তরুণরা হচ্ছে যেকোন জাতির প্রধান স্তম্ভ, জাতির স্নায়ু ও আত্মা। তারা যেকোন সুপ্ত জাতির জাগরণের প্রতিভূ। সংস্কৃতি ও সভ্যতার উন্নয়নের কারিগর। তারাই মাতৃভূমি রক্ষা ও দেশের ভূন্ডকে অখন্ড ও নিরাপদ রাখার অকুতভয় যোদ্ধা। তারাই জাগ্রত জ্ঞানের অধিকারী, সজীব। তারাই শারীরিক ও মানসিক শক্তির অধিকারী। তারা সকল ক্ষেত্রে নিত্যনতুন রীতি ও ধারা সূচনা করে। তারুণ্যের প্রধান বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে নতুন নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করা ও তা বাস্তবায়ন করা। এজন্য আল্লাহ্ তা‘আলা জীবনের এ মধ্যম স্তরকে শক্তি হিসেবে বর্ণনা করেছেন। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন: ‘আল্লাহ তিনি দুর্বল (শিশু) অবস্থায় তোমাদের সৃষ্টি করেন অতঃপর দুর্বলতার পর শক্তিদান (যৌবন) করেন, অতঃপর শক্তির পর দেন দুর্বলতা ও বার্ধক্য।’ (সুরা রূম: ৫৪)।
এ কারণে ইসলাম তরুণ ও যুবকদের উন্নয়ন এবং কল্যাণে বিশেষ পরিচর্যার কথা বলেছে। আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ সা. যুবকদের অনেক গুরুত্ব দিতেন। কেননা, অধিকাংশ যুবকই ইসলাম প্রচার ও প্রসারের প্রথম দিকে তাঁর পাশে থেকে তাঁকে সাহায্য-সহযোগিতা করেছে। ইসলাম প্রচার করেছে। এ কারণে তাঁরা পাহাড়সম কষ্ট, জ্বালা-যন্ত্রণা ও বিপদ-আপদ হজম করেছে। এমনকি ইসলামের স্বার্থে নিজের প্রাণকে আল্লাহর পথে উৎসর্গ করেছে।
রাসূল সা. তরুণ-যুবকদেরকে প্রথম থেকেই গুরুত্বপূর্ণ স্থানে মর্যাদা দিয়েছেন, যাতে তারা সমগ্র পৃথিবীতে ইসলামের সুমহান বাণী প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করতে পারে। এজন্য রাসূল সা. তাদের নীতি-নৈতিকতা ও উন্নত চরিত্র গঠন এবং জাতির নেতৃত্ব দেয়ার জন্য প্রস্তুতকরণে কাজ করেছেন। আবার তিনি তাদের এ বয়সে বেশি বেশি আমল ও ইবাদত করা জন্যও উদ্বুদ্ধ করেছেন। যেমন তিনি বলেছেন, ‘যেদিন আল্লাহর ছায়া ছাড়া আর কোন ছায়া থাকবে না, সেদিন সাত ব্যক্তিকে আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর নিজের (আরশের) ছায়ায় আশ্রয় দিবেন। তার মধ্যে দ্বিতীয় শ্রেণির ব্যক্তি হচ্ছে, সে যুবক যার জীবন গড়ে উঠেছে তার প্রতিপালকের ইবাদতের মধ্যে।’ (বুখারী ১/২৩৪)।
একই সাথে রাসূল সা. তরুণ-তরুণীদের কার্যক্ষমতা, বিনির্মাণ ও আক্বীদায় শক্তিশালী হতে উৎসাহিত করেছেন। যেমন তিনি বলেছেন, ‘(দেহমনে) সবল মু’মিন আল্লাহর নিকট দুর্বল মু’মিন অপেক্ষা বেশি প্রিয়। আর প্রত্যেকের মধ্যে কল্যাণ রয়েছে।’ (মুসলিম ৪/২০৫২)। আবার তিনি এটাও ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, শুধু শক্তিই সবকিছু প্রতিষ্ঠায় ক্ষমতা রাখে তা নয়, বরং এটাও সত্য যে, শক্তি যদি নিজের প্রাকৃতিক স্বভাবের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখা যায় তাহলে সমূহ বিপদের আশঙ্কা রয়েছে। যেমন তিনি বলেন, ‘(প্রকৃত) বলবান সে নয়, যে কুস্তিতে (অপরকে পরাজিত করে)। প্রকৃত বলবান (কুস্তিগীর) তো সেই ব্যক্তি, যে ক্রোধের সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে।’ (বুখারী ৫/২২৬৭)।
এভাবেই রাসূল সা. তরুণদের তৈরি ও তাদের শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব গঠনের কাজ করেছেন। যাতে তারা রিসালত গ্রহণ, দায়িত্বপালন এবং ইলামের মৌলিক বিধানের সাথে নিজেকে সর্বদা জড়িয়ে রাখতে সামর্থ্য হয়।
ইসলামের প্রথম দিকে যুবকদের ভূমিকা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। দা‘ওয়াতী কার্যক্রম প্রসারে যুবকদের বিরাট ভূমিকা ছিল। ইংরেজ প্রাচ্যবিদ মন্টোগোমারি ওয়াট তাঁর ‘মুহাম্মদ ফি মাক্কাহ্’ গ্রন্থতে বর্ণনা করেছেন যে, ইসলাম মূলত যুবকদের আন্দোলন ছিল। রাসূল সা. আরক্বাম বিন আবূ আরক্বাম নামক যুবকের বাড়ি থেকে এ আন্দোলন পরিচালনা করতেন। কেননা, দা‘ওয়াতী কার্যক্রম প্রচারের ওপর নির্ভর করে। আর যুবকরাই সেই দা‘ওয়াতকে মক্কা ও এর উপকণ্ঠে প্রচার করতেন। আর রাসূল সা.-এর হিজরতে সময় যুবক আলী বিন আবু তালিব রা.-এর ভূমিকা ছিল অকল্পনীয়। তেমনি রাসূল সা. তাঁর ওপর আস্থাও রেখেছিলেন।
যুবকদের ওপর রাসূল সা.-এর নির্ভরতার আরো একটি প্রমাণ হচ্ছে, বয়সে তরুণ হওয়া সত্তে¡ও আবু আব্দুল্লাহ্ আস-সাক্বাফী আত-তামীমীর মেধা, বুদ্ধিমত্ত¡া, ধর্ম এবং কল্যাণের ওপর উৎসাহ দেখে তাঁকে তাঁর কওমের প্রতিনিধি হওয়ার নির্দেশ দেন। (সীয়ারু ‘আলামিন নুবালা ২/৩৭৪)।
সাহাবীগণও রা. রাসূল সা.-এর পথ অনুসরণ করে যুবকদের গুরুত্ব দিতেন। হযরত আবু বকর রা. যখন আল-কুরআন সংকলনের ইচ্ছা করলেন তখন তরুণ যাইদ বিন সাবিত রা.-এর কাঁধে এ মহান দায়িত্ব অর্পণ করেন। ইমাম আয-যাহাবী র. বলেন, তোমাদের বয়স কম হওয়ার কারণে নিজেদেরকে গুরুত্বহীন ও দুর্বল মনে করো না। কেননা, হযরত উমার রা. যখন জটিল বিষয়ের সম্মুখীন হতেন তখন তিনি যুবকদের ডাকতেন। আর তাঁদের উর্বর মেধার কাছে পরামর্শ চাইতেন। (জামি‘ বয়ানিল ঈলম ওয়া ফযলিহ্ ১/৮)।
ইসলামের ইতিহাস তরুণদের এ রকম নানান ঐতিহাসিক ভূমিকায় ভরপুর। বর্তমান সময়ের তরুণদের দায়িত্ব হলো এ সমস্ত দৃষ্টান্ত থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে উন্নত সভ্যতা ও জাতি গঠনে মনোনিবেশ করা। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বর্তমান যুবসমাজ রাষ্ট্র ও জাতি গঠনে তেমন স্বপ্ন দেখে না। স্বপ্ন দেখে না নিজের সফলতা দিয়ে দেশকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরার। কীভাবেই বা দেখবে? নিজেরাই আজ সরল পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে অন্ধকারে নিমজ্জিত। পথ হারিয়ে ফেলেছে ইসলামের সুমহান বাণীকে পরিত্যাগ করার কারণে। তারা পশ্চিমা সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ¯্রােতে গা ভাসিয়ে দিয়েছে। তাদের খপ্পরে পড়ে ঈমান-আক্বীদা নষ্ট করে ফেলছে। ফলে তাদের অনেকে নাস্তিক, মুরতাদ ও ধর্মহীনে পরিণত হচ্ছে এবং তাদের চিন্তাধারাতে ভ্রান্ত মতবাদ স্থান করে নিচ্ছে। তারা শক্তিহীন, কর্মহীন, দায়িত্বজ্ঞানহীন জীবন-যাপন করছে। যেখানে সেখানে ঘুরে, আড্ডা দিয়ে, মোবাইলে ফেসবুক ও সিনেমা-নাটক দেখে অযথা সময় নষ্ট করছে। মাদকদ্রব্য সেবন করে, মেয়েদের উত্তক্ত করে ও গার্লফ্রেন্ডের পিছনে সময় দিয়ে নিজেদের জীবনে সর্বনাশ ডেকে আনছে। অথচ এ তরুণরাই ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনসহ ৪৭-এর ভারত বিভাগ, ৫২-র ভাষা আন্দোলন, ৫৪-র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬৯-এ গণঅভুত্থান, ৭১-এর মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ফলে বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের আবির্ভাব ঘটেছে।
যারা জাতির আগামীর পথপ্রদর্শক, উন্নয়নের কর্ণধার ও সফলতার চাবিকাঠি সেই তরুণদের পদস্খলন যেকোনো দেশের জন্য অমঙ্গল বয়ে আনবে। তাই তরুণ সমাজের দায়িত্ব হলো নিজেকে ধর্মীয় শিক্ষায় আলোকিত করে কর্মমুখী ও বাস্তবমুখী জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে মেধাকে সমৃদ্ধ করে নিজের উৎকর্ষ সাধন ও দেশের সেবায় আত্মনিয়োগ করা। প্রতিটি তরুণ-তরুণীর সফলতার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠবে একটি শক্তিশালী জাতি একটি শক্তিশালী দেশ। এর ফলে এগিয়ে যাবে আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশ। আর তরুণরা সফল হবে যদি তারা দৃঢ় মনোবল ধারণ করে। কারণ তরুণদের ব্যাপারে মিশরের কবি ইবরাহীম নাজী বলেন, যখন চক্ষু ঘুমিয়ে পড়ে তখন আমরা যুবকরা ভোরে জাগা পাখির ন্যায় প্রত্যুষে জাগ্রত হয়ে ফজরকে অভ্যর্থনা জানাই। আমরা যুবকরা সবাই মিলে প্রকৃত মর্যাদা অর্জনে ঝাঁপিয়ে পড়ি। (জেনে রাখ) যে বিজয়ের জন্য সকাল সকাল ঝাঁপিয়ে পড়ে, সে বিজয় ছিনিয়ে আনে। আল্লাহ্ তা‘আলা তরুণদের শক্তি, সামর্থ্য, মেধায় রহমত নাযিল করুন, আমীন।
লেখক: ব্যাংকার ও ইসলামী গবেষক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন