বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

আদিগন্ত

সক্রেটিস, গ্রিক দেবী এবং মূর্তি-ভাস্কর্য

| প্রকাশের সময় : ২৪ মার্চ, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মাহমুদ ইউসুফ : প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসের নাম জানে না এমন মানুষ দুনিয়ার বুকে নেই বললেই চলে। দেশে-বিদেশে সব মানুষই জানে সত্য বলার অপরাধে হেমলক বিষপানে তার মৃত্যুদ- কার্যকর হয়েছিল। আর বিশ^ ইতিহাসের বিখ্যাত সব মৃত্যুদ-ের ঘটনাই বিতর্কিত। সেটা ভিন্ন কথা। শৈশবকাল থেকে ওস্তাদ, শিক্ষক, গুরুজনদের কাছে শুনে আসছি সক্রেটিস গ্রিসে সত্য বাণী প্রচার করায় তদানীন্তন শাসনকর্তা ও এলিট সোসাইটি এটা মেনে নিতে পারেনি। সরকার সক্রেটিসকে প্রাণদ-ে দ-িত করেন। কিন্তু সেই সত্য বাণীটি কী সেটা কেউ বলেন না। আমাদের গুরুজনেরাও হয়তো বিষয়টি অবহিত নন। কিন্তু গবেষক, ইতিহাসবিদ বা দার্শনিকদের অজানা থাকার কথা নয়। তারাও এ কাহিনীর খোলাসা করেন না। এটা রহস্যই বটে।
তবে সক্রেটিসের মৃত্যুদ-ের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে আলবেরুনীর ভারততত্ত্বে। তথ্যনির্ভর এ পুস্তকটি প্রাচীন ভারতবর্ষের ওপর রচিত প্রথম গবেষণাধর্মী কিতাব। আন্তর্জাতিকভাবে বইটি পঠিত, গৃহীত এবং স্বীকৃত। পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ^বিদ্যালয়ে বইটি পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্তও বটে। বইটির রচনাকাল ১০৩১ খ্রিস্টাব্দ। গ্রন্থনা করেন দ্বাদশ শতাব্দির শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী, দার্শনিক, মহাজ্ঞানী আবু রায়হান মুহাম্মাদ বিন আহমদ। জনসমাজে খ্যাত আলবেরুনী নামে। তিনি লিখেছেন, ‘সক্রেটিস নিজে যখন জনসাধারণের মতের বিরুদ্ধে মূর্তিপূজার প্রতিবাদ করেছিলেন এবং গ্রহনক্ষত্রকে ওদের ভাষায় ভগবান বলতে অস্বীকার করেছিলেন। তখন এথেন্সের ১২ জন বিচারকম-লীর মধ্যে ১১ জনই তাকে মৃত্যুদ- দিতে একমত হয়েছিল। সত্যের প্রতিষ্ঠার জন্য সক্রেটিসের মৃত্যু হয়েছিল। ভারতবর্ষে এইরূপ দার্শনিকের মতো কোনো লোক জন্মায়নি যার দ্বারা জ্ঞানের তেমন উৎকর্ষ সাধন হতে পারত। (আলবেরুনির ভারততত্ত্ব, বাংলা একাডেমি, টিকা ১৯, পৃ: ৮)
অতএব, দেখা যায় দুটি কারণে সক্রেটিসকে মৃত্যুদ- দেয় এথেন্স আদালত। এক. ভাস্কর্য, মূর্তি, ম্যুরাল, প্রতিমা  তৈরি ও পূজার প্রতিবাদ করেছিলেন; দুই.  গ্রহ, নক্ষত্র, সূর্য, প্রকৃতিকে ভগবান, স্রষ্টা বলতে অস্বীকার করেছিলেন। কারণ স্রষ্টা তো একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামিন। আলবেরুনী বলেছেন, সত্যের প্রতিষ্ঠার জন্যই সক্রেটিসের মৃত্যুদ- হয়। কী সেই সত্য? সত্যটা হলো মূর্তির বিরোধিতা। প্রতিমা, প্রতিকৃতি প্রতিষ্ঠায় প্রতিরোধ গড়া। সক্রেটিসের মৃত্যু প্রমাণ করে মাটি বা ইট-পাথরের ভাস্কর্য ম্যূরাল নির্মাণ, স্থাপন মিথ্যা প্রতিষ্ঠারই নামান্তর। সোজাসুজি বলতে গেলে মূর্তির স্বপক্ষশক্তি অসত্যের পক্ষভুক্ত। আর বিরোধিতাকারীরাই সত্যের পক্ষে।
মূর্তি-ভাস্কর্যের ইতিবৃত্ত : হযরত নুহ (আ.) নবীর কওম সর্বপ্রথম ভাস্কর্য, প্রতিমার প্রচলন করে। শুরুটা এভাবে- ইবলিশ তৎকালীন অধিবাসীদের পূর্ববর্তী পুণ্যবান ও নেককারদের প্রতিকৃতি বানিয়ে তাদের সম্মান ও ভক্তি শ্রদ্ধা জানাতে প্ররোচিত করে। ইবলিশ শয়তানের পরামর্শে তারা বেদী, ফলক, সৌধ, প্রতিমা তৈরি করে শ্রদ্ধা জানানো শুরু করে। এখান থেকেই কালক্রমে ব্যাপক আকার ধারণ করে মূর্তিপূজা, দেব-দেবতার আরাধনা। নুহ নবীই পৃথিবীতে সর্বপ্রথম মূর্তির বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সংগ্রাম শুরু করেন।
তবে প-িত জওহরলাল নেহেরু বিষয়টি নিয়ে আলাদা এক ইতিহাসের অবতারণা করেছেন। তিনি ১৯২৮ সালে লিখেন, আদিম যুগের মানুষেরা অনেক প্রাকৃতিক ঘটনার কারণই ঠিক ঠাক বুঝতে না পেরে ভয় পেত। ... নদী, পাহাড়, সূর্য, গাছ, পশু এদের সবকিছুকেই প্রাচীন মানুষেরা দেব-দেবী বলে মনে করত; কতগুলো ছিলো আবার অদৃশ্য মনগড়া ভূত। ভয় তাদের মনে লেগেই ছিলো, কাজেই তারা মনে করত দেবতা বুঝি তাদের শাস্তি দেবার জন্যই সব সময় ব্যস্ত। তারা ভাবত দেবতা বুঝি তাদেরই মতো কর্কশ আর নিষ্ঠুর; কাজেই একটা পশু, পাখি অথবা মানুষ বলি দিয়ে তারা চাইত দেবতাকে খুশি রাখতে। এই দেবতাদের পূজার জন্য ক্রমে ক্রমে মন্দির গড়ে ওঠতে লাগল। মন্দিরের মধ্যে একটা বিশেষ স্থান ছিল যাকে বলা হত ‘পূজা-ঘর’। সেখানে তাদের আরাধ্য দেবতার মূর্তি থাকত। চোখের সামনে কিছু না দেখে আর কেমন করে পূজা করবে? সেটা কঠিন। (জওহরলাল নেহেরু: পৃথিবীর ইতিহাস, অধ্যায় ২৫, পৃ: ১১১) পাঠকবৃন্দ মূর্তিপূজার আরও ইতিহাস জানতে প্রখ্যাত লেখক, গবেষক আবুল হোসেন ভট্টাচার্য রচিত ‘মূর্তিপূজার গোড়ার কথা’ বইটি দেখে নিতে পারেন।
ইসলাম ও মূর্তির সংঘাত চিরন্তন : ভাস্কর্য, ম্যুরাল, ছবি, ফটো, অবয়ব, পুতুল, প্রতিমার সাথে ইসলামের সংঘাত চিরন্তন। মানবসভ্যতার শুরু থেকে এ সংঘর্ষ, দ্বন্দ্ব, বিরোধ, মতদ্বৈততা আজও চলছে, চলবে চিরকাল, কিয়ামত অবধি। এটা মুসলিম-অমুসলিম সবারই জানা। তারপরও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মূর্তি-ভাস্কর্যের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। এটা ইমানদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধেরই নব কৌশল। যদি ছবি, মূর্তি বৈধই হতো তাহলে আমরা নবী, রাসূল (সা.) ও সাহাবিদের প্রতিকৃতি ঘরে ঘরে রেখে দিতাম ফায়দা হাসিলের স্বার্থে। বিশেষ করে নবীজী (সা.)-এর ভাস্কর্য পকেটে পকেটে থাকত। কিন্তু রাসুল (সা.) এসেছেন মূর্তির বিনাশ করতে, লালন করতে নয়, কায়েম করতে নয়। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘মূর্তি ও বাদ্যযন্ত্র উৎখাতের জন্যই তাকে প্রেরণ করা হয়েছে।’ (মাসিক নির্ঝর, জুন ২০০৯, পৃষ্ঠা ১৭)। কোনো মুসলমানই মূর্তিকে মেনে নিতে পারে না। তারপরও কেন এটাকে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে? দেশের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠানকে কেন বিতর্কিতকরণ? ভাস্কর্যের উদ্যোক্তা, নির্মাতা, স্থাপনকারী, পরিকল্পনাকারীরা সবকিছু জেনে বুঝেই শতকরা ৯০ ভাগ মানুষের বিশ^াসকে কটাক্ষ করছেন।
মূর্তি প্রসঙ্গে কোরআন মজিদের স্পষ্ট হুকুম- ‘তোমরা পরিহার কর অপবিত্র বস্তু অর্থাৎ মূর্তিসমূহ এবং পরিহার কর মিথ্যাকথন।’ (সূরা হাজ্জ : ৩০) ‘ইয়া রব, এরা (মূর্তি ও ভাস্কর্য) অসংখ্য মানুষকে পথভ্রষ্ট করেছে!’ (সূরা ইবরাহিম : ৩৬) আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, প্রতিকৃতি  তৈরিকারী (ভাস্কর, চিত্রকর) শ্রেণি হলো ওইসব লোকদের অন্তর্ভুক্ত যাদেরকে কিয়ামত-দিবসে সবচেয়ে কঠিন শাস্তি প্রদান করা হবে।’ (সহিহ বুখারি) আমর ইবনে আবাসা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেন ‘আল্লাহ তাআলা আমাকে প্রেরণ করেছেন আত্মীয়তার সর্ম্পক বজায় রাখার, মূর্তিসমূহ ভেঙে ফেলার এবং এক আল্লাহর ইবাদত করার ও তাঁর সঙ্গে অন্য কোনো কিছুকে শরিক না করার বিধান দিয়ে।’ (সহিহ মুসলিম) আউন ইবনে আবু জুহাইফা তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন যে, ‘রাসুল (সা.) সুদ ভক্ষণকারী ও সুদ প্রদানকারী, উল্কি অঙ্কনকারী ও উল্কি গ্রহণকারী এবং প্রতিকৃতি প্রস্তুতকারীদের (ভাস্কর, চিত্রকরদের) উপর লানত করেছেন।’ (সহিহ বুখারি)
কোনো প্রাণী, মানুষ, জন্তু, জানোয়ার, দেবতার মূর্তি নির্মাণ করা ইসলামি শরিয়ায় কঠিন কবিরা গুনাহ ও হারাম। মূর্তি বানানো, সংগ্রহ, মূর্তি সংরক্ষণ এবং মূর্তির খরিদ বা বিক্রয় ইত্যাদি সকল বিষয়ই কঠিনভাবে নিষিদ্ধ। মূর্তিপূজার কথা তো বলাই বাহুল্য, মূর্তি নির্মাণও কুফরি। কেউ কেউ মূর্তি ও ভাস্কর্যের মধ্যে বিধানগত পার্থক্য দেখাতে চান। এটা চরম ভুল। ইসলামের দৃষ্টিতে মূর্তি ও ভাস্কর্য দুটোই পরিত্যাজ্য। আল কোরআন ও হাদিসে এ প্রসঙ্গে যে শব্দগুলো ব্যবহৃত হয়েছে সেগুলো মূর্তি ও ভাস্কর্য দুটোকেই নির্দেশ করে। (মাসিক আল কাউসার, নভেম্বর ২০০৮)
জাতীয় ইদগাহ ময়দানের পাশে সর্বোচ্চ আদালত প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে আছে গ্রিক পুরাণের দেবী থেমিস। শাড়ি পরিহিত থেমিস এক হাতে দাঁড়িপাল্লা অন্য হাতে নাঙ্গা তলোয়ার। চোখ বাঁধা। পক্ষপাতমুক্ত হিসেবে জাহির করার জন্য তার চোখ বেঁধে দেয়া হয়েছে। শাড়ি বাঙালি নারীদের লেবাস। প্রাচীন গ্রিসের দেবী শাড়ি পেলেন কোথায়? যে সক্রেটিস এই দেবীর বিরুদ্ধে, মূর্তির বিপক্ষে সংগ্রাম করে মৃত্যুদ-কে বরণ করে নেন হাসিমুখে; সক্রেটিসের গুণগ্রাহী, উত্তরসূরী দাবিদার তথাকথিত প্রগতিশীলরা আজ মূর্তি প্রতিষ্ঠায় নিজেদের আত্মনিয়োগ করেছেন। কী বৈপরীত্য! একই চরিত্রের ভিন্নমুখী অভিনয়!
বাংলাদেশ গরিবদেশসমূহের একটি। অধিকাংশ মানুষ দিন আনে দিন খায়। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ট্যাক্সের টাকায় রাষ্ট্র চলে। কোনো নাগরিক আদালত পাড়া, অফিস, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রাস্তার মোড়ে মোড়ে বা দর্শনীয় স্থানে ভাস্কর্য তৈরি বা সংরক্ষণের জন্য ট্যাক্স দেয় না। সরকার পরিচালনা, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, সুশাসন, আইন শৃঙ্খলা রক্ষা, সুশিক্ষা, সমাজে শান্তি আনয়নের জন্য জনগণ আয়কর পরিশোধ করে। তাই যত্রতত্র মূর্তির প্রসার জনবিরোধী। দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষ ভূমিহীন। অথচ সৌধ, ফলক, ম্যুরাল, বেদী, সমাধি, মাযার, ভাস্কর্যের দখলে রয়েছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে হাজার হাজার হেক্টর জমি। তাছাড়া রাষ্ট্রীয় অপচয় তো আছেই। সম্পদ-সম্পত্তি, অর্থকড়ির অপচয়, অপব্যয় মহাঅপরাধ। আল্লাহুতায়ালা বলেন, “নিশ্চয়ই অপচয়কারী শয়তানের ভাই। আর শয়তান হচ্ছে তার প্রভুর প্রতি বড়ই অকৃতজ্ঞ।” (আল কোরআন : সূরা বনী ইসরাঈল: আয়াত ২৭)  
শেষ কথা হলো- কোনো কল্পিত, মনগড়া, বানোয়াট দেবী ন্যায়বিচারের প্রতীক বা সত্যের মাপমাঠী হতে পারে না। ন্যায়বিচারের প্রতীক হলো মহাগ্রন্থ আল কোরআন। যার বাস্তব রূপ দিয়েছেন মানবশ্রেষ্ঠ মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.) এবং খুলাফায়ে রাশেদিন।
লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (2)
Jahan71 ২৪ মার্চ, ২০১৭, ৫:৫০ পিএম says : 0
Very good writing with logic and true information. Thanks
Total Reply(0)
S. Anwar ১৩ জুন, ২০১৭, ১১:৩৬ পিএম says : 0
এমন যুক্তিপূর্ণ বর্ণনা ও দলিল দ্বারা প্রমানিত সত্য অবগত হবার পরও যারা স্বহস্ত নির্মিত নিকৃষ্ট মুর্তি তথা মাটির ঢেলার প্রতি আকৃষ্ট হয় নিঃসন্দেহে তারা জ্ঞানান্ধ নরাধম।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন