শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

মৌসুমের শুরুতেই লবণ খাতে অশনি সংকেত

| প্রকাশের সময় : ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

শামসুল হক শারেক, কক্সবাজার : লবণ বাংলাদেশের একটি স্বনির্ভর খাত। দেশের দক্ষিণপূর্ব অঞ্চল কক্সবাজার জেলা ও চট্টগ্রাম জেলার বাঁশখালীতেই শুধু লবণ উৎপাদন হয়ে থাকে। নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সময় লবণ উৎপাদনের মৌসুম। প্রতিবছর এই সময়ের মধ্যে চাষিরা হাঁড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে লাখ লাখ মে. টন লবণ উৎপাদন করে দেশকে লবণে স্বনির্ভর করে তোলে। লবণ উৎপাদন, বিপণন ও বাজারজাতকরণের সাথে প্রত্যক্ষভাবে ৫ লাখ এবং পরোক্ষভাবে ২৫ লাখ মানুষ জড়িত। অনেকদিন পর গতবছর লবণের মূল্য বাড়ায় চাষিরা ভাল দাম পেয়ে খুশী হয়েছিল। কিন্তু চলতি মৌসুমের শুরুতেই দেখা যাচ্ছে লবণ খাতে অশনি সংকেত।
লবণ মৌসুম শুরু হয়েছে নভেম্বর থেকেই। মৌসুমের দেড় মাস চলে গেলেও ৬৩ হাজার একর জমির সিকি পরিমাণ জমিতেও চাষিরা এখনো নামতে পারেনি। ৬৩ হাজার একর লবণ জমিতে ৪০ হাজার চাষি লবণ উৎপাদনে নামার কথা থাকলেও নানা কারণে চাষিরা এখনো উৎপাদনে যেতে পারছে না। কক্সবাজার সদর, মহেশখালী ও টেকনাফের লবণ চাষ এলাকা সরে জমিনে পরিদর্শন করে দেখা গেছে, মোট লবণ জমির সিকি পরিমাণ জমিতেও এখনো লবণ চাষ শুরু হয়নি। তাই লবণ সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন চলতি মৌসুমে লবণের ঘাটতির লক্ষণ মৌসুমের শুরুতেই দেখা যাচ্ছে।
গত বছর দেশে বাম্পার লবণ উৎপাদনে ‘লবণ বিপ্লব’ হয়েছিল। এতে করে লবণ আমদানিকারক সিন্ডিকেটগুলো মহা-বেকায়দায় পড়ে গিয়েছিল। চলতি মৌসুমে ওই সিন্ডকেটগুলো লবণ ঘাটতির নানা অজুহাত খুঁজছে বলেও একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে আবাস পাওয়া গেছে।
মহেশখালীর ধলঘাট-মাতারবাড়িতে কয়লা বিদ্যুতের জন্য অধিকাংশ জমি অধিগ্রহণ করে নেয়ায় সেখানে লবণ চাষের কোন পরিবেশ নেই। টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ এলাকায় গত কয়েক বছর ধরে বেড়িবাঁধ না থাকায় লবণ চাষ বন্ধ রয়েছে। কক্সবাজার সদরের পোকখালী, চৌফলদন্ডী এলাকার বিস্তীর্ণ লবণ জমি এখনো পড়ে রয়েছে। কিছু কিছু জমিতে চাষিরা মাঠ তৈরী করছে মাত্র। সেখানে এই প্রতিবেদকের সাথে কথা হয় কয়েকজন লবণচাষীসহ স্থানীয় অধিবাসী কক্সবাজার সদরের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান এড. সলিমুল্লাহ বাহাদুরের সাথে। তিনি জানান পোকখালী, গোমাতলী ও চৌফলদন্ডীসহ কক্সবাজার সদরের বিস্তীর্ণ এলাকায় লবণচাষ পিছিয়ে যাওয়ার কারণ। গত বর্ষায় ওই এলাকার পশ্চিম দিকের বেড়িবাঁধের বিভিন্ন স্থানে ভেঙ্গে গেছে। ওইসব ভাঙ্গা দিয়ে এখনো জোয়ারের পানি ঢুকে লবণ চাষের জমি তলীয়ে যায়। এতে করে ওই এলাকার বিস্তীর্ণ জমিতে লবণ চাষ পিছিয়ে গেছে। এছাড়াও গেল বছর লবণের মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় এবছর লবণ জমির লাগিয়ত বাড়িয়ে দিয়েছে ভূমি মালিকরা। এই কারণে চড়া মূল্যদিয়ে জমি নিয়ে চাষিরা সাহস করে লবণ চাষে নামতে পারছে না।
টেকনাফের লবণ চাষি তারেক রশীদ জানান, বেড়িবাঁধ না থাকায় টেকনাফবাসীর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ধান চাষ, লবণ চাষ তো দূরের কথা সেখানকার মানুষের ভিটেবাড়ি রক্ষা করাও দায় হয়ে পড়েছে।
কক্সবাজার বিসিকের প্রকল্প পরিচালক আবছার উদ্দিন এপ্রসঙ্গে বলেন, ৬৩ হাজার একর লবণ চাষের জমির এক তৃতীয়াংশ জমি চাষের আওতায় না আসার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কুতুবদিয়া এবং বাঁশখালীতে লবণ উৎপাদন শুরু হয়েছে। গত সপ্তাহে সেখানে ২ হাজার ৫৫০ মে.টন লবণ উৎপাদন হয়েছে। যেখানে বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে জোয়ারের পানি ঢুকছে যেমন কক্সবাজার সদরের পোকখালী, গোমাতলী ও চৌফলদন্ডীতে এবং টেকনাফে শাহপরীর দ্বীপে এবং সাব্রাং এ লবণ চাষ পিছিয়ে গেছে। এছাড়াও যেখানে চিংড়ি চাষ হয়ে থাকে সেখানেও কিছু কিছু এলাকায় লবণ চাষ পিছিয়ে যাচ্ছে। মহেশখালীর মাতারবাড়ী ও ধলঘাটায় কয়লা বিদ্যুতের জন্য জমি অধিগ্রহণ করায় লবণ জমি কমে গেছে বলেও তিনি জানান। তবে গত বছর ১৫ লাখ ৫৫ হাজার মে.টন লবণ উৎপাদন হলেও চলতি মৌসুমে ১৫ লাখ ৫৫ হাজার মে.টন চাহিদার অনুকূলে ১৮ লাখ ৭৬ হাজার মে.টন লবণ উৎপাদনের টার্গেট নিয়ে বিসিক লবণ চাষিদের সার্বিক সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে বলেও আবছার উদ্দিন জানান।
বিসিক প্রকল্প পরিচালক আরো বলেন, ভারতের সাথে আমাদের লবণ উৎপাদনে কিছুটা তারতম্য রয়েছে। যেমন ভারতে লবণ উৎপাদনের সব জমিই সরকারী খাস জমি। ব্যক্তি মালিকানার কোন জমি নেই। সেখানে ডেনসিটি বা পানির ঘনত্ব বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশী। তাই প্রতি একর জমিতে আমাদের চেয়ে কয়েকগুণ বেশী লবণ উৎপাদন হয়ে থাকে সেখানে। সেখানে লবণ উৎপাদনে অনর্বত ৬ মাস মৌসুম পাওয়া যায়।
আমাদের এখানে বলতে গেলে লবণ এলাকার সব জমিই ব্যক্তি মালিকানাধীন। ডেনসিটি বা পানির ঘনত্ব বাংলাদেশে ভারতের চেয়ে অনেক কম। এখানে লবণ উৎপাদনের মৌসুম ৬ মাস বলা হলেও আসলে ৩ মাসের বেশী পাওয়া যায় না। ঝড় বৃষ্টিতে লবণ উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হয়ে থাকে। এসব কারণে আমাদের দেশে লবণ উৎপাদন খরচ ভারতের চেয়ে বেশী হয়ে থাকে।
এছাড়াও ভারতে লবণ উৎপাদন, বিপণন, চাষিদের সুবিধা-অসুবিধা দেখাশোনার জন্য একটি স্বাধীন ‘লবণ কমিশন’ কাজ করে থাকে। অথচ লবণ একটি কৃষি পণ্য হওয়া সত্ত্বেও আমাদের দেশে এখনো লবণ কৃষি পণ্য না শিল্প পণ্য এনিয়ে বিতর্ক থামেনি। তিনি লবণ সমস্যা ও লবণ চাষি সমস্যা দেখাশোনা ও উৎপাদন বিপণনে একটি স্বাধীন লবণ ‘গবেষণা সেল’ গঠনের প্রস্তাব জানান।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন