জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের প্রধান মেজর (বরখাস্ত) সৈয়দ জিয়াউল হকের পরিকল্পনায় ১৮ সহযোগী মিলে আদালত প্রাঙ্গণ থেকে দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে বলে দাবি করেছে ডিবি। এ ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে আদালতের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশের একজন পরিদর্শকসহ পাঁচজনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে । গতকাল রাত পর্যন্ত আইন-শৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা ছিনতাইকৃত জঙ্গীদের উদ্ধার বা এর সাথে জড়িত কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি। দেশের সকল সীমান্ত এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। র্যাবের গোয়েন্দা ইউনিটসহ সব ইউনিট কাজ করছে। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গি ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনায় পুলিশ সদর দপ্তর থেকে চার সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিতে একজন ডিআইজিকে প্রধান করা হয়েছে।
গতকাল কমিটির সদস্যরা চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের প্রধান ফটক, সিএমএম আদালতের হাজতখানা, ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধ ট্রাইব্যুনালসহ বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করেন। এর আগে ঘটনার পর ডিএমপির পক্ষ থেকেও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। বরখাস্ত হওয়া পুলিশ সদস্যরা হলেন-সিএমএম আদালতের হাজতখানার কোর্ট ইন্সপেক্টর মতিউর রহমান, হাজতখানার ইনচার্জ (পরিদর্শক) নাহিদুর রহমান ভূঁইয়া, আসামিদের আদালতে নেয়ার দায়িত্বরত পুলিশের এটিএসআই মহিউদ্দিন, পুলিশ সদস্য শরিফ হাসান ও আবদুস সাত্তার।
ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে সাংবাদিকদের ডিবি প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, তারা জঙ্গিদের ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনাস্থল এবং আশপাশের এলাকার সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করেছেন। এ ঘটনায় কোতোয়ালি থানায় ২০ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা ২০ থেকে ২১ জনকে আসামি করে একটি মামলা করা হয়েছে। আদালতে আসা ১২ জঙ্গির মধ্যে দুজনকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। বাকি ১০ জনকে ১০ দিন করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। জঙ্গি ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনার পর রাজধানীজুড়ে টহল বাড়ানো হয়েছে। অলিগলির সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে দেখা হচ্ছে। শিগগিরই এ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করা হবে।
তিনি আরো বলেন, ছিনিয়ে নেয়া দুজন নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের (সাবেক আনসারুল্লাহ বাংলা টিম) সদস্য। তারা জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন এবং লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। এই জঙ্গি সংগঠনের নেতা মেজর (বরখাস্ত) সৈয়দ জিয়াউল হক। যার পরিকল্পনায় ২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত একাধিক লেখক, প্রকাশক, ব্লগার ও সমকামী অধিকারকর্মীকে হত্যা করা হয়। গত রোববার ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনাল থেকে আট জঙ্গিকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতের হাজতখানায় নিয়ে যাচ্ছিলেন পুলিশ সদস্যরা। এ সময় তাদের ওপর হামলা এবং স্প্রে ছিটিয়ে সিজেএম আদালতের প্রধান ফটকের উল্টো দিকের গলি দিয়ে মোটরসাইকেলে করে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গি মইনুল হাসান শামীম ওরফে সিফাত সামির ও মো. আবু ছিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিবকে ছিনিয়ে নেন সহযোগীরা।
তিনি বলেন, সবাইকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। তারা যাতে পালাতে না পারে সেজন্য ইতোমধ্যে পুলিশ প্রধান সারাদেশে রেড অ্যালার্ট জারি করেছেন। যে কোনো সময় তাদের গ্রেফতার করা হবে। যারা এ পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত এবং ঘটনার মাস্টারমাইন্ড প্রত্যেককে আইনের আওতায় আনা হবে। পলাতক জঙ্গি ও ছিনতাইয়ের ঘটনায় সহযোগীরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারিতে। শিগগির তাদের গ্রেফতার করা যাবে।
আসামি ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনায় পুলিশের দায়-দায়িত্ব নিরূপণ করা হয়েছে কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে হারুন বলেন, পুলিশের যারা দায়িত্বে ছিলেন, দায়িত্ব অবহেলাজনিত কারণে ডিএমপি কমিশনার ইতোমধ্যে পাঁচ পুলিশ সদস্যকে বরখাস্ত করেছেন। জঙ্গি আনা-নেওয়ায় নিরাপত্তা ব্যবস্থার জোরদার না থাকার কারণেই কী জঙ্গিরা এমন সুযোগ কাজে লাগিয়েছে? এই ঘটনা পুনরাবৃত্তি না হওয়ার বিষয়ে আপনারা কী ব্যবস্থা নিয়েছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে হারুন বলেন, স্বাভাবিকভাবেই জঙ্গি আনা-নেয়ার ক্ষেত্রে একটা প্রটেকশন থাকে। এর মধ্যে একটি ঘটনা ঘটেছে এখানে অবহেলার কারণেই পাঁচ পুলিশ সদস্যকে বরখাস্ত করা হয়েছে।
দুই জঙ্গি ধরতে অভিযানে র্যাবের সব ইউনিট: র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ঢাকার নিম্ন আদালত থেকে পুলিশের চোখে স্প্রে করে ছিনিয়ে নেয়া প্রকাশক দীপন হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামিকে গ্রেফতারে র্যাবের গোয়েন্দা ইউনিটসহ সব ইউনিট কাজ করছে। র্যাব আদালত প্রাঙ্গণ, অন্যান্য জায়গা, সিসিটিভি ফুটেজ এবং বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছে। পাশাপাশি গোয়েন্দা কার্যক্রম চলমান। একইভাবে পালিয়ে যাওয়া দুই জঙ্গির আগের অপরাধের ধরন, তাদের আত্মীয়-স্বজন ও বিভিন্ন সময় চলাচলসহ সবকিছু র্যাব পর্যালোচনা করছে। পলাতক জঙ্গিদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে র্যাবের সব ইউনিট ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থা তাদের গ্রেফতারে অভিযান পরিচালনা করছে।
জঙ্গি ছিনতাইয়ের মোটরসাইকেলটি পুরান ঢাকার হাসান আল মামুনের: জঙ্গি আসামিদের ছিনিয়ে নিতে দুটি মোটরসাইকেলে এসেছিল সহযোগীরা। তাড়াহুড়ো করে পালানোর সময় একটি মোটরসাইকেল ফেলেই চলে যায় জঙ্গিরা। বর্তমানে সেই মোটরসাইকেলটি কোতোয়ালী থানায় রয়েছে।
বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা মেট্রো-ল-৩১-৫৭১০ নম্বরের ওই মোটরসাইকেলটি ১৬০ সিসির হোন্ডা ব্র্যান্ডের হরনেট মডেলের। মোটরসাইকেলটির নিবন্ধন হাসান আল মামুন নামে এক যুবকের নামে। তিনি পুরান ঢাকার বাসিন্দা।
বিআরটিএ সূত্র আরও জানায়, মোটরসাইকেলটির রেজিস্ট্রেশন করা হয়েছিল ২০২১ সালের ১৭ জানুয়ারি। তবে গতকাল পর্যন্ত মোটরসাইকেলের মালিক হাসান আল মামুনকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। এছাড়াও জঙ্গিদের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা, কেন তার মোটরসাইকেলকেই ছিনতাই অপারেশনের জন্য বেছে নেওয়া হলো, এসব বিষয়েও তথ্য নেই কারও কাছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের তদন্ত কমিটি গঠন: মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামিকে (জঙ্গি) ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় পুলিশ সদর দপ্তর থেকে চার সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিতে একজন ডিআইজিকে প্রধান করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির বাকি সদস্যরা হলেন- অতিরিক্ত ডিআইজি (ক্রাইম মেট্রো) মো. হাসানুজ্জামান, সিটিটিসির ড. এ এইচ এম কামরুজ্জামান ও সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (মেট্রো সাউথ) মো. আনিচুর রহমান।
ডিএমপির প্রসিকিউশন বিভাগের ডিসি জসিম উদ্দিন বলেন, গত রোববারের ঘটনার পর নিম্ন আদালতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অতিরিক্ত তিন প্লাটুন পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। এ ঘটনার পর নিম্ন আদালতের নিরাপত্তায় নতুন করে নিরাপত্তাপরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে।
তিনি বলেন, যেহেতু এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেছে যাতে ভবিষ্যতে এমন ঘটনা আর না ঘটে সেটা আদালত, বার কাউন্সিল ও পুলিশসহ আমরা সবাই বসে নতুন নিরাপত্তাপরিকল্পনা প্রণয়ন করব। মঙ্গলবার আমরা এ বিষয়ে আলোচনা করব।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন