জ্ঞান, বিবেক, বুদ্ধি, ভালবাসা আর মানবীয় গুণাবলীতে সমৃদ্ধ মানুষ আল্লাহর এক অনুপম সৃষ্টি। যেকোন প্রাণির চেয়ে মানুষের মধ্যে ভালবাসা বেশি। কারণ, মানুষ হচ্ছে আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা জীব। অন্যান্য যেকোন প্রাণি থেকে মানব শিশুকে আল্লাহ দুর্বল করে সৃষ্টি করেছেন। একটি পাখির ছানা অল্প সময়ের মধ্যেই দাঁড়াতে পারে, উড়তে শেখে। একটি মেষ শাবক বা ছাগল ছানা অল্প সময়ের মধ্যেই হাঁটতে শেখে, মায়ের দুধ খেতে শেখে। কিন্তু একটি মানব শিশু খুবই আসহায়ভাবে দুনিয়াতে আসে। তার বসতে, দাঁড়াতে, হাঁটতে কয়েক মাস সময় লাগে। এ জন্যে মানব শিশুর অধিক যত্ম প্রয়োজন হয়। প্রয়োজন নিরাপত্তা। মায়ের গর্ভে থাকা অবস্থা থেকেই শিশুর অধিকারের প্রতি নজর রাখতে হয়। শৈশব, কৈশর পর্যন্ত মানব সন্তানের শারীরিক, মানসিক উন্নতির জন্য বিশেষ যত্ম নেয়া মাতা, পিতা, আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী, সমাজ ও রাষ্ট্রের বিশেষ দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত। আদর-সোহাগ পাওয়া শিশুর অধিকার। শিশুদের আদর-সোহাগ করা সুন্নাত। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) শিশুদের বিশেষভাবে আদর-সোহাগ করতেন। তিনি শিশু হুসাইনকে মসজিদের ভেতরে পিঠের উপর চড়িয়ে হেঁটেছেন। রাস্তার পাশে কান্নারত এক ইয়াতিম শিশুকে বাসায় এনে নিজের সন্তানের মতো আশ্রয় ও ভালোবাসা দিয়েছেন। শিশুর স্বাভাবিক বিকাশে বিঘœ ঘটে এবং শিশু অধিকার ক্ষুণœ হয় এমন কোন কর্মকান্ড কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এমনকি যুদ্ধাবস্থায়ও নিরীহ নারী, শিশু, বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের উপর আঘাত করা সম্পূর্ণ অন্যায় ও অপরাধ।
শিশু অধিকার রক্ষায় ১৯৮৯ সালে নভেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে সবার মতামতের ভিত্তিতে ‘জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ’ পাশ করা হয়। এরপর ১৯৯০ সালের সেপ্টেম্বরে এটি আন্তার্জাতিক আইনের একটি অংশে পরিণত হয়। ইতিহাসে এটি হচ্ছে সবচেয়ে ব্যাপকভাবে গৃহীত মানবধিকার চুক্তি। জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্য দেশের মধ্যে বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১৯১টি দেশ চুক্তিটি অনুমোদন করেছে।
এই শিশু অধিকার সনদের ৫৪টি ধারায় শিশু কল্যাণ নিশ্চিত করাসহ সকল প্রকার শোষণ, বৈষম্য, অবহেলা এবং নির্যাতন থেকে তাদের রক্ষার বিবরণ রয়েছে। সনদে স্বীকৃত অধিকারের আওতায় স্বাস্থ্য, শিক্ষা, শিশু ও মা-বাবার সর্ম্পকে, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড, নাগরিক অধিকার, শিশু শোষণ এবং আইনের সাথে বিরোধ জড়িত শিশুসহ অনেক বিষয়ই অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
কিন্তু আজকে আমরা কী দেখছি? শিশুদের প্রতি অমানবিক জুলুম-নির্যাতনের মহোৎসব চলছে চারিদিকে। আক্রোশ সব যেন শিশুদের উপরেই। যুদ্ধ-সংঘাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিশুরা। পৃথিবীর নানা প্রান্তে শরণার্থী শিশুদের ঢল নেমেছে। বিশেষ করে মুসলিম শিশুরা অমানবিক নির্যাতনের শিকার। আগ্রাসন আর যুদ্ধের ফলে ফিলিস্তিন, সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়িাসহ বিভিন্ন দেশের লক্ষ লক্ষ শিশু আজ উদ্বাস্তু হয়ে পড়েছে। ভুমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে হাজার হাজার শিশুর সলিল সমাধি ঘটেছে, ঘটছে। আরব সাগরের সৈকতে ভেসে ওঠা শিশু আইলানের লাশ সাগরে লাখো শিশুর মৃত্যুর সাক্ষ্য দিয়ে গেছে। শিশুদের উপর জুলুম, নির্যাতন আর শিশু অধিকার লংঘনের সর্বশেষ উদাহরণ হচ্ছে রোহিঙ্গা শিশুরা। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির উপর মিয়ানমার সরকার, বর্মী সেনাবাহিনী আর সেদেশের উগ্রবাদী বৌদ্ধদের জুলুম-নির্যাতন ও গণহত্যার কারণে লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা আজ উদ্বাস্তু হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর মিয়ানমারের সরকার ও সেনাবাহিনীর নির্যাতনের ইতিহাস খুবই দীর্ঘ ও নির্মম। বিগত ২৫ আগস্ট থেকে এখন পর্যন্ত মিয়ানমারের রাখাইন(আরাকান) রাজ্যের রোহিঙ্গা মুসলমানদের শত শত গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম নারী, পুরুষ, শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। নাফ নদীতে ডুবে মারা গেছে শত শত নারী-পুরুষ-শিশু। এক মাসে প্রায় ৫ লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থী জীবন বাঁচাতে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে যার অধিকাংশই নারী ও শিশু। পালিয়ে আসার সময় নাফ নদীতে প্রায় প্রতিদিনই নৌকাডুবির ঘটনা ঘটছে। এতে ডুবে মরছে শিশু, নারী ও পুরুষ। এ ছাড়া অনেক লাশ ভেসে গেছে সাগরে। রোহিঙ্গারা যাতে আর মিয়ানমার ফিরে যেতে না পারে সেজন্য মিয়ানমার সীমান্তে স্থলমাইন পেতে রাখা হয়েছে। এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিয়ানমারে গণহত্যার ঘটনায় রোহিঙ্গাদের মধ্যে চরম মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে।
জাতিসংঘের বরাত দিয়ে সংবাদ মাধ্যম জানায়, বাংলাদেশে প্রবেশ করা শরণার্থীদের অর্ধেকই শিশু। তার মানে আড়াই লাখের বেশি শিশু আছে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে। আর এসব শিশুর মধ্যে কয়েক হাজার শিশু রয়েছে যাদের বাবা বা মা কেউই নেই। সেভ দ্য চিলড্রেন বাংলাদেশের প্রধান মার্ক পিয়ার্স বলেছেন, যদি এভাবে শরণার্থীরা বাংলাদেশে আসতে থাকে তাহলে বছরের শেষ নাগাদ শরণার্থীদের সংখ্যা দাঁড়াবে ১০ লাখ। এই শরণার্থী শিশুদের মধ্যে রয়েছে হাজার হাজার নবজাতক। ২ সপ্তাহে নোম্যান্স ল্যান্ডেই প্রায় ৪০০ শিশুর জন্ম হয়েছে। লাখো মানুষের ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে শিশুরা। সন্তানহারা বাবা-মা আর নিজেদের ঠিকানা না জানা শিশুদের সময় কাটছে অশ্রু বিসর্জন দিয়ে। আশ্রয়, খাদ্য ও পানির সংকট, রোগ ব্যাধিতে মত্যুর আশঙ্কায় প্রহর গুনছে অনেকে। তবে বাংলাদেশ সরকার, জনগণ এবং ত্রাণ সংস্থাগুলো ক্যাম্প ও ক্যাম্পের আশপাশ, সড়ক এবং পাহাড়ে আশ্রয় নেয়া শরণার্থীদের মানিয়ে নিতে অনবরত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রের হাজার হাজার আশ্রিত রোহিঙ্গা সর্দি, জ্বর, নিউমোনিয়া, ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে। তারা স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিতে রয়েছে। জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফের) শিশু সুরক্ষা প্রধান জ্যঁ লিবে আশ্রয়কেন্দ্র ঘুরে কক্সবাজারে এক বিবৃতিতে বলেছেন, অনুপ্রবেশকারীদের মধ্যে শতকরা ৬০ ভাগ শিশু এবং এরা শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। তারা স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে। গত কয়েক দিনে আশ্রয়কেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে, এখন এসব শিশু ব্যাপকভাবে ডায়রিয়া, সর্দি, জ্বরসহ পানিবাহিত নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। রোহিঙ্গা শিশুদের মধ্যে প্রায় শতকরা ৮৫ জনই রোগে আক্রান্ত হয়েছে। লাখো লাখো রোহিঙ্গা শরণার্থী অসহায় শিশুদের দিকে তাকানো যায় না।
রোহিঙ্গারা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসার সময় ন্যূনতম তিন দিন থেকে কারও কারও ১২ থেকে ১৩ দিনও সময় লেগেছে। এই দীর্ঘ সময় অর্ধাহার অনাহারে থেকে পায়ে হেঁটে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছেন। এর পরে বাংলাদেশে এসেও মাথা গোঁজার ঠাঁই করতে দুই-তিন দিন পেরিয়ে যায়। রুগ্ন দুর্বল শরীরে বৃষ্টিতে ভিজে রোহিঙ্গারা জ্বর, সর্দি, নিউমোনিয়ার মতো রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। নেতিয়ে পড়ছে ফুলের মতো কোমল শিশুরা। শরণার্থীদের ভিড়ে প্রতিনিয়তই মা, অভিভাবকদের হাতে থেকে হারিয়ে যাচ্ছে শিশু, কিশোররা। প্রচন্ড ঝড়ে নীরহারা, দিকহারা পাখির মতো একদিকে বুকফাটা আর্তনাদে মা ছটফট করছে আর অন্যদিকে অবসন্ন কচি শিশুরা গুনছে মৃত্যুর প্রহর। নৃশংস প্রতিহিংসার শিকার হয়ে অকালেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে বহু মানব শিশু।
তিন দিনের জন্যে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে আমাদের স্বচক্ষে দেখা চিত্র বর্ণনা করা কঠিন। এক হাতে শিশু পুত্র অথবা কন্যা আর অন্যহাতে নবজাতক কোলে নিয়ে শোক, দুঃখে, কষ্টে পাথর হয়ে বসে থাকা শত শত মায়ের দৃশ্য ছিল টেকনাফ-কক্সবাজার মহাসড়কের দু’পাশ জুড়ে। সামান্য একটু ত্রাণ অথবা একটি চকোলেটের জন্যে ছয়, সাত বা আট বছরের শিশুদের বাড়িয়ে দেয়া অসংখ্য হাত, বুভুক্ষু আর মলিন চেহারাগুলো এখনো কাঁদায় সবাইকে। না কেঁদে উপায় কি ঐ চেহারাগুলোর মধ্যে আমাদের ছেলে বা মেয়েদের প্রতিচ্ছবিও যে ভেসে উঠে। ত্রাণের জন্যে দশ-বার বছরের শিশুদের প্রাণান্তকর ছুটাছুটি কোনভাবে কি ভুলা যায়? পাহাড়ের ভাঁজ কেটে পলিথিনের তাবুর ভিতর পড়ে থাকা বৃদ্ধ-বৃদ্ধা আর অভুক্ত শিশুদের চিত্র অবলোকন করা অসহনীয়। লাখো রোহিঙ্গা শরণার্থী নারী, পুরুষ, শিশুর মধ্যে শুধুমাত্র শিশুদের অসহনীয় দুর্ভোগ, অবর্ণনীয় কষ্ট আর সীমাহীন ব্যথার কলমচিত্র অঙ্কন করতে পারলে তৈরি হতো বেদনার শত সহস্র মহাকাব্য।
লেখক: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন