মোহাম্মদ আবদুল গফুর : এ নিবন্ধ যখন লিখতে বসছি তখন আমার কনিষ্ঠ ভ্রাতৃতুল্য এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে। কয়েক দিন আগে বারডেম হাসপাতালে যখন তাকে দেখতে গিয়েছিলাম সে ছিল আইসিইউতে। বিশেষ অনুমতি নিয়ে তাকে দেখতে গেলে ক্ষীণ কণ্ঠে সে আমাকে অনুরোধ জানিয়েছিল, দোয়া করবেন। কেন যেন আমার মনে একটা আশা জেগেছিল, সে ভালো হয়ে উঠবে। কিন্তু পরে যা জেনেছি মনটা আবার খারাপ হয়ে গেল। শুনলাম তার অবস্থার অবনতি হয়েছে। সর্বশেষ জানতে পারলাম তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে। অর্থাৎ যে কোনো সময় তার সম্পর্কে আরও খারাপ খবর শুনতে হতে পারে।
স্বাভাবিকভাবেই মন খুব খারাপ। কেবলই মনে প্রশ্ন জাগছে, মানুষের জীবন কি এতই ঠুনকো? জীবনের কি কোনোই নিশ্চয়তা নেই? ঠিক-ঠিকানা নেই? আমার চেয়ে প্রায় বিশ বছরের ছোট হয়েও কি আমার আগেই না ফেরার দেশে চলে যেতে হচ্ছে তাকে?
তবুও এতে একটা সান্ত¦Íনা এই যে, মানুষের জীবনে অসুখ-বিসুখের মাধ্যমে মৃত্যুকে স্বাভাবিক মৃত্যু বলে বিবেচনা করা হয়। সর্বশেষ বিশ্ব পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক মৃত্যুর অধিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ মানবাধিকার বলে স্বীকৃতি পাচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের যেভাবে নির্মম গণহত্যা, গণধর্ষণ, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিয়ে বসতবাড়ি থেকে বিতাড়ন সহ বিভিন্ন ধরনের পৈশাচিক নির্যাতনের শিকার করা হচ্ছে তার সঙ্গে অন্য সব নির্যাতনের কোনো তুলনাই হয় না।
হাজার হাজার বছর ধরে যারা সাবেক বার্মার (বর্তমান মিয়ানমারের) আরাকান (বর্তমান রাখাইন) প্রদেশে বৈধ নাগরিক হিসেবে বসবাস করে আসছে, বার্মার সেনাবাহিনীর চোখে অকস্মাৎ কিছু দিন আগে থেকে তারা প্রতিভাত হলো অবৈধ নাগরিক হিসেবে। বলা হল, তারা নাকি মিয়ানমারের বাসিন্দা নয়, তারা বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশকারী অবৈধ নাগরিক।
রোহিঙ্গাদের যে সেনাবাহিনীর শাসনামলে রোহিঙ্গাদের অবৈধ নাগরিক হিসেবে এলজাম দেয়ার চেষ্টা করা হয়, সে সেনা শাসনামলে বার্মায় গণতন্ত্রও নিষিদ্ধ ছিল। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সমর্থন করার দায়ে অং সান সুচিকেও বন্দী রাখা হয়। সেই বন্দিত্বের বদৌলতে সে সময় অং সান সুচি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করে সারা বিশ্বে একজন লড়াকু গণতন্ত্রী নেতা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। পক্ষান্তরে বার্মা শাসনকারী তদানীস্তন সেনা সরকার সারা পৃথিবীতে নিন্দিত ও সমালোচিত হয়।
পরিস্থিতির প্রতিকূলতা লক্ষ্য করে একপর্যায়ে সেনাবাহিনী তাদের শাসন ব্যবস্থায় ক্রমান্বয়ে শিথিলতার পন্থা অবলম্বন করতে শুরু করে। গণতান্ত্রিক নেত্রী অং সান সুচির বন্দিত্বের অবসান ঘটিয়ে ক্রমান্বয়ে তার চলাফেরা, সভা-সমাবেশ করার অধিকারও পর্যায়ক্রমে ফেরত দেয়া হয় এবং সেনাবাহিনী অং সান সুচির রাজনীতির অধিকারও সম্পূর্ণভাবে ফিরিয়ে দেয়। এতে নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের মধ্যেও আশার সঞ্চার হয়। রোহিঙ্গা অধ্যুষিত আরাকান (রাখাইন) প্রদেশে অং সান সুচির সফরকালে রোহিঙ্গারা অং সান সুচির প্রতি প্রকাশ্যে স্বত:স্ফূর্ত সমর্থন জ্ঞাপন করায় অং সান সুচির রাজনৈতিক অবস্থা আরও জোরদার হয়ে ওঠে। যদিও রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকাভুক্ত না করায় পরবর্তীকালে তারা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি, তবুও তাদের সমর্থন ও সহানুভূতি পুরোপুরি লাভ করে অং সান সুচির দল।
নির্বাচনে অং সান সুচির দল বিজয়ী হওয়ার ফলে অং সান সুচি নির্বাচিত সরকারের প্রধান নির্বাহী হওয়ার সুবর্ণ সুযোগ লাভ করেন। কিন্তু অতীতের সেনা সরকার কর্তৃক আরোপিত একটি নিষেধাজ্ঞার কারণে অং সান সুচিকে সরকার প্রধান হওয়ার আশা ত্যাগ করতে হয় এবং সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পদ গ্রহণ করেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। তবে এ নিয়ে তিনি সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে না পড়ে অবস্থার যতটা উন্নতি হয়েছে ততটা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকার নীতি গ্রহণ করেন।
তবে রোহিঙ্গাদের প্রতি তার সর্বশেষ নীতি থেকে প্রমাণিত হয়েছে, তিনিও মিয়ানমারে পূর্ণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তনে বিশ্বাসী নন। মিয়ানমারে হাজার হাজার বছর ধরে যে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করে আসছে মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে তাদের স্বীকৃতি দিতে তিনি রাজি নন। এ ব্যাপারে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এবং একশ্রেণির উগ্রবাদী বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সঙ্গে তাঁর রাজনৈতিক মতামতের কোনোই পার্থক্য নেই। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সদস্যরা ও উগ্রবাদী বৌদ্ধ ভিক্ষুরা রোহিঙ্গাদের শুধু মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে অস্বীকৃতি জানিয়েই খুশি নয়, তারা রোহিঙ্গাদের হত্যা ও রোহিঙ্গা নারীদের ধর্ষণের পাশাপাশি তাদের বসতবাড়িতে আগুন লাগিয়ে তাদের সম্পত্তি লুণ্ঠন করে এবং সর্বশেষে তাদের বাপ-দাদার ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদসহ কোনো নির্যাতন চালাতেই কসুর করছে না রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে।
এই পৈশাচিক নির্যাতন থেকে প্রানে রক্ষা পেতে অনেক রোহিঙ্গাই প্রতিবেশী বাংলাদেশে প্রবেশ করতে চেষ্টা চালাচ্ছে। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্ত অঞ্চলে আগের আসা বহু সংখ্যক রোহিঙ্গা পরিবার অনেক ক্যাম্পে পূর্ব থেকেই অবস্থান করছিল। তাদের সাথে এই নবাগত রোহিঙ্গাদের আগমনের ফলে ওইসব আশ্রয়ার্থী শিবিরের অবস্থা অসহনীয় পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। ফলে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি সদস্যরাও চেষ্টা চালাচ্ছে যাতে মিয়ানমার থেকে নতুন কোনো আশ্রয়প্রার্থী রোহিঙ্গা যেন বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না পারে।
এর ফলে জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত এসব রোহিঙ্গার অবস্থা অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত এসব অসহায় রোহিঙ্গা অনেকে নৌকায় করে সমুদ্রপথে প্রতিবেশী দেশ থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ায় আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। এ করতে গিয়ে অসংখ্য রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশু অসহায়ভাবে মৃত্যুবরণ করছে।
প্রশ্ন ওঠে, মিয়ানমারে জন্মগ্রহণকারী এসব অসহায় রোহিঙ্গার অপরাধ কি? মিয়ানমার সরকার যে বলছে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের বাসিন্দা নয়, তারা বাংলাদেশের বাসিন্দা, অবৈধভাবে তারা মিয়ানমারে অনুপ্রবেশ করেছে- এ বক্তব্য ইতিহাসের ধোপে টেকে না। বাংলাদেশের বহু অমুসলিম পরিবার বছরের পর বছর ধরে ইয়াংগুনসহ মিয়ানমারের বহু শহর ও অন্যান্য অঞ্চলে বসবাস করছে। তাদের ব্যাপারে মিয়ানমার সরকারের কোনো মাথাব্যথা নেই। রোহিঙ্গাদের অপরাধ তারা মুসলমান। মুসলমান হওয়ার কারণে মিয়ানমারের মুসলিমবিদ্বেষী সরকার, সেনাবাহিনী ও উগ্রবাদী বৌদ্ধরা মিয়ানমারে জন্মগ্রহণকারী হওয়া সত্ত্বেও রোহিঙ্গাদের বিতাড়নের লক্ষ্যে বর্বর অভিযান চালিয়ে মানবতার ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায় সংযোজন করেছে।
মিয়ানমার বৌদ্ধপ্রধান দেশ। মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা সে দেশের ইসলাম ধর্মাবলম্বী সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। সংখ্যালঘু হলেই যদি কোনো সম্প্রদায়ের লোকদের বিতাড়িত করার অধিকার জন্মে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের লোকদের, তা হলে আজকের বিশ্বের সকল দেশেই ওলট পালট সৃষ্টি হয়ে যাবে। বিশেষ করে মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা বিতাড়নের ব্যাপারে মিয়ানমারের উগ্রবাদী বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সক্রিয় ভূমিকা প্রমাণ করে রোহিঙ্গা সমস্যার মূলে রয়েছে মিয়ানমারের সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ইসলাম বিদ্বেষ। বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী হিসেবে রং লাগানো হয়েছে সজ্ঞানে সম্পূর্ণ পরিকল্পিতভাবে। এটাই যদি সমস্যার আসল রূপ হয়, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই দাবি উঠতে পারে বৌদ্ধ অধ্যুষিত মিয়ানমারে যদি রোহিঙ্গাদের মুসলিম হওয়ার অপরাধে সে দেশে বসবাসের অধিকার হারাতে হয়, তাহলে একইভাবে মুসলিম অধ্যুষিত বাংলাদেশে থাকার অধিকার নেই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের। কিন্তু আমরা এ দাবি সমর্থন করি না। কারণ আমরা বিশ্বাস করি, পৃথিবীর কোনো দেশই সম্পূর্ণ সংখ্যালঘুমুক্ত হতে পারে না। সেটা অস্বাভাবিক। আর বাংলাদেশের প্রধান ধর্ম ইসলাম সংখ্যালঘুদের মানবাধিকারে এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে বিশ্বাসী। এটা শুধু মুখের কথা নয়। হাজার হাজার বছর ধরে বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্তস্থল হিসেবে বিশ্বে এ সত্যের প্রমাণ রেখেছে।
বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণের ধর্ম ইসলাম শিক্ষা দেয়, মানুষের জীবন মৃত্যুর মাধ্যমেই শেষ হয়ে যায় না। মৃত্যুর পর মানুষ অন্য জীবনে প্রবেশ করে। এ জীবনের শেষে আরেক জীবনে প্রবেশ করতে হয় বলে ইসলামে একে বলা হয় ইন্তেকাল বা জীবনান্তর। এ জীবনে আমরা যা কিছু করি তার বিচার হবে পরজীবনে। সুতরাং মানুষের পার্থিব জীবন অত্যন্ত দায়িত্বপূর্ণ। পার্থিব জীবনের এ দায়িত্বগুলো যথাযথ পালন না করলে তার জন্য শাস্তি ভোগ করতে হবে পরজীবনে। প্রকৃত মুসলিমরা এ বিশ্বাস করে বলেই তারা সজ্ঞানে-সচেতনভাবে সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার করে না, করতে পারে না।
মিয়ানমার সরকারের নেতৃবৃন্দ, সেনাবাহিনীর সদস্যবৃন্দ এবং ভিক্ষুরা সবাই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। বৌদ্ধধর্মের প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধের প্রচারিত ধর্মাদর্শ সম্পর্কে যতটা জানি তিনি মানুষের মানুষে সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ও, অহিংসার বাণী শিক্ষা দিয়ে গেছেন। এ কারণে তার সাথে মানুষে মানুষে জাতিভেদ সৃষ্টিকারী ব্রাহ্মণ্যবাদীদের সংঘাত সৃষ্টি হয়। বিখ্যাত বৌদ্ধ ইতিহাসবিদ বিশ্বেশ্ব¦র চৌধুরী তার বিখ্যাত থেকে খায়বার টেকনাফ গ্রন্থে দাবি করেছেনÑ উপমহাদেশের যত্রতত্র মাটি খুঁড়লেই যে গৌতম বুদ্ধের মূর্তি পাওয়া যায় তাতে বোঝা যায় সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশই একদা বৌদ্ধ অধ্যুষিত হয়ে উঠেছিল। পরবর্তীকালে একপর্যায়ে যে হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদী আন্দোলন সংঘটিত হয়, তার পক্ষ থেকে কোন বৌদ্ধ দেখামাত্র যে তাকে হত্যা করবে, তার চিরকাল স্বর্গবাসের সৌভাগ্য হবে, পক্ষান্তরে যে কোন বৌদ্ধকে দেখা সত্ত্বেও তাকে হত্যা করবে না সে চিরকাল নরকবাসী হবে বলে বৌদ্ধ হত্যায় প্ররোচিত করা হয়। এ কারণে এককালের বৌদ্ধ অধ্যুষিত ভারতবর্ষে বর্তমানে বৌদ্ধ খুঁজে পাওয়া অসম্ভব হয়ে উঠেছে।
উপমহাদেশের ওই জঘন্যতম গণহত্যা তথা বৌদ্ধ নিধন পর্বের পরিণতিতে এদেশের বৌদ্ধরা প্রাণ বাঁচাতে উত্তরে তিব্বত, চীন, পূর্বে বার্মা, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, জাপান এবং দক্ষিণে শ্রীলঙ্কা প্রভৃতি অঞ্চলে পালিয়ে প্রাণ রক্ষা করেন। অবশিষ্টরা দেশেই নির্যাতিত হিসেবে জীবনযাপন করছিলেন। এর মধ্যে সাম্য-ভ্রাতৃত্বের আদর্শ ইসলামের সঙ্গে উপমহাদেশের জনগণের পরিচয় হয়। দুই ধর্মের মধ্যে অনেক ব্যাপারে মিলের কারণে নির্যাতিত বৌদ্ধরা অনেকেই ইসলাম গ্রহণ করেন।
এই আলোচনার আলোকে প্রমাণিত হয়, ইসলামের সাথে বৌদ্ধদের কোনো বড় ধরনের সংঘাত হয়নি। সুতরাং ইসলামের প্রতি বৌদ্ধ অধ্যুষিত মিয়ানমারের সরকার, সেনাবাহিনী ও বৌদ্ধ ভিক্ষুদের বৈরী আচরণ সম্পূর্ণ অনাকাক্সিক্ষত।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন