তৈমূর আলম খন্দকার
বিচার, আইন ও শাসন (নির্বাহী) এই তিন স্তম্ভ নিয়ে রাষ্ট্র গঠিত হলেও সব কিছুর মূলে রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রীয় শক্তিই প্রধান শক্তি, যার দ্বারা আইনের প্রয়োগ ও বিচারিক ব্যবস্থার বাস্তবায়ন হয়ে থাকে শাসন বা নির্বাহী বিভাগের মাধ্যমে। আইন বিভাগই প্রকারন্তরে শাসন বা নির্বাহী বিভাগ। কারণ যারা আইন প্রণয়ন করেন তারাই করেন নির্বাহী বিভাগকে পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ। সংসদীয় গণতন্ত্রে স্পিকার আইন বিভাগের প্রধান হলেও প্রধানমন্ত্রীই এর মূল নিয়ন্ত্রক। এমনকি রাষ্ট্রপতি ও স্পিকারকে অপসারণ করার ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতে। ফলে রাষ্ট্রীয় শক্তি (চড়বিৎ ড়ভ ঝঃধঃব) পুরোটাই ভোগ করেন প্রধানমন্ত্রী। বিচার বিভাগ আলাদা হলেও বিচারপতি নিয়োগ, প্রমোশন প্রভৃতি মূলত প্রধানমন্ত্রীর হাতেই ন্যাস্ত। সংবিধানে ষোড়শ সংশোধনী মোতাবেক এখন বিচারপতি অপসারণের বিষয়টি জাতীয় সংসদের উপর ন্যাস্ত হলেই ষোলকলা পূর্ণ হয়ে যায়। তখন সব কিছুই প্রধানমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে এবং এ নিয়েই চলছে ঞঁম ড়ভ ধিৎ। হাইকোর্ট সংবিধানে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করলে সংবিধানের ১০৩নং অনুচ্ছেদ বলে হাইকোর্টের উক্ত রায়ের বিরুদ্ধে নির্বাহী বিভাগের আপিল এখন আপিল বিভাগে বিচারাধীন, শুনানী চলছে। শুনানীর কালে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা ও বিচার বিভাগ প্রধানের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় প্রমাণ করে যে, বিচার বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সরকার তথা নির্বাহী বিভাগ কতটুকু বদ্ধপরিকর! গত ২৩ মে প্রধান বিচারপতি আদালতে অ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন যে, ‘নিন্ম আদালত মানেই আইন মন্ত্রণালয়’ এবং এর ২৯ দিন পূর্বে হবিগঞ্জ আইনজীবী সমিতির সম্বর্ধনায় তিনি বলেছেন যে, ‘বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সরকার চায় না। তারা বিচার বিভাগকে প্রতিদ্ব›দ্বী মনে করে।’
প্রধান বিচারপতিকে সাধুবাদ জানাই তার যথাযথ উপলব্ধির জন্য। সরকার মানেই প্রধানমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রীই দলীয় (রাজনৈতিক দল) প্রধান। কিন্তু দুঃখজনক হলেও এটাই সত্য যে, প্রধানমন্ত্রীর সাথে প্রশাসনের কর্মকর্তা অর্থাৎ প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীও হয়ে যায় দলীয় কর্মী বা নেতা। ফলে আইনের গতি প্রবাহিত হয় দু’ ভাবে, একই আইন সরকারি দলের জন্য পরিবেশন করা হয় সুস্বাদু খাদ্য হিসাবে, বিরোধী দলের জন্য যা হয়ে যায় ‘তিতো’। কারাগারগুলি বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের দ্বারা ভরপুর, মিথ্যা মামলা ও চার্জশিট নিত্যদিনের সাথী এবং পুলিশের ভাষাই হয়ে যায় আদালতের ভাষা। কারণ জজ, ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরি যাদের হাতে সেই মন্ত্রণালয়ই এখন উভয় পক্ষের অভিভাবক। প্রধান বিচারপতি বিষয়টি উপলব্ধি করে যখন তার মন্তব্য প্রকাশ করেন তখন আইন মন্ত্রণালয় প্রধান বলেন, ‘কোন দেশের প্রধান বিচারপতি কি এতো কথা বলে?’ কথাটির পুনরাবৃত্তি করে মন্ত্রী দৃঢ়তার সাথে বলেছেন যে, ‘জবাব দিলে ঝামেলা বৃদ্ধি পাবে।’ প্রধানমন্ত্রী সব কিছুর নিয়ন্ত্রক বলেই আমলাদের বর্তমানে একমাত্র কাজ প্রধানমন্ত্রী ও তার নিকটস্থ ব্যক্তিদের খুশী রাখা যার উত্তম পন্থা হচ্ছে বিরোধী দলককে নির্যাতন ও সরকারি দলকে সোহাগ করে আইনের গতিপথ কোথায় রোধ করা বা কোথাও স্টিম রোলার চালানো।
বিভিন্ন কারণে মানুষ মনে করে যে, বিচার বিভাগ সরকারের নিয়ন্ত্রণে। এ ধারণা থেকে জনগণকে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব বিচার বিভাগের। বিচারকগণ মনমগজে নিজেদের যদি স্বাধীন মনে না করেন তবে আইন করে বা বক্তৃতা বিবৃতির মাধ্যমে বিচার বিভাগকে স্বাধীন বানানো যাবে না। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষায় ‘স্বাধীনতার’ স্বার্থে সংশ্লিষ্ট সকলেরই সক্রিয় হওয়া উচিৎ।
গত ৩০ এপ্রিল প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেছেন, ‘সুপ্রিম কোর্ট যদি দেখে দেশে আইনি শাসন হচ্ছে না। শুধু দুই-তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্যই (এমপি) নয়, পুরো সংসদ মিলে যদি সংবিধানকে পরিবর্তন করে দেয়, জনগণের অধিকার ক্ষুণœ করে কোন আইন সংবিধানের মূলনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলে তা বাতিল করতে সুপ্রিম কোর্ট পিছপা হবে না।’ প্রধান বিচারপতির এ বক্তব্যে বুঝা যায় যে, তিনি জনগণের অধিকার রক্ষায় বদ্ধ পরিকর। তার বক্তব্যে এটাও প্রতিয়মান হয় যে, দেশে আইনের শাসন নেই। এ মর্মে ব্যাখ্যা দিলে কয়েক ডজন বই প্রকাশ করা যাবে, কিন্তু কাহিনী শেষ হবে না। প্রধান বিচারপতি বিষয়টির প্রতি কতটুকু যতœবান রয়েছেন তা সময়ই বলে দিবে।
বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র ঔপোনিবেশিক ভাবধারায় গঠিত। দেশ দু’বার স্বাধীন হলেও এ ঔপনেবেশিক হীনমান্যতা থেকে আমলারা বেরিয়ে আসতে পারেননি। আমলারা ন্যায় অন্যায় বুঝেন না, তারা বুঝেন যার কাছে ক্ষমতা তাকেই তুষ্ঠ রাখা। গণতন্ত্রের জন্য এ দেশের মানুষ একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে দেশকে স্বাধীন করেছে। সেই ‘স্বাধীনতা’ ঔপোনিবেশিক ভাবধারার নিকট জিম্মি হয়ে পড়েছে। সংবিধান রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন। সংবিধানের অনুচ্ছেদ-২১(২) মতে ‘সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্ঠা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য।’ সংবিধানের ৭(১) মতে ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতায় প্রয়োগ এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্ব কার্যকর হইবে।’ উপধারা ২ মতে ‘জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তি রূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্যকোন আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসামঞ্জস্য হয়, তাহা হইলে সে আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ ততখানি বাতিল হইবে।’
‘সংবিধান’ ও ‘জনগণ’কে একত্রে মিলিয়ে যদি আলোচনা করি তবে এটাই পরিষ্ফুটিত হয় যে, জনগণের জন্য এই সংবিধান ও রাষ্ট্র। বাংলাদেশে সাংবিধানিকভাবে কোন ইখটঊ ইখঙঙউ নাই, যাদের জন্য একই আইন দু’ভাগে ব্যবহৃত বা প্রয়োগ হতে পারে। বিচারপতি নিয়োগ যোগ্যতায় নয় বরং দলীয় বিবেচনায় হয়ে আসছে যা প্রতিরোধে হাইকোর্টে রিট, রুল জারী ও রায় পর্যন্ত গড়িয়েছে। দলীয় বিবেচনা যদি বিচারপতি নিয়োগের মাপকাঠি হয় তবে বিচারকের বিচারিক সিদ্ধান্ত দলীয় বিবেচনায় হবে এটাইতো স্বাভাবিক। প্রধান বিচারপতি এস.কে সিনহা এক সময় বলেছিলেন যে, সি.আর.পি.সি’র ‘সি’ বুঝে না এমন আইনজীবীকেও (দলীয় বিবেচনায়) পাবলিক প্রসিকিউটর নিয়োগ দেয়া হয়। এতো গেল বিচার বিভাগের অবস্থা। আমলাদের অবস্থা কী?
জনগণ তাদের নিকট থেকে কতটুকু ইনসাফ পাচ্ছে? বিষয়টি খুবই গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে পরিষ্কারভাবে পরিষ্ফুটিত হয় যে, ব্রিটিশ আমলের ঔপনিবেশিক আমলাতান্ত্রিক আচরণ ও স্বাধীন দেশের আমলাতান্ত্রিক আচরণ একই, এখানে অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। ঔপনিবেশিক সিষ্টেম থেকে শাসন শোষণের যে আচরণ, তা সম্পূর্ণই আমলারা অনুকরণ করছে, কিন্তু সাংবিধানিক ‘সেবা’ আচরণ ও মানসিকতা তাদের মধ্যে এখনো গড়ে উঠেনি। ফলে জনগণকে তার বিষফল ভোগ করতে হচ্ছে, সংবিধানে যাই লিপিবদ্ধ থাকুক না কেন।
বাংলাদেশের আমলাদের টার্গেট দায়িত্ব পালন নয়, বরং কর্তৃপক্ষকে তুষ্ঠ রেখে সুবিধামত লোভনীয় পোস্টিং ও প্রমোশন হাসিল করে অর্থ বিত্তের মালিক ও রাজধানীতে বাড়ি-গাড়ির মালিক বনে যাওয়া। বিসিএস ক্যাডার সার্ভিসের আমলাদের প্রমোশন এখন সিনিয়রইটি বা যোগ্যতার ভিত্তিতে হয় না বরং তাদেরই প্রমোশন ও লোভনীয় পোস্টিং হয় যারা ন্যায়-অন্যায়, বিচার-বিশ্লেষণ না করে ক্ষমতাসীনদের তুষ্ঠ রাখতে পারে। সম্প্রতি জাতীয় পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে যে, ১১ জন উচ্চ পদস্থ আমলা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সরকার দলীয় মনোনয়ন প্রার্থী হতে চান, যাদের সকলেই সচিব পদ মর্যাদা থেকে অবসরে গিয়েছেন। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ মোতাবেক ১১ আমলা তাদের নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় কর্মকাÐ শুরু করে দিয়েছেন। এতে প্রতীয়মান হয় যে, চাকরি করাকালীন সময়েও তারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসাবে নিরপেক্ষ দায়িত্ব পালনের পরিবর্তে সরকারি দলের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বিরোধী দলকে বঞ্চিত করে জনসেবার পরিবর্তে দলবাজিই বেশি করেছেন। উক্ত ১১ জন অবসরপ্রাপ্ত সচিবের মধ্যে রয়েছে সদ্য বিদায়ী সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব, এই সচিবের নগ্ন হস্তক্ষেপে অনেক নিরপেক্ষ স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানগুলি দলীয়করণের শিকার হয়েছে।
বাংলাদেশে স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণ প্রতিষ্ঠানগুলি অর্থাৎ বেসরকারি স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের উপর সরকারের কোনো খবরদারী নেই যতক্ষণনা পর্যন্ত ১৯৬১ সনের ৬৬নং অর্ডিন্যান্সের ৯ ও ১০নং ধারা মোতাবেক তহবিল তসরুপ বা সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান কর্তৃক আইন বা নৈতিকতা বর্হিভূত কোন কাজ না করে, যদি অনুরূপ কোনো কাজ করে যথাযথ ব্যাখ্যা তলব করতঃ সরকারের অনুমোদনক্রমে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা সরকার সংরক্ষণ করে। কিন্তু বাস্তবতা এই যে, নির্বাচনগুলিতে সরাসরি হস্তক্ষেপ করা বা প্রভাব খাটানোর ক্ষমতা সমাজ কল্যাণ অধিদপ্তরের নেই। কিন্তু সরকার দলীয় লোক স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে বসানোর জন্য সমাজকল্যাণ অধিদপ্তর নির্লজ্জের মতো কাজ করে। যেমন বাংলাদেশ জাতীয় বধির সংস্থা, একটি অরাজনৈতিক, স্বেচ্ছাসেবী জাতীয় প্রতিষ্ঠান; যার কাজ বধিরদের স্বার্থ সংরক্ষণে কাজ করা। এ সংস্থাটি স্বাধীনতার পূর্ব থেকে গঠিত এবং একটি নির্বাচিত কমিটি দ্বারা পরিচালিত। ২০১২-২০১৫ এবং ২০১৬-২০১৯ কার্যকরী পরিষদে বিএনপি সমর্থিতরা জয়লাভ করায় সমাজকল্যাণ অধিদপ্তর রাজনৈতিক প্রভাবে এমন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে যা নিরসনে সংস্থাকে গলদগর্ম হতে হয়েছে, যা নিয়ে অ্যাপিলেট ডিভিশন পর্যন্ত দৌড়াতে হয়েছে। সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরের প্রধান কাজ দেশের মানুষকে সমাজ সেবায় উদ্বুদ্ধ করে সামাজিক সংগঠন গড়ে তুলে তাকে দেখভাল (ঘঁৎংরহম) করা। কিন্তু তার পরিবর্তে সমাজ সেবা অধিদপ্তর যদি সমাজকর্মীদের মামলার দিকে ঠেলে দেয় তবে এটা কি যুক্তিযুক্ত? বিষয়টি অবশ্যই পর্যালোচনার দাবি রাখে। আমলারা রাজনীতির সাধ পেয়ে বসেছেন। ৫৮/৬০ বছর বয়স পর্যন্ত চাকরি করে রাজনৈতিক প্লাটফর্ম থেকে এম.পি পদে নমিনেশন পাওয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত করার জন্য বিভিন্ন পর্যায়ের আমলারা সরকারের দলীয়করণের প্রতি বেশি আনুগত্যশীল হয়ে যাচ্ছেন।
দলীয়করণের আনুগত্যের কমপিটিশন শুরু হয়ে যাওয়ায় কে কতটুকু সরকারকে খুশী করতে পারবে তার প্রতি প্রাধান্য রেখে সরকার দলীয় লোকদের ঋধাড়ঁৎ করে এবং বাকীদের প্রতি করে অবিচার যার প্রতিকার পাওয়ার জন্য নাগরিকদের হাইকোর্ট ও অ্যাপিলেট ডিভিশন পর্যন্ত দৌড়াতে হয়। প্রধান বিচারপতি মামলার সংখ্যা বৃদ্ধিতে অসন্তোষ প্রকাশ করে দ্রæত তা কমিয়ে আনার চেষ্টা করছেন বলে দাবি করেন। কিন্তু তাকে অবশ্যই উপলব্দি করতে হবে যে, কেন দিন দিন মামলার সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে? মানুষ যখন তার ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হয় তখনই আদালতের আশ্রয় নেয়। সরকার দলীয়রা সর্বক্ষেত্রে আনুকুল্য পাচ্ছে বলেই আইগত অধিকার লাভের জন্য বঞ্চিত মানুষ আদালতে আসে। ফলে মামলার জট দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকার নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্যও দিন দিন নতুন নতুন আইন প্রনয়ণ করে বিভিন্ন প্রকার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে একপেশে ভাবে, যার কারণেও মামলার এই আধিক্য।
আমলারা দলীয় রাজনীতি করেন বলেই তাদের উপরে অর্পিত দায়িত্ব তারা সঠিকভাবে পালন করেন না। কারণ তারা এখন অতিব্যস্ত রাজনীতিতে। একটি ঘটনা পর্যালোচনা করলেই আমলাদের দায়িত্বহীনতার বিষয়টি পরিষ্কার হবে। দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান গত ৮ মে বলেছেন যে, ‘পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন যদি যথাসময়ে দুদকে পাঠানো হতো, তা হলে হাওরের বিপর্যয় ঠেকানোর চেষ্ঠা আরো দৃঢ় হতো। ২০১৬ সালের ২১ এপ্রিল হাওরের দুর্নীতি নিয়ে ছোট্ট একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল, আমি ঐ দিনই পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন চাওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়ে ছিলাম। পরবর্তী সময় কমিশনের সচিব ১০ কার্যদিবসের মধ্যে রিপোর্ট চেয়ে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেন। উক্ত মন্ত্রণালয় ১০ দিনের পরিবর্তে ১০ মাস পরে অসম্পূর্ণ একটি প্রতিবেদন কমিশনে পাঠায়। যদি প্রতিবেদনটি যথা সময়ে কমিশনে পাঠানো হতো তবে হাওরের এ বছরের বিপর্যয় ঠেকানোর চেষ্ঠা আরো দৃঢ় হতো।’ এতো গেল হাওরের বিষয়। কিন্তু বাস্তবতা এই যে, দলীয়করণের নেশায় আমলারা এতোই নেশাগ্রস্থ হয়েছে যে, জাতীয় স্বার্থ বা ভুক্তভোগী জনগণের স্বার্থের প্রতি তারা দায়িত্ব পালন না করে কীভাবে সুবিধামত লোভনীয় পোস্টিং-প্রমোশন নিয়ে অঢেল অর্থ বিত্তের মালিক হয়ে নমিনেশন পেতে তৎপর হয়ে উঠেছেন।
বাংলা একাডেমি সাংবিধানিকভাবে একটি অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান যা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জন্মলগ্ন থেকেই চলে আসছিল। কিন্তু বর্তমানে নির্বাচিত কমিটি না থাকাও দলীয় অনুগত আমলাদের দ্বারা পরিচালিত বিধায় মেধা বিকাশেও পক্ষপাতিত্ব করা হচ্ছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশন ও বাংলা একাডেমি, এ সকল প্রতিষ্ঠান ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য সৃজন করা হয়নি বরং মেধা বিকাশই এদের প্রধান কাজ। সেখানেও প্রকাশ্যে দলবাজি। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক যেভাবে শেখ হাসিনা বা সরকারের গুণ-কীর্তন করেন তাতে আওয়ামী লীগের দলীয় ক্যাডারগণও স্তম্ভিত হয়ে যায়। প্রতি বছরই একুশে বই মেলায় দল মত নির্বিশেষে সকল লেখকের বই প্রকাশিত হয়। কিন্তু সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পায় শুধু সরকারি ঘরনার লোকেরা। গ্রন্থগার অধিদপ্তর প্রতি বছরই বই মেলা থেকে দেশব্যাপী বিতরণের জন্য বই ক্রয় করে। পূর্বে সরকার বই কিনতো লেখার মান নির্ণয়ের উপর, কিন্তু হালে সরকার বই মেলায় প্রকাশিত বই কেনে লেখার মান নির্ধারণের ভিত্তি করে নয়, বরং লেখকের নাম দেখে। সরকারি ঘরনার লেখকদের বই ছাড়া গ্রন্থাগার অধিদপ্তর অন্যকোন দলের লেখকদের লেখা বই ক্রয় করে না। এ বিষয়গুলি আমলাদের দলীয়করণের কারণে এখন চরম শিখরে।
হাওর প্লাবিত হওয়ার পিছনে যাদের দায়িত্ব অবহেলা হয়েছে তারা সরকারি ঘরনার রাজনীতি করেন বলেই দেশের সর্বনাশ হলেও তাদের চাকরি ঠিক রয়েছে। সিভিল প্রশাসনের পাশাপাশি পুলিশ প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত আমলারা দলীয়করণের প্রশ্নে আরো এক ধাপ এগিয়ে। পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে পুলিশকে ছাত্রলীগ বা যুবলীগ ক্যাডাররা পিটিয়েছে। কিন্তু যারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে পিটায় তারা সরকারি লোক বিধায়ই পুলিশের গায়ে তা লাগে না। এ ধরনের বহু ঘটনা আছে যা পত্রিকার পাতায় নিয়মিত আসছে।
আমাদের দেশের আমলাতন্ত্র সৃষ্টি হয়েছে বহু আগেই যা ব্রিটিশ থেকে পাকিস্তান হয়ে উত্তারাধিকার সূত্রে আমরা পেয়েছি। দেশ স্বাধীন হয়েছে দুইবার কিন্তু আমলাতান্ত্রিক পরিবেশ ঔপনেবেশিকই রয়ে গেছে, একটি স্বাধীন দেশের জন্য যা মোটেই প্রযোজ্য নয়।
লেখক : কলামিস্ট ও বিএনপি’র চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন