স্টাফ রিপোর্টার : প্রতিবছর দেশে প্রায় ১৮ হাজার হার্টের রিং লাগানো হয়। হার্টের এই রিং নিয়ে বাণিজ্য হয় প্রায় ২০০ কোটি টাকা। রোগীদের জিম্মি করে এই বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একটি চক্র। এই রিং এর দাম নিয়ন্ত্রণে সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করায় বেঁকে বসেছে এই চক্রটি। তারা হাঠাৎ করে রিং বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে হাসপাতালে হার্টের রোগীরা পড়েছেন চরম বিপর্যয়কর অবস্থায়। অপারেশন টেবিলে অপারেশন করে রিং না পাওয়ায় রোগীকে ফিরিয়ে দেয়ার ঘটনাও ঘটছে।
সূত্র মতে, বেসরকারি হাসপাতালগুলোর গলাকাটা বাণিজ্য বন্ধে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর ২৮ প্রকারের হার্টের রিং-এর দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। হার্টের রিং বাণিজ্যের নৈরাজ্য বন্ধে সরকারের নেয়া পদক্ষেপ বানচাল করতে চিকিৎসক-ব্যবসায়ী একজোট হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রস্তাবের বিরোধিতা করে হাসপাতালে রিং সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে ওই চক্র। এতে দেশের অধিকাংশ হাসপাতালে রিং পড়াতে আসা রোগীরা রিং না পেয়ে অবর্ণনীয় ভোগান্তিতে পড়েন। যদিও আমদানিকারকদের মতে, হাসপাতালগুলোতে এখন রিং পড়ানো স্বাভাবিকই আছে। ভুল বোঝাবুঝিতে মাঝে কিছু কিছু হাসপাতালে বন্ধ ছিলো।
ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের তথ্য মতে, দেশে বছরে প্রায় ১৮ হাজার হার্টের রিং-এর চাহিদা রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, রোগীদের জিম্মি করে চক্রটি প্রতিবছর দেশে প্রায় ২০০ কোটি টাকার রিং বাণিজ্য করছে। আর এ বাণিজ্য বন্ধে সরকার রিং-এর দাম নির্ধারণ করে দেয়। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, দাম নিয়ন্ত্রণের ফলে রিং ভেদে ২০-৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত দাম কমে যাবে। ফলে নামি-দামি হাসপাতালের গলাকাটা বাণিজ্য বন্ধ হবে।
এদিকে ব্যবসায়ীদের একটি অংশ ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে রিংয়ের বেঁধে দেয়া মূল্য পুনর্বিবেচনার আবেদন করেছে। তবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এ বিষয়ে রয়েছেন কঠোর অবস্থানে। সূত্র মতে, গত মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলন ডেকে হার্টের রিং-এর দাম নির্ধারণ করে দেয় সরকার। নিবন্ধিত সব কোম্পানিকে এখন থেকে হার্টের রিংয়ের মূল্য, নিবন্ধন ও মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ মোড়কের গায়ে উল্লেখ করতে হবে বলে জানানো হয়। দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে অবশ্যই আমদানির ট্রেড প্রাইসের সাথে সরকার নির্ধারিত মার্কআপ অনুযায়ী ভ্যাট ১৫ শতাংশ এবং রিটেইলার কমিশন ১৬ শতাংশ ধরে নির্দেশক মূল্য ধরতে হবে। এর বেশি কোনভাবেই ধরা যাবে না বলে উল্লেখ করা হয়। সেক্ষেত্রে মানভেদে রিং-এর দাম নির্ধারিত হবে বলেও উল্লেখ করা হয়।
সিন্ডেকেটের হাসপাতালে রিং সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া সম্পর্কে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, হার্টের চিকিৎসায় ব্যবহৃত রিং জীবন রক্ষাকারী মেডিক্যাল ডিভাইস। বিভিন্ন হাসপাতালে এই রিং ভিন্ন ভিন্ন মূল্যে বিক্রি করা হচ্ছে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রোগীরা প্রতারিত হচ্ছেন। সাধারণ মানুষের স্বার্থ বিবেচনা করে রিংয়ের মূল্য নির্ধারণ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এ জন্য একটি কমিটিও করা হয়েছে। ওই কমিটি যাচাই-বাছাই করে রিংয়ের একটি মূল্য তালিকা প্রস্তাব করেছে। কমিটি যে সিদ্ধান্ত দেবে, তা সবাইকে মানতে হবে। তিনি জানান, জনগণের সরকার ব্যক্তি নয়; জনস্বার্থকে সব সময় প্রাধান্য দেবে।
রিং-এর মূল্য নির্ধারণ কমিটির সদস্য সচিব মো. সালাহ উদ্দিন জানান, জীবন রক্ষাকারী এ করোনারি স্ট্যান্ট আমদানি করতে ট্যাক্স লাগে না। তাই আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো ১ টাকায় কোনো পণ্য আনলে সেগুলো ১ দশমিক ৫ গুণ বেশি মূল্যে বিক্রি করতে পারবে। এর বেশি টাকা নেয়া যাবে না। এভাবেই ২৮ প্রকারের বিভিন্ন ধরনের স্ট্যান্টের দাম নির্ধারণ করা হয়। ফলে আগের চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম মূল্যে ক্রেতারা হার্টের রিং কিনতে পারবেন। কোন হার্টের রিংয়ের দাম কত কমবে তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্টভাবে তথ্য নেই। কত টাকায় আমদানি হয়েছে তার ওপর মূল্য নির্ধারিত হবে। তবে বর্তমান মূল্য আগের চেয়ে কম হবে।
ডা. রশিদ-ই মাহবুব বলেন, হার্টের রিং নিয়ে নৈরাজ্য প্রতিরোধে সরকার যে পদক্ষেপ নিয়েছে, তা প্রশংসনীয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সরকার রিং আমদানির পদক্ষেপ নিতে পারে। এ ক্ষেত্রে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরও ভূমিকা রাখবে। তাদের কাছ থেকে রিং কিনে নিয়ে রোগীর কাছে সরবরাহ করতে হবে।
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের সভাপতি, তত্ত¡াবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও জাতীয় অধ্যাপক ব্রিগেডিয়ার (অব.) আবদুল মালিক বলেন, হার্টের রিং বিক্রির নামে যে লাগামহীন ব্যবসা এতদিন ধরে চলছে, সরকার তার লাগাম টেনে ধরেছে। এ ক্ষেত্রে পিছু হটলে চলবে না। শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সবার আগে জনস্বার্থ বিবেচনা করতে হবে। তবে মান ও মূল্যের মধ্যে সমন্বয় থাকতে হবে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর মঙ্গলবার রিং-এর দাম নির্ধারণ করে দিলে গত বুধবার সরকারি হাসপাতালে রিং সরবরাহ বন্ধ রাখে আমদানিকারক সিন্ডিকেট। বেসরকারি হাসপাতালগুলোও দামের তারতম্য নিয়ে বিপাকে পড়ায় রিং বসানো বন্ধ করে দেয়। এতে রোগীরা অবর্ণনীয় ভোগান্তিতে পড়েন। তবে বৃহস্পতিবার কয়েকটি প্রতিষ্ঠান সরকারি হাসপাতালে সীমিত আকারে রিং সরবরাহ শুরু করলেও আগের মূল্যেই তা বিক্রি করেছে।
সূত্র মতে, ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর স¤প্রতি দুই ধরনের রিংয়ের সর্বনিম্ন মূল্য ২৫ হাজার এবং সর্বোচ্চ মূল্য ৫০ হাজার টাকা প্রস্তাব করেছে। বর্তমানে এই রিং রোগীদের কাছে ৫০ হাজার থেকে আড়াই লাখ টাকায় বিক্রি করা হয়। প্রতিবেশী ভারতে এই রিংয়ের সর্বনিম্ন খুচরা মূল্য আট হাজার ৯২৯ টাকা এবং সর্বোচ্চ মূল্য ৩৬ হাজার ৮০৪ টাকা। বাংলাদেশে প্রোমাউস ইলিমেন্ট রিং এক লাখ ২০ হাজার টাকা থেকে এক লাখ ৭০ হাজার টাকায় এবং ভারতে ভ্যাট ছাড়া ৩৬ হাজার ৪০৮ টাকায় বিক্রি হয়। একইভাবে রেজুলেট ইন্টিগ্রেটি রিং এক লাখ ৪০ হাজার থেকে দুই লাখ টাকায় এবং ভারতে ভ্যাট ছাড়া ৩৬ হাজার ৪০৮ টাকায়, জিয়েন্স প্রাইম রিং এক লাখ ১০ হাজার থেকে এক লাখ ৫০ হাজার টাকায় এবং ভারতে ভ্যাট ছাড়া ৩০ হাজার ৭৪৮ দশমিক ৭৭ টাকায় বিক্রি হয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, দেশে রিং আমদানি করে এ রকম ২১টি কোম্পানিকে ৪৭ ধরনের স্টেন্ট (রিং) আমদানির জন্য নিবন্ধন দেয়া হয়েছে। কয়েকটি বাদে অধিকাংশ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানই মূলত নিয়ন্ত্রণ করছে হার্টের রিং বাণিজ্য। এদের সাথে রয়েছে শতাধিক কার্ডিওলজিস্ট। তাদের মধ্যে সমঝোতা হলেই কেবল হার্টের রিং বিক্রি হয়। রোগীকে প্রতিটি রিং পরানো বাবদ ১০ থেকে ৫০ হাজার টাকা, কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরও বেশি কমিশন নেন চিকিৎসকরা। এতে হার্টের রিংয়ের মূল্য বেড়ে যায়। অসংখ্য গরীব মানুষ এই কমিশন বাণিজ্যের শিকার হচ্ছেন।
রিং সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে মেডি গ্রাফিক ট্রেডিং লি., কার্ডিয়াক কেয়ার লি., ওরিয়েন্ট এক্সপোর্ট ইমপোর্ট কোম্পানি লি., কার্ডিয়াক সলিউশন, ইউনিমেড লি., বায়োভাসকুলার লি., ওমেগা হেলথ কেয়ার, গেøাবাল করপোরেশন, দ্য হার্ট বিট, জিন ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল অ্যান্ড সার্জিক্যাল এক্সপোর্ট ইমপোর্ট লি., অ্যাডভান্সড মেডিটিস, বিজনেস লিংক, ইপিক টেকনোলজিস, হার্ট কোয়াক লি., জেএমআই হসপিটাল রিক্যুইসিট এমএফজি লি., বিভা ইন্টারন্যাশনাল, অ্যালায়ান্স মেডিকেল, লাইফ লাইন ইন্টারন্যাশনাল, আমিন সার্জিক্যাল, করোনারি কেয়ার অ্যান্ড মেডিক্যাল সার্ভিসেস, আর্টিক্যুলার, এশিয়া প্যাসিফিক মেডিকেলস লি, দ্য স্পন্দন লিমিটেড ইত্যাদি। এদের যোগসাজশেই এ অনৈতিক কাজ চলছে বছরের পর বছর। তবে রিং-এর দাম সহনীয় পর্যায়ে এবং সার্বিক জনগণের ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসতে ওষুধ প্রশাসনের কাছে ৪টি প্রতিষ্ঠান মূল্য তালিকা দেয়। এসব প্রতিষ্ঠানগুলো হলোÑ কার্ডিয়াক কেয়ার লি., ভেসটেক লি., মেডি গ্রাফিক ট্রেডিং লিমিটেড এবং ওরিয়েন্ট এক্সপোর্ট ইমপোর্ট কোম্পানী লি.।
এদিকে দেশের বাজারে বিক্রিত ২৮ ধরনের হার্টের রিংয়ের (করোনারি স্ট্যান্ট) মার্কেটিং রিটেইল প্রাইজ (এমআরপি) নির্ধারণ করে দিয়েছে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর। ফলে এখন থেকে সব সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে বাধ্যতামূলকভাবে এমআরপি মূল্যে রোগীদের কাছে রিং বিক্রি করতে হবে। ক্রেতাদের সুবিধার্থে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো যতদ্রæত সম্ভব বিভিন্ন সাইজের হার্টের রিংয়ের প্যাকেটের গায়ে ড্রাগ রেজিস্ট্রেশন নম্বর ও এমআরপি’র সিল মারবে। ওষুধ প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, গত বুধবার ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে ২৮ প্রকারের হার্টের রিংদর এমআরপি নির্ধারণ করা হয়। বৃহস্পতিবার আরও বেশ কয়েক প্রকারের হার্টের রিংদর এমআরপি নির্ধারণ করে দেয়ার জন্য আবেদনপত্র জমা পড়ে।
উল্লেখ্য, সারাদেশে মানসম্পন্ন, নিরাপদ ও কার্যকরী করোনারি স্ট্যান্ট অর্থাৎ হার্টের রিংয়ের মূল্য সহজলভ্য করার লক্ষ্যে গত ১১ এপ্রিল ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর সভা ডাকেন। ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন সংশ্লিষ্ট স্ট্যান্ট আমদানিকারক, ওষুধ শিল্প মালিক সমিতি, সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের মালিক-প্রতিনিধি, কর্মরত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ, বিএমএ ও ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের শীর্ষ কর্মকর্তারা। সভায় সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে হার্টের রিংয়ের দামের পার্থক্যের বিষয়টি উঠে আসে। সভায় একাধিক বক্তা জানান, বর্তমানে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য উন্নত দেশে ৭০০-৮০০ ডলার/ইউরোর বেশি স্ট্যান্টের দাম নেই। অথচ দেশের কোনো কোনো হাসপাতালে দেড় লাখ থেকে দুই লাখ টাকায়ও স্ট্যান্ট বিক্রি হচ্ছে। হাসপাতাল ভেদে একই কোম্পানির রিংয়ের মূল্যে ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকারও দামের পার্থক্যে রয়েছে বলে বক্তব্য উঠে আসে। প্রতিবেশী দেশ ভারতে স্ট্যান্টের মূল্য নির্ধারণ করা আছে বলে তথ্য দেন বক্তারা। বৈঠক শেষে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোস্তাফিজুর রহমানকে আহŸায়ক ও সহকারী পরিচালক মো. সালাহউদ্দিনকে সদস্য সচিব করে ১৭ সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটি হয়। পরে গত মঙ্গলবার ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে প্রাথমিকভাবে রিং-এর দাম নির্ধারণ করে দেয়। সভা চলাকালীন জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে ৩টি রিং সরবরাহকারী কোম্পানি রিং সরবরাহ বন্ধ রাখে। এ বিষয়টি নিয়ে বিশেষজ্ঞ কমিটি সভায় উষ্মা প্রকাশ করে। ওই দিনই আলোচনাক্রমে ২৮ প্রকারের স্ট্যান্টের এমআরপি নির্ধারণ করা হয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন