লিটন এরশাদ : ডেটলাইন ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭। চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক ও বিজ্ঞাপন নির্মাতা প্রিয় বন্ধু মাসুদ কায়নাত জনমানুষের বাস্তব এবং পর্দার তারকা চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনকে নিয়ে একটি বিজ্ঞাপনচিত্রের শুটিং করছিলেন। মাগরেবের নামাজের কিছুটা সময় আগে। আমি শিল্পী সমিতির সামনে গেলাম। পেয়ে গেলাম নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের সহযোদ্ধা বিশিষ্ট অভিনেতা মিজু আহমেদকে। বললেন, অনেকদিন পর দেখা। এখন তো এফডিসি আসা ছেড়েই দিলেন। মাঝে মাঝে আসবেন। আসলে তো দেখা সাক্ষাৎ হয়। বললাম, দোয়া করবেন। এখন থেকে মাঝে মাঝে আসার চেষ্টা করবো। জানতে চাইলেন কেন এসেছি, বললাম একটি বিজ্ঞাপনের শুটিং আছে। ইলিয়াস কাঞ্চন মডেল। বললেন, কিসের বিজ্ঞাপন। বললাম, এঙ্গেলের (ভিএসএল কোম্পানীর)। ইতোমধ্যে মাগরেবের আজান পড়লো। বললেন, নামাজ পড়ে কাঞ্চনের সঙ্গে দেখা করব। বলেই, শিল্পী সমিতির ভেতরে গেলেন নামাজ পড়তে। কিছুটা সময়ের জন্য মিজু ভাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কাঞ্চন ভাইসহ এফডিসির মসজিদে গেলাম মাগরেবের নামাজ আদায় করতে। নামাজ শেষ করে শুটিংস্থল (মান্না ডিজিটাল সাউন্ড কমপ্লেক্স প্রাঙ্গণ)-এ এলাম। মিজু ভাই এসে উপস্থিত। কাঞ্চন ভাই মিজু ভাইকে দেখেই হাসিমুখে কুশল বিনিময় করলেন। দুই প্রিয় বন্ধুর এই মিলন- উপস্থিত সবাই বেশ উপভোগ করলেন। কিছুক্ষণ কথা বিনিময়। প্রায় দশ মিনিটের আড্ডায় কি যে প্রাণবন্ত ছিলেন দুই বন্ধু তা এখন ভাবলে দু’চোখ ভিজে ওঠে। দুই বন্ধুর কথপোকথনের মাঝেই কাঞ্চন ভাই জানতে চাইলেন মহাসমাবেশে আসোনি কেন? মিজু ভাই বললেন, শিল্পী সমিতির পিকনিক ছিল। যেহেতু তিন তিনবারের সভাপতি এবং দুইবার সাধারণ সম্পাদক ছিলাম তাই ওদের নিরাশ করতে পারিনি। কিন্তু মন পড়েছিল নিরাপদ সড়ক চাই’র মহাসমাবেশস্থল মহানগর নাট্যমঞ্চে। তখন কাঞ্চন ভাই বললেন, একদিন অফিস এসো- তোমার সম্মাননা স্মারকটি নিয়ে যেও। নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের শুরু থেকে যারা এখনো জড়িত এবারের মহাসমাবেশে তাদের কর্মের স্বীকৃতি হিসেবে সম্মাননা স্মারক প্রদান করা হয়েছে। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর হাত থেকে সম্মাননা স্মারক সবাই গ্রহণ করে। মিজু ভাই বললেন, কাঞ্চন আমি তোর হাত থেকেই নিব। তুই আমাদের শিল্পীসমাজের গর্ব। যে আন্দোলন আজ তোর হাত ধরে সৃষ্টি সেই আন্দোলন এখন কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে উপনীত হতে যাচ্ছে। যার একজন অংশীদার হিসেবে নিজেকেও ভাগ্যবান মনে করি। বৃহস্পতিবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) কাকরাইল এলাকায় যাব। চুল কাটাতে হবে। তখন গিয়ে অফিস থেকে সম্মাননা স্মারকটি নিয়ে আসব। থাকিস্। কাঞ্চন ভাই বললেন, এসো বন্ধু। আমি মিজু ভাইয়ের সাথে শিল্পী সমিতি পর্যন্ত এগিয়ে এলাম। সেখানে এসে দেখি শিল্পী সমিতির আঙিনায় মিশা সওদাগর, জায়েদ খান, ইলিয়াস কোবরা এবং ফাইটার নুরুল ইসলাম বসে আছেন। মিজু ভাইকে দেখে সবাই দাঁড়িয়ে গেলেন। শ্রদ্ধার সঙ্গে মিজু ভাইকে বসতে দিলেন। নানা কথা। প্রসঙ্গ শিল্পী সমিতির নির্বাচন। কুশল বিনিময়। এক পর্যায়ে মিজু ভাই উঠে গেলেন। যাবার আগে বলে গেলেন আসি। দিন যায়। বৃহস্পতিবারও চলে গেল মিজু ভাই আসেননি। পরেরদিন শুক্রবার আর অফিসে আসা পড়েনি। শনিবার ঠিক দুপুর বেলায় আমি অফিসে বসে আছি। মিজু ভাই এলেন। বললেন, বৃহস্পতিবার আসিনি। কারণ যে ছেলেটি চুল কাটবে সে ছিল না। শনিবার আসতে বলাতে আজ এলাম। কেমন আছো তোমরা। বললাম ভালো। বললেন রুমি (নাসিম রুমি) আসেনি। বললাম, বান্দরবান গেছেন। হেসে উঠলেন। বললেন, থাকলে ভালো লাগতো। নাসিম রুমিকে খোঁজার আরেকটি কারণ ছিল- তিনি রুমিকে অসম্ভব পছন্দ করতেন। সুখ-দুঃখের নানা আলোচনা করতেন। মিজু ভাইয়ের কাছের মানুষদের মধ্যে নাসিম রুমিও একজন। এরপর নানা কথা। সন্ধ্যায় নিসচার মহাসচিব শামীম আলম দীপেন এলেন অফিসে। সবাই মিলে অনেক কথা হলো। নিসচা চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন প্রিয় বন্ধু মিজু আহমেদের হাতে প্রতিষ্ঠাতা সদস্যের সম্মাননা স্মারকটি তুলে দিলেন। পাশে ছিলাম আমি (যুগ্ম মহাসচিব-নিসচা), মহাসচিব শামীম আলম দীপেন, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক মিরাজুল মইন জয় এবং প্রশিক্ষণ সম্পাদক ফারিহা ফাতেহ। খুব খুশি হলেন মিজু ভাই। কাঞ্চন ভাই বললেন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের দীর্ঘ ২৪ বছরের পথচলার কথা। সকলের অবদানের কথা। সময় ঘনিয়ে এলো। মিজু ভাই বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। এরপর আরও দুইদিন তিনি নিসচা অফিসে (কাকরাইল) এলেন। প্রিয়বন্ধুর (ইলিয়াস কাঞ্চন) সাথে বেশ কিছু সময় একান্ত সান্নিধ্যে কাটান। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা শুনলেন, বললেন। আমার সাথে কথা হলো। পারিবারিক নানা কথা। বললেন কয় ছেলে-মেয়ে। আমি বললাম দুই ছেলে। বললেন বড় ছেলের প্রথম জন্মদিনের পার্টিতে ছিলাম। ও এখন কি করে। বললাম টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ বর্ষে পড়ছে। কথাটা শুনে খুব খুশি হলেন। উল্লেখ্য আমার বড় ছেলে লিমনের (মামুন কায়সার লিমন) প্রথম জন্মদিনের জাঁকজমক অনুষ্ঠান পল্টনের তৎকালীন সিসিলি চাইনিজ রেস্টুরেন্টে (বিএনপি অফিসের পাশে) অনুষ্ঠিত হয়। সেই পার্টিতে মিজু ভাই গিয়েছিলেন। আজ থেকে ২৩ বছর আগের কথা তিনি খুব সযত্নে মনের স্মৃতিকোটায় লালন করে রেখেছিলেন। খুব খুব মনে পড়ছে সদা প্রাণোচ্ছল মিজু ভাইয়ের কথা। হয়তো সময় ঘনিয়ে এসেছিল বলে কাছাকাছি সময়ে বেশ কিছুটা সময় একসাথে থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল। আজ তিনি নেই- স্মৃতির পাতায় জ্বলজ্বল করছে সেই সময়ের প্রাণবন্ত সময়গুলো। ২৭ মার্চ মিজু ভাই বিনা নোটিশে এভাবে চলে যাবেন- তা কি আমরা মেনে নিতে পারবো? আমরা মনের সাথে যুদ্ধ করছি। অথচ জীবনযুদ্ধের সকল পাট চুকিয়ে মিজু ভাই চলে গেলেন না ফেরার দেশে। না, আপনি থাকবেন নিরাপদ সড়ক চা-ই এর সকল কর্মকান্ডের অনুপ্রেরণা হয়ে। কথা দিলাম আমরা আপনার অনুসারী হয়ে এদেশের সড়ক নিরাপদ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাব। পুনশ্চঃ- গত ২৮ জানুয়ারি ২০১৭ শনিবার নিরাপদ সড়ক চাই সংগঠনের ৭ম জাতীয় মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। মহাসমাবেশে বিশেষ কারণে অনুপস্থিত থাকার কারণে প্রতিষ্ঠাতা সদস্য চলচ্চিত্র অভিনেতা মিজু আহমেদ সেদিন সম্মাননা স্মারক গ্রহণ করতে পারেননি। যে কারণে ১৮ ফেব্রæয়ারি সন্ধ্যায় নিরাপদ সড়ক চাইর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে প্রতিষ্ঠাতা সদস্য চলচ্চিত্র অভিনেতা মিজু আহমেদ সম্মাননা স্মারকটি গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য, নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের সূচনা লগ্ন থেকে শক্তিমান চলচ্চিত্র অভিনেতা মিজু আহমেদ নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। দেশ থেকে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সামাজিক এই আন্দোলনে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পদে থেকে তিনি কার্যক্রম চালিয়ে গেছেন এবং সংগঠনকে গতিশীল করার অবদান রেখেছেন যার স্বীকৃতি হিসেবে তাকে সম্মাননা স্মারক প্রদান করা হয়। মৃত্যুপূর্ব তিনি সংগঠনের উপদেষ্টা পরিষদে ছিলেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন