাস সহ সড়ক যোগাযোগ সহজতর করতে ১৯৭৭ সালে শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বরিশালÑফরিদপুর মহাসড়কের ভাঙ্গা থেকে চরজানাজাতÑমাওয়া হয়ে ঢাকা পর্যন্ত নতুন একটি মহাসড়ক নির্মান কাজ শুরু করেন। ১৯৮৩ সালে মাওয়া থেকে চরজানাজাত/কাওড়াকান্দীর মধ্যে পদ্মায় ফেরি সার্ভিসের মাধ্যমে ঐ মহাসড়কটি চালুও হয়।
১৯৮৮ সালের প্রলয়ঙ্কারী বণ্যায় ভাংগা থেকে চর জানাজাত পর্যন্ত মহাসড়কটির ব্যাপক ক্ষতির পরে ওপেক তহবিলে তার পূণর্বাশন সম্পন্ন হয়। পরবর্তিতে উন্নয়ন সহযোগী ‘ওপেক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এবং এনডিএফ’এর সহায়তায় ১ হাজার ১৫৬ কোটি টাকা ব্যায়ে খুলনাÑমোংলা মহাসড়কের টাউন নওয়াপাড়া থেকে গোপালগঞ্জ-ভাঙ্গা-মাওয়া হয়ে ঢাকা পর্যন্ত ১৬২.৩৯ কিলোমিটার দীর্ঘ মহাসড়ক পূণঃনির্মান ছাড়াও আড়িয়াল খাঁ নদের ওপর সেতু নির্মিত হয়। নির্মান শেষে ঐ মহাসড়কটি ২০০৫ সালের ১৫ মে আনুষ্ঠানিকভাবে উš§ুক্ত করা হয়। ওই মহাসড়কটি নির্মানের ফলে রাজধানীর সাথে বরিশাল ও খুলনার দুরত্ব প্রায় ১শ কিলোমিটার করে এবং যশোর ও বেনাপোলের দুরত্বও যথেষ্ঠ হৃাস পায়। এমনকি এ মহাসড়কটি নির্মানের ফলে ঢাকাÑঅরিচা মহাসড়কের ওপরও যানবাহনের চাপ প্রায় অর্ধেক হৃাস পায়।
কিন্তু দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সাথে রাজধানী সহ পদ্মার পূর্ব তীরের সংক্ষিপ্ত সড়ক নির্মিত হলেও এ অঞ্চলের মানুষের ঝুকি ও দূর্ভোগের শেষ ছিলনা খরশ্রোতা পদ্মা পারাপারের বিড়ম্বনার কারণে। শীত মৌসুমে নাব্যতা সংকট আর বর্ষাকালে খরশ্রোতা পদ্মায় পারপার সব সময়ই ছিল ঝুকিপূর্ণ ও দূর্ভোগের।
কিন্তু উপ মহাদেশের দীর্ঘতম এবং বিশে^র দ্বিতীয় খরশ্রোতা পদ্মায় সেতু চালুর মধ্যে দিয়ে রোববার সকাল থেকে এসব বিড়ম্বনার অবশান হতে যাচ্ছে। দক্ষিণাঞ্চলের সাড়ে ৩ কোটি মানুষ এখন সময় গুনছেন রোববার সকাল ৬টা কখন বাজবে।
তবে ভাংগার এক্সপ্রেসওয়ে ও পদ্মা সেতু হয়ে ২১ জেলার যানবাহন ঢাকা সহ পূর্বঞ্চলে যাবে, সে পর্যন্ত পৌছান এখনো যথেষ্ঠ বিড়ম্বনার। এ অঞ্চলের ২১ জেলার সাথে ভাংগা এক্সপ্রেসওয়েতে সংযুক্ত সবগুলো জাতীয় মহাসড়কই মাত্র ১৮-২৪ ফুট প্রস্থ। এমনকি একমাত্র ঢাকাÑভাংগাÑখুলনা মহাসড়কটি ছাড়া অন্য সবগুলো জাতীয় মহাসড়কই প্রায় ৬০ বছরের পুরনো। এসব মহাসড়ক ভারী যানবাহনের ভার বহনের সক্ষমতা নেই। এমনকি পদ্মা সেতু চালুর পরে এ অঞ্চলের মহাসড়কে যে বাড়তি চাপ পড়বে তার ব্যাবস্থাপনাও অনুপস্থিত। এমনকি এ অঞ্চলের সবগুলো জাতীয় মহাসড়কই ৬ লেনে উন্নীত করার নানা পরিকল্পনার কথা গত দশ বছর ধরে শোনা গেলেও তা এখনো কাগজেই সীমাবদ্ধ বলেও জানা গেছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন