রায়হান রাশেদ : বারটার পরের রাত। নিস্তব্ধ পৃথিবী। ঘুমিয়ে পড়েছে বিশ্ব চরাচর। জানালার পাশের আম গাছটার পাখিরাও বেঘোরে ঘুমুচ্ছে। রাত জাগা পাখির ন্যায় একলা জেগে আছি আমি। বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ গড়াগড়ি করছি। ঘুম আসছে না। ভেতরে এক সাগর অস্থিরতা। বুকের গহীনের গুঙ্গানি শুনতে পাচ্ছে অন্তর কান। এমন অস্থিরতা আত্মপীড়ন আমার বোধহয় আর কোনদিন লাগেনি। কষ্টটা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে জাতিসংঘের তথ্য শুনে। জাতিসংঘ তথ্য পেশ করেছে- ‘মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের রোহিঙ্গরা আজ বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠী।’
মাসখানেকের বেশি সময় ধরে মিয়ানমারে মুসলিম নিধন চলছে তোড়জোরের সাথে। রোহিঙ্গা মুসলিমদেরকে দেশ থেকে বিতাড়িত করতে, নিজ ভূমি থেকে উৎখাত করতে বৌদ্ধরা উঠে পড়ে লেগেছে। মুসলিম হত্যা করে আকাশ কাঁপানো উল্লাসে মেতে উঠছে। রোহিঙ্গা মুসলমানদের ঘর বাড়ি জনপদ জ্বালিয়ে ভস্ম করছে। সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুকে ধরে শূন্যে ছুঁড়ে মারছে। কাউকে দু’পায়ে ধরে ছিড়ে ফেলছে। ঐ যে বৃদ্ধা, যে লাঠি ছাড়া এক পা সামনে চলতে পারে না তাকে পেছন থেকে লাথি মেরে জমিনে ফেলে দিয়ে গুলি করছে বর্বর রাখাইনরা। মধ্যবয়সী নারী ও তরুণীদেরকে প্রথমে কয়েকজন মিলে ধর্ষণ করে তারপর জ্যান্ত শরীর থেকে গোশত পৃথক করছে। যেখানে মুসলিম পাওয়া যাচ্ছে সেখানেই আগুন দিয়ে পুড়ে কিংবা জ্যান্ত কবর দিয়ে নয়তো কুড়াল দা দ্বারা কুপিয়ে অথবা গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে।
সেদিন ছোট ভাই মামুন কাতার থেকে ফোনে এক বীভৎস করুণ কাহিনী শুনাল। চোখের জল গাল বেয়ে গলা স্পর্শ করছিল তখন। নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অপরাধী ও অসহায় মনে হচ্ছিল। সে কেঁদে কেঁদে থেমে থেমে বলছিল ‘আজ ৫০ জন রাখাইন বৌদ্ধ যুবক ৫ জন মুসলিম অসহায় তরুণীকে ধরে পালাক্রমে ধর্ষণ করার পর দেহের স্তন, গাল, জিহ্বা ও মাংস কেটে কেটে শূন্যে ছুঁড়ে মেরেছে।’
হায়! মানবতা। হায়! শান্তির দূতেরা। আজ কোথায় তোমাদের মানবতার শ্লোগান? তোমরা কেন গঠন করেছো স্বেচ্ছাচারিতা, শ্রেণি বৈষম্যের জাতিসংঘ? মুসলমানরাই-বা কেন সংঘটিত হলো ওআইসি নামক ব্যানারে?
আজ সবাই নিশ্চুপ। নির্বাক। মুসলমান মরুক। পঁচুক। নদীতে লাশ হয়ে ভাসুক। শরণার্থী হয়ে কাঁটাতারে গলা ঢুকিয়ে না খেয়ে আশ্রয় প্রার্থনা শেষে মারা যাক। তাতেই পৃথিবীর নামধারী অলীক শান্তির মোড়লরা আনন্দিত। বেশ খুশি। পক্ষান্তরে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানের গায়ের জামা যদি মুসলমানের ঘরের সোলায় লেগেও ছিড়ে যায়, তাহলে মানবতার শ্লোগানে দাপটশালীরা হৈ হৈ করে উঠে। বিশ্বের কুখ্যাত মোড়লরা মানবাধিকারের অমীয় বাণী নিয়ে পর্দায় পর্দায় ভাসেন।
সম্প্রতিকালেই যে শুধু রোহিঙ্গাদের উপর অত্যাচার নির্যাতন চলছে তা কিন্তু নয়। পূর্বেও রোহিঙ্গাদের উপর পাশবিক নির্যাতন করা হয়েছে। তবে যুগপৎ সময়ে মুসলিমদের উপর বৌদ্ধদের বিভীষিকাময় অত্যাচার অতীত ইতিহাসকে গ্রাস করেছে। বিশ্ব বাজারে সবচে’ ভয়াবহ ও ভয়াল অত্যাচার হলো সাম্প্রতিকালে মুসলিমের উপর রাখাইন বৌদ্ধদের অত্যাচার।
ইতিহাসবিদদের মতে ‘অষ্টম-নবম শতাব্দীতে প্রাথমিকভাবে মধ্য প্রাচ্যের মুসলমান ও স্থানীয় আরাকানীদের সংমিশ্রণে রোহিঙ্গা জাতির উদ্ভব। ১৪৩০-১৪৮৪ সাল পর্যন্ত ২২ হাজার বর্গমাইল এলাকা নিয়ে রোহিঙ্গাদের স্বাধীন রাজ্য ছিল। পরে বার্মার রাজা বোদাওফারা এ রাজ্য দখলের পর বৌদ্ধ আধিপত্য শুরু হয়। পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের উপর শুরু হয় অত্যাচার অনাচারের অশুভ সুচনা।
১৯৪৮ সালে বার্মা স্বাধীন হওয়ার পরবর্তী পার্লামেন্টেও রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধিত্ব ছিল। ১৯৬২ সালের নতুন নাগরিকত্ব আইনের ফলে তাদের নাগরিকত্বও বাতিল হয়ে যায়। মিয়ানমারের শাসনতন্ত্রে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কোনো স্বীকৃতি নেই। অষ্টম-নবম শতাব্দীতে গড়ে উঠা রোহিঙ্গা মুসলিমদেরকে তিলে তিলে নির্যাতন করছে রাখাইন বৌদ্ধরা। নিকৃষ্ট কলংকিত মানব বোদাওফারা এর মাধ্যমে সুচিত হওয়া অত্যাচার আজ পৃথিবীর সব নৃসংশতার ইতিহাসকে ছাপিয়ে গেছে। মুসলমানদের চিৎকারে প্রকম্পিত দুনিয়ার আকাশ। মিয়ানমারের বাতাসে লাশের গন্ধ। কান্নার হু হু আওয়াজের বাতাসে কান পাতা দায়। পানার মতো নাফ নদীতে ভাসছে মানুষের পঁচা মরা লাশ। মু-ুহীন মানুষের মরা দেহ নিয়ে কুকুর ছোটাছুটি করছে। নাফ তীরে, আরাকানের আকাশে উড়ছে শত শত শকুন। মা বাবা ভাইয়ের সামনে ধর্ষিতা হচ্ছে তরুণী কিংবা ছেলের সামনে জননী।
হে মুসলিম, জাগ্রত হও। সকল দুর্বলতা, ভীরুতা, কলুষতাকে পিছনে ফেলে আপন ইতিহাস স্মরণে এনে প্রতিবাদে রুখে দাঁড়াও। এগিয়ে যাও মুসলিম ভাইয়ের রক্তের নিরাপত্তায়। মা বোনের ইজ্জতের হেফাজতে। নির্যাতিত মুসলমান! সে তো আমার ভাই। আমার প্রিয়তম পিতা। আমার দুঃখীনি মা জননী।
হে আল্লাহ তুমি মুসলমানদের হেফাজত করো।
ষ লেখক : সমাজ গবেষক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন