গত বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার রাতে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর ২০টি তল্লাশি চৌকিতে রোহিঙ্গা সশস্ত্র গ্রæপের হামলার জের ধরে সংঘটিত সংঘাতে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যসহ কমপক্ষে ৮৯ জন নিহত হয়েছে। এদের মধ্যে পুলিশসহ নিরাপত্তা বাহিনীর ১২ জন এবং সশস্ত্র গ্রæপের ৭৭ জন নিহত হয়েছে। আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (এআরএসএ) নামে একটি গ্রæপ হামলার দায় স্বীকার করেছে। রাখাইনের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের স্বার্থে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বাধীন কমিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার ২৪ ঘন্টার কম সময়ের মধ্যে এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। চূড়ান্ত প্রতিবেদনে যে ৮৮টি সুপারিশ করা হয়েছে, তার মধ্যে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব নিশ্চিতের পাশাপাশি তাদের চলাফেরার ওপর থেকে বিধিনিষেধ প্রত্যাহারের বিষয়ও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। রোহিঙ্গা সশস্ত্র গ্রæপের এই হামলার কারণে এ সুপারিশ বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হতে পারে। হামলার পাল্টা জবাব হিসেবে রাখাইনে সাধারণ মুসলমানদের উপর মিয়ানমার নিরাপত্তাবাহিনীর হামলা এবং হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়েছে। মানুষ বাড়ি-ঘর ছেড়ে যে যেভাবে পারছে পালাচ্ছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে প্রায় এক হাজার রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। বিজিবি ১৪৬ জনকে ফেরত পাঠাতে সক্ষম হয়েছে। নতুন করে হামলা এবং নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক রোহিঙ্গাদের উপর নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালানোর বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
রোহিঙ্গা সশস্ত্র গ্রæপের এ হামলার পেছনে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীরও দায় রয়েছে। এ মাসে নিরাপত্তা বাহিনীর দুর্গম পাহাড়ি এলাকাগুলোয় দমন অভিযান শুরুর পর থেকে পরিস্থিতির অবনতি হতে শুরু করে। পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসার সময় এ ধরনের দমন অভিযান কোনোভাবেই কাম্য ছিল না। এতে মিয়ানমার সরকারের চিরায়ত রোহিঙ্গা নির্মূলেরই মনোভাব প্রকাশিত হয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে রোহিঙ্গা মুসলমানরা মিয়ানমারের নাগরিক হলেও দেশটির সরকার তা স্বীকার করতে চায় না। বিভিন্ন সময়ে সে হামলা ও হত্যা মিশনের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে। যারা থেকে গেছে তাদের উপর অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়েছে এবং হচ্ছে। এমনকি তাদের মুক্তভাবে চলাফেরা করার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপ করে অনেকটা নিজ দেশে পরবাসী করে রাখা হয়েছে। রাষ্ট্র কর্তৃক এ ধরনের নাগরিক উচ্ছেদ নীতি পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। বলা বাহুল্য, কখনো কখনো নিপীড়িতদের মধ্য থেকেই প্রতিরোধ গড়ে উঠে। যার সাম্প্রতিক বহিঃপ্রকাশ ঘটে গত বছর অক্টোবরে রাখাইনের সীমান্ত চৌকিতে রোহিঙ্গা সশস্ত্র গ্রæপের হামলার মাধ্যমে। যদিও এ হামলা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। হামলার জবাব দিতে গিয়ে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী পুরো রাখাইনে মুসলমানদের উপর বর্বরতম হামলা চালায়। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়, নারী ও শিশুসহ শত শত মানুষ হত্যা করে এবং ধর্ষণ ও লুণ্ঠনের তান্ডব চালায়। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ তোলা হয়। হাজার হাজার নিরীহ রোহিঙ্গা সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশ, চীন, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমায়। বাংলাদেশেই প্রবেশ করে প্রায় ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা। মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর এ নৃশংসতা জাতিসংঘ, ওআইসিসহ বিভিন্ন দেশ নিন্দা জানায়। শান্তিতে নোবেল জয়ী দেশটির নেত্রী অং সান সূচি বিশ্বব্যাপী সাধারণ মানুষের কাছে চরমভাবে ধিকৃত হন। কফি আনানের নেতৃত্বে গঠিত কমিশনের কার্যক্রম নানাভাবে বাধাগ্রস্ত করা হয়। সব প্রতিকূলতার মধ্যেও কমিশন যখন চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে, তখন রাখাইন সশস্ত্র গ্রæপের হামলার বিষয়টি পুরো পরিস্থিতিকে আরও অবনতির দিকে ঠেলে দিয়েছে। এ ঘটনা অনভিপ্রেত ও দুঃখজনক। এতে রোহিঙ্গাদের উপর নিধনযজ্ঞ চালানোর একটি উসিলা মিয়ানমার সরকারের হাতে তুলে দেয়া হলো। বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে মুসলমান বিরোধী কথা বলার সুযোগ সৃষ্টি করা হলো।
হিংসা, প্রতিহিংসার জন্ম দেয়। দমন বিদ্রোহের সৃষ্টি করে। রোহিঙ্গা মুসলমানদের অস্বীকার এবং তাদের বিতাড়নে মিয়ানমার সরকারের যে প্রতিহিংসামূলক পদক্ষেপ, তা রোহিঙ্গাদের একটি গোষ্ঠীর মধ্যে প্রচÐ ক্ষোভ ও দ্রোহের জন্ম দিয়েছে। তবে তাদের মধ্য থেকে প্রতিরোধ বাহিনী গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কেউ ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করছে কিনা, এ বিষয়টি নিয়েও ভাবার অবকাশ রয়েছে। আমরা দেখেছি, বিশ্বের পরাশক্তিধর কিছু দেশ মুসলমানদের মধ্য থেকেই একশ্রেণীর বিপদগামী নিয়ে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী সৃষ্টি করে তাদের দিয়ে অপকর্ম করিয়ে তার দায় মুসলমানদের উপর চাপিয়ে দিতে। রাখাইনে হামলাকারী সশস্ত্র গ্রæপের পেছনে মুসলমান বিদ্বেষী কোনো অপশক্তি রয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। বলার অবকাশ রয়েছে, তারা রোহিঙ্গাদের পক্ষ হয়ে যে হামলা করেছে, তা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। এ ধরনের হামলা অযৌক্তিক ও অন্যায়। রাষ্ট্র শক্তির সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করে কোনো গোষ্ঠীই টিকে থাকতে পারে না। এটা অসম যুদ্ধ। এ যুদ্ধ থেকে তাদের সরে আসা উচিত। তাদের এটা পুরোপুরি ভুল পদক্ষেপ। এতে মিয়ানমার সরকারের রোহিঙ্গা নির্মূলের যে সিদ্ধান্ত, তার যৌক্তিকতাই প্রমান করবে। আমরা মনে করি, মিয়ানমারে নতুন করে যে সংঘাত সৃষ্টি হয়েছে, তা নিরসনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দ্রæত পদক্ষেপ নেবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন