মক্কা হতে মদীনায় হিজরতের পর নামাজ-রোজার ন্যায় হজ্ব সঙ্গে সঙ্গে ফরজ হয়নি, হজ্ব ফরজ হয়েছে ৮ম হিজরীতে মক্কা বিজয়ের পর নবম সালে এবং ১০ম সালে রাসূলুল্লাহ (সা.) জীবনের প্রথম ও শেষ হজ্ব পালন করেন। দশম হিজরী সালের ২৬ জিলকদ তারিখে তিনি মদীনা হতে যাত্রা করেন এবং পবিত্র মক্কায় উপনীত হতে পথে ৯ দিন সময় লেগে যায়। যাত্রা পথের কাহিনী নি¤œরূপ:
সূরা নসর (ইযা জাআ নাসরুল্লাহ) নাজিল হবার পর রাসূলুল্লাহ (সা.) এর ধারণা হলো, তার ওফাতের সময় নিকটবর্তী হয়েছে। তাই তিনি প্রয়োজন মনে করলেন যে, এখন দুনিয়াবাসীর কাছে শরীয়ত ও আখলাক তথা নৈতিকতার সকল মৌলিক বিষয় জনসমাবেশে ঘোষণা করে দেয়া উচিত। কারণ হিজরতের পর এযাবত তিনি ফরজ হজ্ব আদায় করেননি। এর প্রধান বাধা ছিল মক্কার কোরেশ-কাফেরগোষ্ঠী। হোদায়বিয়ার সন্ধির পর এ সুযোগ সৃষ্টি হলেও নানা সুবিধার কথা বিবেচনায় এনে এ ফরজ আদায় করার বিষয়টি গুরুত্ব পায়। এখানেই প্রশ্ন জাগে হজ্ব কখন ফরজ হয়?
হজ্ব কবে কখন এবং কোথায় ফরজ হয়েছে, এ নিয়ে মতভেদ রয়েছে। সাধারণত মনে করা হয়ে থাকে যে, হিজরী নবম সালে হজ্ব ফরজ হয়, যখন ‘লিল্লাহি আলান্নাসি হিজ্জুল বাইতি, মানিস্তাতআ ইলাইহি সাবীলা’ নাজিল হয়। সুরা আলে ইমরানের এ অংশে আরো কয়েকটি বিষয় উল্লেখযোগ্য। যেমন সানাতুল ওফদ বা প্রতিনিধিদলের আগমন সংক্রান্ত আয়াত নাজিল হয়। এ সময় নাজরানের প্রতিনিধিদল রাসূলুল্লাহ (সা.) এর দরবারে উপস্থিত হয় এবং সে সময় জিযিয়ার নির্দেশ আসে। জানা যায়, তাবুক যুদ্ধের সময় জিযিয়ার নির্দেশ আসে। অর্থাৎ এ নির্দেশের কথা ঘোষণা করার জন্য রাসূলুল্লাহ (সা.) হজরত আবু বকর সিদ্দীক( রা.)কে মক্কায় প্রেরণ করেন। এটি হিজরী নবম সালের কথা। আরো নির্দেশ ছিল যে, মোশরেকগণ ‘নাজাম’ অপবিত্র; মসজিদে হারামের নিকটবর্তী হতে পারবে না। জিযিয়া প্রদানের নির্দেশও একই সালের ঘটনা। মক্কাবাসীরা ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপারে যে মনক্ষুণœ হয়েছিল জিযিয়া প্রদানের নির্দেশ তা অনেকটা লাঘব করে। নাজরান প্রতিনিধিদলের আগমনের পরের ঘটনা এটি, যখন তাদের মোবাহালা করার আহŸান করা হয়। অর্থাৎ- সূরা আলে ইমরানের উল্লেখিত আয়াত হিজরী নবম সালে হজ্ব ফরজ হওয়ার প্রমাণ বলে সীরাত লেখক ও বিভিন্ন তফসীরের ভাষ্য।
তবে অধিকাংশ উলামার মতে, হজ্ব ফরজ হয়েছিল হিজরী ৬ সালে, যখন এই আয়াত নাজেল হয়- ‘ওয়া আতিম্মুর হাজ্জা ওয়াল উমরাতা লিল্লাহ’। এ আয়াতে হজ্ব সম্পন্ন করার এবং উমরা পরিপূর্ণ করার নির্দেশ রয়েছে। এ যুক্তি খÐন করে বলা হয়েছে, প্রথমত এ আয়াত দ্বারা হজ্ব ফরজ হওয়া প্রমাণিত হয় না, যদি এতে হজ্ব ফরজ হওয়া প্রমাণিত হয়, তা হলে উমরাও ফরজ হওয়ার কথা। দ্বিতীয়ত এটাই সর্বসম্মত যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) হিজরী দশম সালে হজ্ব করেন। যদি এমন হতো যে, ৬ হিজরী সালে হজ্ব ফরজ হয়ে থাকতো তা হলে এতো বিলম্বে রাসূলুল্লাহ (সা.) হজ্ব পালন করবেন- এটা তো হতে পারে না। তাছাড়া ৬ হিজরীর পর তিনি মক্কা গমণ করেছেন, উমরা আদায় করেছেন কিন্তু হজ্ব করেননি। যদি সে সময় হজ্ব ফরজ হয়ে থাকতো তা হলে এটা কীভাবে সম্ভব যে, তিনি উমরা আদায় করেছেন, যা ফরজ নয়, অর্থাৎ- তার ওপর ফরজ হজ্ব তিনি আদায় করলেন না। এসব কারণ বিদ্যমান থাকায় এটাই সঠিক যে, হিজরী নবম সালে কিংবা তারো পরে হজ্ব ফরজ হয় এবং ফরজ হওয়ার পর দ্রæত তিনি হজ্ব পালন করেন।
হজ্ব ফরজ হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (সা.) কীভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন এবং কখন যাত্রা করলেন সে সম্পর্কে বিবরণ রয়েছে। সংক্ষেপে বলা যায়:
হিজরী দশম সালের জিলকদ মাসে ঘোষণা করা হয় যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) হজ্বের উদ্দেশ্যে মক্কা গমণ করবেন। দ্রæত এ খবর চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং তার সহযাত্রী হওয়ার জন্য দলে দলে লোকদের আগমন ঘটতে থাকে, ২৬ যিলকদ শনিবার রাসূলুল্লাহ (সা.) গোসল করেন এবং চাদর ও পাজামা পরিধান করেন। জোহরের নামাজের পর মদীনা হতে যাত্রা করেন এবং তার সকল বিবিকেও সঙ্গে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দেন। মদীনা হতে ৬ মাইল দূরত্বে অবস্থিত জুল-হোলায়ফা নামক স্থানে উপনীত হন। এটি মদীনাবাসীদের মীকাত। এখানে রাত যাপন করেন। দ্বিতীয় দিন আবার গোসল করেন। হজরত আয়েশা (রা.) নিজের হাতে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর পবিত্র দেহে আতর মাখেন। অতঃপর তিনি দু’রাকাত নামাজ আদায় করেন। অতঃপর তাঁর কোছওয়া নামের উটনির ওপর আরোহণ করেন এবং এহরাম বাঁধেন এবং উচ্চস্বরে বলতে বলতে থাকেন ‘লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক’।
উল্লেখ্য, হিজরী ৮ম সালে অর্থাৎ দুই বছর পূর্বে মক্কা বিজয়কালে রাসূলুল্লাহ (সা.) যেসব স্থানে নামাজ আদায় করেছিলেন, সেসব স্থানে লোকেরা বরকত লাভের উদ্দেশ্যে মসজিদ নির্মাণ করে রেখেছিল। রাসূলুল্লাহ (সা.) বিদায় হজ্বে গমনকালে ঐসব মসজিদে নামাজ আদায় করতে থাকেন।
মদীনা হতে যাত্রা করার পর রাসূলুল্লাহ (সা.) যেসব স্থানে যাত্রা বিরতি করেন, সেগুলোর বিবরণ নি¤œরূপ:
জুল হোলায়ফা: এ সম্পর্কে পূর্বেই বলা হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সাথে তালবিয়া (লাব্বায়েক) পড়তে পড়তে সাহাবাগণ সামনে অগ্রসর হচ্ছিলেন তখন তাদের সংখ্যা কতো ছিল সে হিসাব অজ্ঞাত, তবে হজরত জাবের (রা.) প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে বর্ণনা করেন যে, তিনি অংশগ্রহণকারী লোকদের প্রতি দৃষ্টিপাত করে দেখতে পান তার দৃষ্টির শেষসীমা পর্যন্ত লোকে লোকারণ্য। রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সঙ্গে তার ডানে বামে পেছনের লোকেরাও সমস্বরে তার প্রতিধ্বনি করতে থাকে এবং আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে উঠতে থাকে। তখন কমবেশি এক লাখ লোকের সমাবেশ ঘটেছিল বলে বর্ণিত হয়েছে।
রাওহা: এস্থানে পৌঁছার পর রাসূলুল্লাহ (সা.) দেখতে পান যে, একটি জবাইকৃত জঙ্গলী গাধা পড়ে রয়েছে। তিনি সাহাবাদের উদ্দেশ্যে বললেন, এর প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার প্রয়োজন নেই, এর মালিক আসতে পারে। কিছুক্ষণের মধ্যেই মালিক উপস্থিত এবং বলে, হে আল্লাহর রাসূলুল্লাহ (সা.) এ গর্দভের ব্যাপারে আপনার এখতিয়ার রয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) হজরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.) কে বলেন, এটি লোকের মধ্যে বণ্টন করে দাও।
আছায়া: মক্কার দিকে যাওয়ার পথে জোহফার মধ্যে এটি একটি প্রসিদ্ধস্থান অর্থাৎ এটি রুওয়াইসা ও আবাজের মধ্যবর্তী স্থান। এখানে পৌঁছার পর রাসূলুল্লাহ (সা.) দেখলেন যে, একটি হরিণ ছায়ার মধ্যে পড়ে রয়েছে, কেউ তাকে তীর দ্বারা আহত করে রেখেছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) এক ব্যক্তিকে তার নিকট দাঁড়িয়ে থাকতে নির্দেশ প্রদান করেন। সেখান থেকে সবাই চলে না যাওয়া পর্যন্ত সেখানে তাকে অপেক্ষা করতে হবে এবং হরিণের নিকট কাউকে যেতে দেবে না। এ দুটি কাহিনীর মধ্যে পার্থক্য এই যে, গাধাটি ছিল গায়রে মোহরেম কর্তৃক জবাইকৃত তাই রাসূলুল্লাহ (সা.) তা খাওয়ার অনুমতি দান করেন এবং হরিণের প্রতি তীর নিক্ষেপকারীর অবস্থা অজানা সে মোহরেম নাকি গায়রে মোহরেম হালাল, তাই তা খেতে নিষেধ করেন এবং এ ব্যাপারে সতর্কতা হিসেবে হরিণটি দেখার জন্য লোক নিয়োগ করে দেন।
আরাজ: রাসূলুল্লাহ (সা.) ও হজরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.) উভয়ের মালমাত্তা বহনকারী ছিল একই উট, যা হজরত সিদ্দীকে আকবর (রা.) এর গোলামের দায়িত্বে ছিল। তারা সবাই যখন আরাজ নামক স্থানে পৌঁছেন, তখনো গোলাম এসে পৌঁছেনি। রাসূলুল্লাহ (সা.), হজরত সিদ্দীক (রা.), হজরত আয়েশা (রা.) এবং হজরত আসমা (রা.) সবাই একই স্থানে বসে গোলামের অপেক্ষা করছিলেন। কিছুক্ষণ পর গোলাম আসে, কিন্তু তার সাথে উট ছিল না। হজরত সিদ্দীক (রা.) জিজ্ঞাসা করেন উট কোথায়? সে বলল, উট হারিয়ে গেছে। হজরত সিদ্দীক (রা.) বললেন, তুমি একটি উটের হেফাজতই করতে পারলে না একথা বলে তাকে প্রহার করতে লাগলেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) মুচকি হেসে বলেন, তোমরা দেখছ, এহরাম অবস্থায় এ আবার কি করছো? রাসূলুল্লাহ (সা.) শুধু এটুকু বলে মুচকি হাসেন কিন্তু তার গোলামকে প্রহার করতে নিষেধ করলেন না। গোলামকে আদব শেখানোর জন্য এরূপ কাজ করা হয়েছে।
আবওয়া: অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা.) আবওয়া নামক স্থানে পৌঁছেন। এ সময় সাহাবী ছাব ইবনে জাছামা (রা.) জঙ্গলী গাধার পেছনের রান হাদিয়া হিসেবে তার খেদমতে পেশ করেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) তা গ্রহণ করার পরিবর্তে প্রত্যাখ্যান করেন।
সারিফ: মক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী স্থান। মক্কা হতে ৬ মাইল, ৭ মাইল, ৯ মাইল দূরে বলে বিভিন্ন মত রয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) এখানে পৌঁছার পর ২ রাকাত নামাজ পড়েন। এখানে পৌঁছার হযরত আয়েশা (রা.) অসুস্থ হয়ে পড়েন। রাসূলুল্লাহ (সা.) তাকে হাজীদের ন্যায় সকল কর্ম পালন করতে বলেন, কিন্তু বায়তুল্লাহ শরীফের তাওয়াফ করতে নিষেধ করেন।
জিতাওয়া: সারিফ হতে মক্কার উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ (সা.) যাত্রা করেন এবং জিতাওয়া নামক স্থানে উপনীত হন। রবিবার রাত সেখানে অবস্থান করেন। ঐ সময় পর্যন্ত জিলহজ্ব মাসের চার তারিখ অতিবাহিত হয়ে যায়। ফজরের নামাজ তিনি সেখানে আদায় করেন। গোসল করেন এবং মক্কায় দিকে যাত্রা করেন। ছানিয়াতুল উলবিয়া নামক স্থানের দিক থেকে তিনি মক্কায় প্রবেশ করেন এবং সরাসরি মসজিদে গমন করেন। চাশতের সময় তিনি মসজিদে প্রবেশ করেন। এসময় তিনি ‘আল্লাহুম্মা আনতাম সালাম’ দোআটি পাঠ করেন। অতঃপর হাজরে আসওয়াদ (কালো পাথর) এর সামনে গিয়ে তা চুম্বন করেন এবং তাওয়াফ করেন। এরপর তিনি মাকামে ইবরাহীমের পেছনে এসে দু’রাকাত নামাজ পড়েন। এরপর পুনরায় তিনি কালো পাথর চুম্বন করেন এবং সম্মুখের দরজা দিয়ে ছাফা পর্বতের দিকে গমন করেন, নিকটবর্তী হলে আয়াত ইন্নাছ ছাফা ওয়াল মারওয়া পাঠ করেন। অতঃপর কেবলামুখী হয়ে তিনবার বলেন, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু (শেষ পর্যন্ত) এবং এরপর সাধারণ গতিতে মারওয়ার দিকে রওয়ানা হন। যখন বতনে ওয়াদীতে পদার্পণ করেন, তখন সেখানে সাঈ বা দ্রæত বেগে চলতে থাকেন। ওয়াদী শেষ হলে আবার মারওয়ায় উঠতে থাকেন। অনুরূপভাবে সাতবার সাঈ করেন। মারওয়াতেই তার সর্বশেষ সাঈ খতম হয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সাঈ ছাফা থেকে আরম্ভ হয় এবং মারওয়াতে শেষ হয় এটিই সর্বসম্মত অভিমত। (আগামী বারে সমাপ্য)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন