শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

খেলা ফিচার

ফুটবলপ্রেমী একজন আলতাফ

| প্রকাশের সময় : ১০ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

জাহেদ খোকন : ফিফা র‌্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান যখন ১৮৩ তম স্থানে ঠিক তখনি লাল-সবুজ ফুটবলে আলোচ্ছটা ফেরাতে কাজ করে যাচ্ছেন মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার মো: আলতাফ হোসেন। যিনি সাবেক ক্রীড়াবিদ হলেও পেশায় একজন শিক্ষক।
দেশের ফুটবলে এখন দৈন্যদশা চলছে। ফুটবলের জনপ্রিয়তা নামতে নামতে শূন্যের কোঠায় এসে থেমেছে। মর্যাদাপূর্ণ ঘরোয়া আসর বাংলাদেশ প্রিমিয়ার ফুটবল লিগ চলছে দর্শকশূন্য স্টেডিয়ামে। কিছুদিন আগেও ফিফা র‌্যাংকিংয়ে বাংলাদেশ ছিলো ১৮৮তম স্থানে। লাল-সবুজ ফুটবল ইতিহাসে এখনকার মতো খারাপ সময় আর কখনো আসেনি। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের সর্বত্রই ফুটবলের দৈন্যদশা নিয়ে সরব আলোচনা চলছে। গত ১০ অক্টোবর এএফসি এশিয়ান কাপ বাছাইয়ের প্লে-অফ ম্যাচে বাংলাদেশ জাতীয় দল যখন ভূটানের কাছে ৩-১ গোলে হারে, তখন থেকেই মূলতঃ দেশের ফুটবলকে ঘিরে আলোচনা-সমালোচনার শুরু। এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে প্লে-অফের হোম ম্যাচে ভুটানের বিপক্ষে গোলশূন্য ড্র যতটা না ক্ষতি করেছে থিম্পুর অ্যাওয়ে ম্যাচে হার বাংলাদেশের ফুটবলকে তারচেয়ে বেশি ঠেলে দিয়েছে অন্ধকার গহ্বরে। সেই অন্ধকার ফুঁড়ে আলোয় ফেরাটা বেশ কঠিন। আবার কবে আলোয় ফিরবে লাল-সবুজের ফুটবল, তা বলা মুশকিল। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) কর্তারা জাতীয় দলের এমন ব্যর্থতার পরও যেখানে নিজেদের চেয়ার আকঁড়ে ধরে রাখতে ব্যস্ত সেখানে কিন্তু ফুটবল নিয়ে কাজ করতে একটুও ক্লান্ত নন আলতাফ হোসেন। মানিকগঞ্জ সিংগাইর পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ে এই শিক্ষক নিভৃতেই দেশের ফুটবলকে আলোয় ফেরানোর কাজটা করছেন তৃর্ণমূল পর্যায়ের ফুটবলার তৈরি করে। শুধু শিক্ষক পরিচয়ে তার পরিচিতি দিলে ভুল হবে। খেলাধুলার প্রতি তার রয়েছে প্রচ- রকম আগ্রহ। ক্রীড়ার প্রতি এই অদম্য নেশার কারণে তিনি নিজেই গড়ে তুলেছেন আশা মার্শাল আর্ট স্কুল। প্রায় শ’খানেক কিশোর-কিশোরী নিয়মিত প্রশিক্ষণ নিচ্ছে তার এই স্কুলে। আলতাফ হোসেন এখন মনোযোগী হয়েছেন ফুটবলে। গেলো দু’বছর ধরে তার সুযোগ্য নেতৃত্বে সিংগাইর পাইলট স্কুল কৃতিত্বের সঙ্গেই গ্রীষ্মকালীন স্কুল ও মাদ্রাসা ক্রীড়ার  ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয়ে আসছে। এ প্রসঙ্গে আলতাফ জানান, গেলো বছর গ্রীষ্মকালীন স্কুল ও মাদ্রাসা ক্রীড়ায় ছেলেদের ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে সিংগাইর পাইলট স্কুল। ওই সময় মেয়েদের দল অংশ নেয়নি। কিন্তু পরের বার অর্থাৎ এ বছর প্রথমবারের মতো মেয়েরা অংশ নিয়ে সিংগাইর উপজেলায় চ্যাম্পিয়ন হয়। তিনি বলেন, ‘গতবারই মেয়েদের খেলাতে চেয়েছিলাম। মেয়েদের যথেষ্ট আগ্রহও ছিলো। কিন্তু দলটি পুরোপুরিভাবে ফিট না থাকায় আর খেলানো হয়নি। তবে এবার আমরা পরিপূর্ণ প্রস্তুতি নিয়েই মাঠে নেমেছিলাম। সাফল্যও পেয়েছি।’
এবারের ৪৫তম গ্রীষ্মকালীন স্কুল ও মাদ্রাসা ক্রীড়ায় সিংগাইর পাইলট স্কুল ছেলে ও মেয়ে উভয় বিভাগেই চ্যাম্পিয়ন হয়। এই বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হওয়াটা আলতাফ হোসেনের মনোজগতকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। তাই তার সিদ্ধান্ত তিনি  এদের নিয়েই এগিয়ে যাবেন। আলতাফের কথা, ‘আমি যখন কেরাণীগঞ্জের পিএম উচ্চবিদ্যালয়ে ছিলাম তখনও স্কুল ও মাদ্রাসা ক্রীড়ায় ছেলে-মেয়েদের চ্যাম্পিয়ন করিয়েছি। সে সময় ফুটবল নিয়ে কাজ করার উৎসাহ অতোটা পাইনি যতটা এখন পাচ্ছি। এর মূল কারণ হলো কেরাণীগঞ্জ ঢাকা মহানগরের খুব কাছাকাছি অবস্থিত। এখানে শহুরে পরিবেশ বিদ্যমান। ছেলেমেয়েরা অনেকটাই আধুনিক চেতা। সিংগাইরে কিন্তু সেরকমটা নেই, যেটা আবার মানিকগঞ্জ জেলা শহরে আছে। ফলে এখানকার ছেলেমেয়েদেরকে নিয়ে কাজ করাটা কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ। অভিভাবকদের হরেক রকমভাবে বোঝাতে হয়। ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের নিয়েই কষ্ট হয় বেশি। তবে মেয়েরা ভীষণ আন্তরিক।’ সিংগাইর পাইলট স্কুলের মেয়ে দলের অধিনায়ক আফরোজা খাতুন বলেন, ‘স্যার সবসময় আমাদের উৎসাহ দিয়ে আসছেন। তিনি বলতেন ময়মনসিংহের কলসিন্দুরের মেয়েরা পারলে তোমরা পারবেনা কেন? তোমরা তো ঢাকার খুব কাছাকাছি থাকো। কলসিন্দুরের মেয়েরা যেভাবে বাংলাদেশের ফুটবলকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে গেছে, তোমরাও সেটা পারবে। মূলতঃ স্যারের এসব কথা-ই আমাদের আশাবাদী করে তোলে। আর সেজন্যই প্রথমবার অংশ নিয়েই চ্যাম্পিয়ন হয়েছি।’
আলতাফ হোসেন এখন ভাবছেন একটি ফুটবল একাডেমি গড়ে তোলার কথা। যেখানে ১০ বছর বয়সীরা ফুটবল খেলবে। যাদের জন্য থাকবে দীর্ঘমেয়াদী অনুশীলনের ব্যবস্থা। স্কুলের অনুমতি নিয়ে স্কুলের মাঠ কিংবা উপজেলার অন্য কোথাও ফুটবল একাডেমি গড়ে তুলবেন তিনি। ইতোমধ্যে এই ফুটবলপাগল মানুষটি একাডেমি তৈরির কাজও শুরু করে দিয়েছেন। ছেলেমেয়েদের খেলার সরঞ্জামে নিজ অর্থে কিনে দেয়ার সিদ্ধান্তও রয়েছে তার। আলতাফ হোসেন বলেন, নিজে ফুটবলার ছিলাম। দেখেছি আশি কিংবা নব্বই দশকে দেশের ফুটবলের রমরমা অবস্থা। বর্তমান ফুটবলের দুরবস্থা খুব খারাপ লাগে। ভীষণ পীড়া দেয় জাতীয় দলের ব্যর্থতা থেকে শুরু করে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের খেলায় স্টেডিয়ামে দর্শকে অনুপস্থিতি। আমি জানি গোটা বাংলাদেশের মধ্যে আমার প্রচেষ্টা অনেকটা সর্ষে দানার মতো মনে হবে। কিন্তু একবার ভেবে দেখুন প্রতিটি উপজেলায় যদি আমার মতো একজন করে আলতাফ হোসেন দাঁড়িয়ে যায় তাহলে দেশের ফুটবলের চিত্রটা কেমন হবে? ফুটবলকে আলোয় ফেরাতে অতো কিছুর দরকার নেই, নিজ নিজ অবস্থান থেকে ফুটবলকে ভালোবেসে কাজ করে গেলেই হয়। তৃর্ণমূল পর্যায় থেকে ফুটবলার খুঁজে বের করে তাদেরকে ভবিষ্যত সালাউদ্দিন, সালাম, আসলাম, কায়সার হামিদ বানানোর মানসিকতা থাকতে হবে। দেশের ফুটবলের জন্য দরদ নিয়ে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করতে হবে। তবেই হয়তো বাংলাদেশ ফুটবলের সুদিন ফিরে আসবে।’
মো: আলতাফ হোসেন শুধু একজন সাবেক জাতীয় ক্রীড়াবিদই নন, তার আরও একটি পরিচয় হচ্ছে তিনি একজন পরিবেশবিদ। দীর্ঘদিন ধরে পরিবেশ উন্নয়ন ও দূষণরোধে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করে যাচ্ছেন। এ নিয়ে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে নিয়মিতভাবে লেখালেখিও করে যাচ্ছেন। আর এসব কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ আগামী ১২ ডিসেম্বর মানিকগঞ্জের স্থানীয় দৈনিক ‘পৃথিবী প্রতিদিন’ তাঁকে সম্মাননা জানাচ্ছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন