শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

খেলা ফিচার

বছরটি মেয়েদের

| প্রকাশের সময় : ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

জাহেদ খোকন : দেখতে দেখতেই শেষ হয়ে এলো ২০১৬ সাল। রাত পোহালেই উঠবে নতুন সূর্য, শুরু হবে নতুন বছর ২০১৭ এর পথচলা। বাংলাদেশের খেলাধুলায় কেমন কাটলো ২০১৬? এমন প্রশ্নে হয়তো ক্রীড়াপ্রেমীরা পেছন ফিরে তাকাবেন। হাসি-কান্না-প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির অনেক উপাখ্যানই খোঁজার চেষ্টা করবেন। আর একবাক্যেই স্বীকার করবেন, দেশের ক্রীড়াঙ্গণে ২০১৬ সালটি ছিলো মেয়েদের বছর। সত্যিই তাই। বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গণে এ বছরটি ছিলো মেয়েদেরই। বছরের শুরুতে জানুয়ারি মাসে বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ আন্তর্জাতিক ফুটবল টুর্নামেন্টে যেখানে দেশের মাটিতে মামুনুলরা চরম ব্যর্থ, সেখানে পরের মাসেই গৌহাটি-শিলং সাউথ এশিয়ান (এসএ) গেমসে দেশসেরা মহিলা সাঁতারু মাহফুজা খাতুন শিলা জোড়া ও প্রতিভাবান নারী ভারোত্তোলক মাবিয়া আক্তার সিমান্ত এক স্বর্ণপদক জিতে  হৈ চৈ ফেলে দেন। শুধু তাই নয় বলা যায়, গৌহাটি-শিলং এসএ গেমসটি ছিলো বাংলাদেশের মেয়েদের জন্যই। এ আসরে লাল-সবুজের মেয়েরা পুরুষদের পেছনে ফেলে দেশের জন্য অভাবনীয় সাফল্য বয়ে আনেন। গেল এসএ গেমসে শুধু  শিলা-সিমান্তই স্বর্ণ জেতেননি, রৌপ্যপদক জিতেছে বাংলাদেশ মহিলা খো খো, কাবাডি ও হ্যান্ডবল দল। রুপা এসেছে লাল-সবুজের কুস্তি ও শুটিংয়ের মেয়েদের কাছ থেকেও।
বছরের মাঝামাঝি পার হয়ে দেশের মাটিতে সেরা সাফল্য পেয়েছে বাংলাদেশ অনুর্ধ্ব-১৬ কিশোরি ফুটবল দল। তারা এএফসি অনুর্ধ্ব-১৬ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপের বাছাই পর্বে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়ে দেশের মহিলা ফুটবলকে উচ্চ থেকে উচ্চতর শিখরে নিয়ে গেছে। আর বছর শেষ হওয়ার দু’দিন আগে ভারতের শিলিগুড়িতে সাফ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপে আফগানিস্তানকে ৬-০ গোলে হারিয়ে সেমিফাইনালে উঠেছে জাতীয় মহিলা ফুটবল দল। এতো কিছু যা সবই দেশের মেয়েদের সাফল্য। যেখানে পুরুষরা বরাবরের মতই ব্যর্থ। চরম ব্যর্থ।  
একবছর আগেও যে মেয়েটি ছিলেন অখ্যাত। এসএ গেমসের স্বর্ণ জয় তাকে বানিয়ে দিলো প্রখ্যাত। হঠাৎই যেন তারকা বনে গেলেন ভারোত্তোলক মাবিয়া আক্তার সিমান্ত। এক স্বর্ণ জয়েই বদলে গেল তার জীবন। চলার পথে পেলেন অনেককেই। যারা অভিনন্দন আর আর্থিক পুরস্কার দিতে এগিয়ে এলেন। গৌহাটিতে এসএ গেমসের নারী ভারোত্তোলনের ৬৩ কেজি ওজনশ্রেণীতে দেশের হয়ে প্রথম স্বর্ণ জিতেন সিমান্ত।  চোখে ভাসে সেদিনের দৃশ্য। এসএ গেমসের পুরস্কার মঞ্চে জাতীয় সংগীতের সুরের মুর্ছনায় সিমান্তের কান্নার দৃশ্যটি কোনও দিন ভোলার নয়। পুরষ্কার  মঞ্চে  তার কাঁন্নায় যেন কেঁদেছে গোটা জাতি, পুরো বাংলাদেশ। দেশের হয়ে সাফল্য তুলে এনে তিনি পেয়েছেন সংবর্ধনার পর সংবর্ধনা, আর্থিক পুরস্কার, বিজ্ঞাপনের মডেলিং ইত্যাদি। কিশোরি থেকে হঠাৎই নারী হয়ে ওঠা সিমান্তর সবচেয়ে বড় পাওনা প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে আবাসন ব্যবস্থার নিশ্চয়তা। এখন নেই তার সেই আগের দারিদ্রতা। পানির ওপর ভাসমান টং ঘর  ছেড়ে সিমান্ত উঠেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহার দেয়া ফ্ল্যাটে।
গৌহাটি-শিলং এসএ গেমসের মেয়েদের সাঁতারে মাহফুজা খাতুন শিলা জোড়া স্বর্ণপদক জিতে সিমান্তর চেয়ে বেশি সাড়া ফেলেন। বাংলাদেশ সাঁতার ফেডারেশনের বঞ্চনার শিকার হয়ে নৌবাহিনীর এই সাঁতারু অপেক্ষায় ছিলেন উচিত জবাব দেওয়ার। সুযোগটা পেয়েই গেলেন। জ্বলে উঠলে শিলা। পরপর ১০০ ও ৫০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে স্বর্ণপদক জিতে নিজেকে চেনান নতুন রুপে। ৭ ফেব্রুয়ারি দুপুরে এসএ গেমস ভারোত্তোলনে মাবিয়া আক্তার সিমান্ত বাংলাদেশের হয়ে প্রথম স্বর্ণপদক জিতেছিলেন। সন্ধ্যায় এই আনন্দকে দ্বিগুণ করেন লাল-সবুজের কৃতি সাঁতারু মাহফুজা খাতুন শিলা। তিনি মেয়েদের  ১০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে সেরা হয়ে বাংলাদেশকে দ্বিতীয় স্বর্ণ উপহার দেন। ওই দিন সোনা জিতে থেমে না গিয়ে মিডিয়াকে কথা দিয়েছিলেন গেমসে দ্বিতীয় স্বর্ণপদক জিতবেন শিলা। সত্যিই কথা রাখলেন বাংলাদেশের স্বর্ণজয়ী এই জলকন্যা। প্রথম স্বর্ণ জেতার পরের দিনই  ৫০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে ৩৪.৮৮ সেকেন্ড সময় নিয়ে সেরার খেতাব জিতলেন শিলা। দেশের পক্ষে এসএ গেমসে জিতলেন তৃতীয় এবং নিজের দ্বিতীয় স্বর্ণপদক। গড়লেন নতুন গেমস রেকর্ডও। এর আগে ১৯৯৭ সালে মেয়েদের ৫০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে শ্রীলঙ্কার রাহিমা মায়ুমি ৩৪.৯৭ সেকেন্ডে স্বর্ণ জিতে রেকর্ড গড়েছিলেন। ৮ ফেব্রুয়ারি বিকালে গৌহাটির ডক্টর জাকির হোসেন অ্যাকুয়েটিক কমপ্লেক্সে আরও একবার বেঁজে উঠলো ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’। বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতের সুরের মূর্ছনায় যেন মোহিত হয়ে গেলেন সেখানে উপস্থিত প্রায় শ’খানেক বাংলাদেশী। আনন্দে তাদের চোখ যেন ছলছল করে উঠলো। আবারো স্বর্ণ জিতলেন বাংলাদেশের শিলা। এ এক অন্যরকম অনুভুতি। সেদিন পুলে নামার আগেই আতœবিশ্বাসী ছিলেন শিলা। বলেই ফেললেন,‘আজও কিছু একটা করে দেখাবো।’ সত্যি কিছু একটা করেই দেখালেন যশোর জেলার অভয় নগরের নোয়াপাড়ার এই মেয়ে। স্বর্ণ জয়ের পর উচ্ছসিত শিলা মিডিয়াকে তার অনুভুতির কথা জানান। তবে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন বাংলাদেশ সাঁতার ফেডারেশনের কর্মকর্তাদের প্রতি। শিলা বলেন,‘আমার সার্ভিসেস দল বাংলাদেশ নৌবাহিনী এবং জাতীয় দলের কোরিয়ান কোচ তেগুন পার্কের উৎসাহেই আমি এবারের এসএ গেমসে দেশকে দু’টি স্বর্ণপদক উপহার দিতে পেরেছি। আমার এই সাফল্যে ফেডারেশনের কোনই অবদান নেই। ফেডারেশন কর্মকর্তারা বেশ কিছুদিন ধরে আমাকে অবহেলা করে আসছিলেন। তাদের এই অবহেলা এক সময় আমাকে হতাশ করেছে। ভেবেছিলাম সাঁতার ছেড়ে দেবো। কিন্তু কোচ পার্ক ও নৌবাহিনীর কর্মকর্তাদের উৎসাহ আমাকে সাঁতারে রেখে দিলো। আগ্রহ জন্মালো ভালো কিছু করে দেখানোর। জিদ চেপে গেলো এসএ গেমসে স্বর্ণ জিতবোই। আল্লাহ আমার সহায় ছিলেন বলে আমি সফলতা পেয়েছি।’ তাঁর ওই সাফল্য ছিল অপ্রত্যাশিত। সংকল্প আর জিদকে তিনি রাঙিয়ে তোলেন সাফল্যের রঙে। জোড়া স্বর্ণ জয়ে মাবিয়ার মতো পাল্টে গেছে তাঁর জীবনও। জীবনের জুটিতে সঙ্গী করে নিয়েছেন এসএ গেমসে  সোনাজয়ী আরেক সাঁতারু শাহাজাহান আলী রনিকে, দুজন বিয়ে করেছেন এ বছরই।
এসএ গেমসের গত ১১ আসর মিলিয়ে বাংলাদেশের জেতা ৬৩ স্বর্ণপদকের মধ্যে ১৫টিই এসেছিল সাঁতার থেকে। ২০১০ ঢাকা এসএ গেমসে নিজেদের পুলে ৬টি রুপা ও ১০টি ব্রোঞ্জপদক জিতেছিলেন বাংলাদেশ সাঁতারুরা। ২০০৬ সালে সর্বশেষ সাঁতার ডিসিপ্লিন থেকে সোনার পদক পেয়েছিল লাল-সবুজরা। এবছর গৌহাটি-শিলং এসএ গেমসে দুই স্বর্ণ ও ১৪টি ব্রোঞ্জসহ মোট ১৬ পদক জয় করেন বাংলাদেশের সাঁতারুরা। যাদের মধ্যে শিলাই উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর। বছরটা আলোচিত ছিল এসএ গেমসের জন্যই। গেমসের গত আসরে ঢাকায় ১৮টি সোনা জিতে বাংলাদেশ। এবার মাত্র চারটি। সিমান্ত, শিলার পর গেমসের চতুর্থ সোনাটি আনেন শুটার শাকিল আহমেদ। তিনি ১০ মিটার এয়ার পিস্তলে স্বর্ণ জিতলেও আগে সাফল্য আসা ১০ মিটার এয়ার রাইফেলে এবার হয়েছে ভরাডুবি। কমনওয়েলথে রুপাজয়ী আবদুল্লাহ হেল বাকি নামের প্রতি সুবিচার করতে পারেননি। অ্যাথলেটিক্স, সাইক্লিং ও ভলিবল ছাড়া এবার অন্য সব খেলায় পদক এসেছে এসএ গেমসে।
গৌহাটিতে ব্যর্থ হলেও বছর শেষে জাতীয় অ্যাথলেটিক্সে দেশের দ্রুততম মানব –মানবীর খেতাব ধরে রাখেন মেসবাহ আহমেদ ও মানবী শিরিন আক্তার। এবার ছিল অলিম্পিকেরও বছর। বাংলাদেশের প্রথম ক্রীড়াবিদ হিসেবে সরাসরি রিও অলিম্পিকে খেলতে যান গলফার সিদ্দিকুর রহমান। তাঁর সঙ্গী হয়ে ব্রাজিল গিয়েছিলেন অ্যাথলেট মেসবাহ, শিরিন, আরচ্যার শ্যামলী রায়, সাঁতারু মাহফিজুর ও সোনিয়া আক্তার এবং শুটার আবদুল্লাহ হেল বাকি।
মেয়েদের সাফল্য  শুধু এসএ গেমসেই সীমাবদ্ধ ছিলো না। ফুটবলেও তারা অসাধ্য সাধন করেছে। এএফসি অনুর্ধ্ব-১৬ মহিলা চ্যাস্পিয়নশিপের বাছাই পর্বে অপ্রতিরোধ্য ছিলো লাল-সবুজের কিশোরিরা। ২৭ আগস্ট থেকে ৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঢাকায় অনুষ্ঠিত হওয়া এ আসরে বাংলাদেশ অনুর্ধ্ব-১৬ কিশোরি দল অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়ে চূড়ান্ত পর্বে জায়গা করে নেয়। বাছাই পর্বের ‘সি’ গ্রুপে বাংলাদেশের মেয়েরা ইরানকে ৩-০, সিঙ্গাপুরকে ৫-০, কিরগিজস্তানকে ১০-০, চাইনিজ তাইপেকে ৪-২ ও আরব আমিরাতকে ৪-০ গোলে হারিয়ে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করে। ফলে ২০১৭ সালে থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত এএফসি অনুর্ধ্ব-১৬ মহিলা চ্যাস্পিয়নশিপের চূড়ান্ত পর্বে খেলার কৃতিত্ব দেখালো বাংলাদেশ অনুর্ধ্ব-১৬ কিশোরি দল। ২৯ ডিসেম্বর দেশের নারী ফুটবলের আরেকটি উজ্জল দিন এনে দিলেন জাতীয় মহিলা ফুটবল দলের অধিনায়ক সাবিনা খাতুন। এদিন ভারতের শিলিগুঁড়িতে অনুষ্ঠিত সাফ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপের চতুর্থ আসরে ‘বি’ গ্রুপে  নিজেদের প্রথম ম্যাচে আফগানিস্তানের বিপক্ষে তার কৃতিত্বেই বড় জয় পেয়েছে বাংলাদেশ। সাবিনার হ্যাটট্রিকসহ পাঁচ গোলের উপর ভর করেই লাল-সবুজরা ৬-০ গোলে হারায় আফগানদের। ম্যাচে দেশের পক্ষে অন্য গোলটি করেন স্বপ্না।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন