রোববার, ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

উপ সম্পাদকীয়

শিক্ষা ব্যবস্থার গলায় ফাঁস

মুনশী আবদুল মাননান | প্রকাশের সময় : ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

প্রশ্নপত্র ফাঁসের মহামারী দেখা দিয়েছে। পত্রপত্রিকায় প্রায়ই প্রশ্নপত্র ফাঁসের খবর প্রকাশিত হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাসহ বিভিন্ন পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস অনেকটাই সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। বিসিএস থেকে নানা প্রতিষ্ঠানের চাকরির পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস কোনো বিরল ঘটনা নয়। এইচএসসি, এসএসসি ও পিইসি পরীক্ষায় প্রতিবছরই প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে। বাদ ছিল প্রাথমিক স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা। সেটাও সম্প্রতি ঘটেছে। বরগুনা ও বেতাগী উপজেলার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম, দ্বিতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। এ কারণে ৩৯৫টি প্রাথমিক স্কুলের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। আর রাজশাহীর বাঘায় চতুর্থ শ্রেণীর প্রশ্নপত্র সকালেই পরীক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে যায়। বিকালে পরীক্ষা শুরু হলে দেখা যায়, সকালে ফাঁস হওয়া প্রশ্নের সঙ্গে হুবহু মিলে গেছে মূল প্রশ্ন। নাটোরেও ঘটেছে অনুরূপ ঘটনা। বলা যায়, প্রশ্নপত্র ফাঁসের ষোলকলা পূর্ণ হয়েছে।
যেখানে পরীক্ষা সেখানেই প্রশ্নপত্র ফাঁস। প্রশ্নপত্র ফাঁস পরীক্ষার অপরিহার্য অনুসঙ্গে পরিণত হয়েছে। সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সর্ব নিম্ন পর্যায় পর্যন্ত প্রশ্নপত্র ফাঁসের এই মারী কীভাবে ছড়িয়ে পড়লো, সেটা অবশ্যই একটি বড় জিজ্ঞাসা। এর উত্তর সহজ নয়। আমরা লক্ষ্য করেছি, অতীতে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ উঠলে কর্তৃপক্ষীয় পর্যায় থেকে সরাসরি অস্বীকার করা হয়েছে। যখন হাতে নাতে প্রমাণ হাজির করা হয়েছে তখন তদন্ত কমিটি গঠন করে দেয়া হয়েছে। তদন্ত কমিটি গঠন যে লোকদেখানো, তার প্রমাণ হলো, তদন্ত কমিটির রিপোর্ট কখনোই প্রকাশিত হয়নি। যাচাই না করে, কোনো প্রতিকারের ব্যবস্থা না নিয়ে এভাবেই অভিযোগ চাপা দেয়া হয়েছে। এতে দিনে দিনে ‘ঋণের বোঝা’ বেড়েছে। এখন তা সীমার বাইরে চলে যেতে বসেছে। শুরুতেই যদি ‘অস্বীকারের সংস্কৃতি’ অনুসরণ না করে প্রতিটি অভিযোগ উপযুক্ত আমলে নিয়ে তদন্ত করা হতো, দোষী ব্যক্তিদের উচিৎ শাস্তির ব্যবস্থা করা হতো, তাহলে পরিস্থিতি এতটা নাজুক ও উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছাতে পারতো না।
প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা এত সর্বব্যাপী রূপ নিলেও কেউ এর দায় নিতে চায়নি; এখনো চাইছে না। শিক্ষামন্ত্রী এর দায় চাপিয়েছেন এক শ্রেণীর শিক্ষকের ওপর। তিনি এও বলেছেন, সরকারকে বেকায়দায় ফেলানোর জন্য এ কাজ করা হয়েছে বা হচ্ছে। এখানে সরকারকে বেকায়দায় ফেলানোর প্রসঙ্গ কীভাবে আসে তা যথেষ্ট বোধগম্য নয়। এক শ্রেণীর অনৈতিক ও অর্থললুপ শিক্ষক প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত হতে বা থাকতে পারেন। মন্ত্রণালয় বা সরকারের দায়িত্ব হলো তাদের খুঁজে বের করে আইনের হাতে সোপর্দ করা। সেটা না করে অন্যভাবে বিষয়টি উপস্থাপন করা সদ্বিবেচনার নয়। দুদক বলেছে, শুধু শিক্ষক নয়, অবৈধ অর্থের বিনিময়ে কিছু দুর্নীতিপরায়ণ সরকারী কর্মকর্তা এ অপরাধে জড়িত। কিছু দিন আগে প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়েছে, বিজি প্রেসের কর্মীদের কেউ কেউ প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত। সম্প্রতি ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে আইনশৃংখলা বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৩ জনকে আটক করেছে। এদিকে র‌্যাব এক সহকারী কর কমিশনারকে সাঙ্গপাঙ্গসহ গ্রেফতার করেছে। শিক্ষক, সরকারী কর্মকর্তা, ছাত্র, প্রেসকর্মীসহ নানাজন এ অপকর্মের সঙ্গে জড়িত। বিভিন্ন সংঘবদ্ধ চক্র এ কাজে নিয়োজিত বলে সহজেই অনুমান করা যায়। এই চক্রগুলো ভেঙ্গে দেয়া ছাড়া প্রশ্নপত্র ফাঁস প্রতিরোধ সম্ভব হবে বলে মনে হয়না। এক্ষেত্রে বেøম গেমে কোনো ফায়দা হবে না। দায় এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। প্রাথমিক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের দায় সরকারের নয়, এমন দাবি করেছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি মোতাহার হোসেন। তিনি বলেছেন, প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত পরীক্ষার প্রশ্নপত্র সরকার করে না। এ সব শ্রেণীর প্রশ্ন করে উপজেলা পর্যায়ের শিক্ষক সমিতি। পাল্টা কথা ওঠে, অন্য সব শ্রেণীর প্রশ্ন কি তবে সরকার করে? সে সব শ্রেণীর প্রশ্নপত্র কি ফাঁস হয় না? বলা বাহুল্য, এভাবে সরকারের দায়মুক্তি দেয়া যায় না। দেশে বা সমাজে, কোনো দফতরে বা প্রতিষ্ঠানে যখন কোনো অন্যায় বা অপরাধ সংঘটিত হয়, তখন তার দায় সরকারের ঘাড়ে গিয়েও পড়ে। ছিনতাইকারী যখন ছিনতাই করে কিংবা কাউকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে তখন সরকার কি দায়মুক্ত থাকতে পারে? পারে না। কারণ, নাগরিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। নাগরিক নিরাপত্তা সুনিশ্চিত হলে ছিনতাইকারীর দৌরাত্ম্য বা দু:সাহস এত দূর পর্যন্ত পৌঁছানোর কথা নয়। তাবৎ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যাবে, আর সরকারের ওপর তার কিছু মাত্র দায় বর্তাবে না, এটা কি হতে পারে? প্রশ্নপত্র ফাঁস হবে না, এই নিশ্চয়তা সরকারকেই দিতে হবে। কে বা কারা প্রশ্নপত্র ফাঁস করে, তার বা তাদের খুঁজে বের করার দায়িত্ব সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ, কর্র্তৃপক্ষ এবং আইনশৃংখলা বাহিনী তথা সরকারের। সরকার এক্ষেত্রে মোটেই নির্বিকার থাকতে পারে না।
একের পর এক প্রশ্নপত্র ফাঁস হবে, তার কোনো প্রতিকার হবে না, এ অবস্থা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। বস্তুত প্রশ্নপত্র ফাঁসের ফলে পরীক্ষা ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়েছে। আর পরীক্ষা ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়ার অর্থ, শিক্ষা ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে যাওয়া। লেখাপড়ার ক্রমাগ্রগতির পরিমাপ ও মেধা যাচাইয়ের জন্য পরীক্ষা ব্যবস্থার কোনো বিকল্প নেই। অথচ দেখা যাচ্ছে, প্রশ্নপত্র ফাঁসের কারণে শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া থেকে মনোযোগ সরিয়ে নিয়েছে। অতীতে পরীক্ষায় আগে ও পরীক্ষার সময় শিক্ষার্থীদের দিনের বিশ্রাম, রাতের ঘুম হারাম হয়ে যেতো। পড়া আর পড়া ছাড়া তাদের অন্যদিকে খেয়াল থাকতো না। এখন তাদের খেয়াল প্রশ্নপত্র ফাঁসের দিকে। কোথায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে, কিভাবে তা পাওয়া যাবে-এসব নিয়ে তাদের ব্যস্ত সময় কাটে। লেখাপড়া তাদের শিকেই উঠেছে। এও কম বিস্ময়ের ব্যাপার নয়, অভিভাবকদের একটি অংশও ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র পাওয়ার জন্য মরিয়া ওঠে। টাকা যত লাগে, দিতে তারা কার্পণ্য করে না। তাদের লক্ষ্য থাকে, ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র পাওয়া গেলে তাদের ছেলে বা মেয়ের পরীক্ষা ভালো হবে, তারা ভালোভাবে পাস করবে, তাদের ভাগ্য বা ভবিষ্যত তরতরিয়ে ওপরের দিকে উঠে যাবে। কাজেই যে কোনো মূল্যে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র চাই-ই চাই। এতে যে তাদের সন্তানদের লেখাপড়া ও জ্ঞানার্জনের বারোটা বেজে যাচ্ছে, ভবিষ্যৎ হয়ে যাচ্ছে ঝরঝরে, সেটা তারা মোটেই খেয়াল করছে না। প্রশ্নপত্র ফাঁসের কালচার বিস্তার লাভের ক্ষেত্রে এই শ্রেণীর অভিভাবকের দায় হালকা করে দেখা যায় না।
এর বিকল্পে কী হচ্ছে? যারা ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র হাতে পাচ্ছে না কিংবা উচ্চমূল্যে কেনার সামর্থ যাদের নেই, অন্যদিকে যারা সাধ্যমত লেখাপড়া করে পরীক্ষা দিয়ে ভালোভাবে উর্ত্তীণ হয়ে উচ্চ শিক্ষা অর্জন অথবা জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভের স্বপ্নে বিভোর, তাদের সাধনা-স্বপ্ন বিফলে যাচ্ছে। ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রে যারা পরীক্ষা দিচ্ছে, প্রতিযোগিতায় তারা তাদের সঙ্গে পেরে উঠছে না। এমন বাস্তবতায় তাদের চরম হতাশায় নিমিজ্জত হওয়া অবধারিত। বিসিএস বা অন্যান্য সরকারী চাকরির পরীক্ষায়ও একই অবস্থা ঘটছে। অযোগ্য ও কম মেধাবীরা চাকরি পেয়ে যাচ্ছে, অধিকতর যোগ্য ও মেধাবীরা বঞ্চিত হচ্ছে। এভাবে সরকারের বিভিন্ন বিভাগে অযোগ্য, অদক্ষ ও মেধাহীন কর্মকর্তার সংখ্যা বাড়ছে।
প্রশ্নপত্র ফাঁস আসলে শিক্ষা ব্যবস্থার গলায় ফাঁস হিসাবেই দেখা দিয়েছে। কথায় বলে, একটি জাতিকে ধ্বংস করার জন্য এ যুগে যুদ্ধের কোনো প্রয়োজন নেই। তার শিক্ষা ব্যবস্থাকে এলোমেলো ও অকার্যকর করে দিলেই যথেষ্ট। আমরা যেন সেই জাতি ধ্বংসের উন্মত্ত প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে পড়েছি।
আমাদের দেশে শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে, পাঠ্যবিষয় নিয়ে, শিক্ষা পদ্ধতি নিয়ে, পরীক্ষা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। ইতোমধ্যে এত পরিবর্তন সাধিত হয়েছে যে তা নিয়ে রীতিমত গবেষণা হতে পারে। লাভ তেমন কিছু হয়নি। ক্ষতি হয়েছে অপূরণীয়। সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। অথচ এই সৃজনশীল পদ্ধতি কী, তা শিক্ষকরা পর্যন্ত অনেকেই জানেন না। এ ব্যাপারে তাদের শিক্ষা ও শিক্ষণ অভিজ্ঞতা নেই। এই সুযোগে কোচিং সেন্টারের ব্যবসা জমজমাট হয়ে উঠেছে। নোট ও সহায়ক গ্রন্থের সয়লাব দেখা দিয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী তো স্পষ্ট করেই বলেছেন, কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে এক শ্রেণীর শিক্ষক প্রশ্নপত্র ফাঁস করছেন। বলা বাহুল্য, সেটা তারা করছেন কোচিং ব্যবসা টিয়ে রাখার জন্যই। কোচিং ব্যবসা বন্ধ ও নোটবই নিষিদ্ধ করা নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। কোনো ফল হয়নি। বরং উভয় ক্ষেত্রে ব্যবসা-বাণিজ্য বেড়েছে।
বিগত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়াই যেন শিক্ষার মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ উদারভাবে খাতা দেখার জন্য পরীক্ষকদের নির্দেশনা দিয়েছে। শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরাও জিপিএ-৫ পাওয়ার প্রতিযোগিতায় নিজেদের উজাড় করে দিয়েছে। ফলাফল শুভ হয়নি। জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীরা অধিকাংশই উচ্চতর শ্রেণীতে ভর্তি হওয়ার জন্য ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি। নজির আছে অনেক। এখানে আমরা তার কোনো উল্লেখ ইচ্ছাকৃতভাবেই করছি না। এই ধরনের ঝুড়ি ঝুড়ি জিপিএ-৫ প্রকৃত পক্ষে কোনো কাজেই আসেনি। আমরা এও দেখেছি, বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শতভাগ শিক্ষার্থী পাস করেছে। আবার অনেক স্কুল, মাদ্রাসা বা কলেজে শতভাগ শিক্ষার্থী ফেল করেছে। এই বিষম অবস্থা ও বৈপরীত্য কীভাবে মেনে নেয়া যায়? কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়ার মান এত উঁচুতে এবং কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মান এত নিচুতে কীভাবে হতে পারে? শিক্ষা-বিশেষজ্ঞরা একমত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাসের হার বেশী-কম যাই হোক না কেন, আসলে শিক্ষার মান তেমন বাড়েনি বরং ক্ষেত্রবিশেষে কমেছে। আগে বিভিন্ন পরীক্ষার শতভাগ পাস বা শতভাগ ফেল খুব একটা দেখা যেতো না। এখন এটা বেশী বেশী দেখা যাচ্ছে। এর অর্থ দাঁড়ায়, আগে সামগ্রিকভাবে শিক্ষামানের একটা ন্যূনতম স্ট্যাস্টার্ড ছিল, এখন সেটা শেষ হয়ে গেছে। সেদিন একটি পত্রিকায় এই মর্মে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে যে, এবার উচ্চ মাধ্যামিক ১৩৫টি কলেজ ও মাদ্রাসায় একজন শিক্ষার্থীও ভর্তি হয়নি। আরও ১৩৮৩টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দু’একজন করে শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে। শূণ্য ভর্তি ও শূণ্য পাস শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাধিক্যতা শিক্ষা ব্যবস্থার শোচনীয় দুর্দশারই প্রমাণ বহন করে। এই সব শূণ্য ভর্তি ও শূণ্য পাস শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একাংশের জন্য সরকারের কাড়ি কাড়ি ব্যয় হচ্ছে। এই ব্যয় যে সম্পূর্ণ অপচয় হচ্ছে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। দরিদ্র জনগণের ট্যাক্সের টাকার এই অপচয় বরদাস্তযোগ্য হতে পারেনা।
এমন একটা সময় ছিল যখন শিক্ষাক্ষেত্রে অনিয়ম, দুর্নীতি ও অপচয় ছিল না বললেই চলে। এখন তার উল্টো। যে সব ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশী অনিয়ম, দুর্নীতি ও অপচয় হয় শিক্ষা তার সারিতে উঠে এসেছে। এক্ষেত্রে তুগলোকী কর্মকান্ডও কম হয় না। এক খবরে জানা গেছে, সরকারী মাধ্যমিক স্কুলে এসকেলেটর স্থাপনের একটি উদ্যোগ মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর গ্রহণ করেছে। এজন্য ১১১৬ কোটি টাকার সংস্থান রাখা হয়েছে। একেই বোধ হয় বলে ‘গরীবের ঘোড়ারোগ’। যেখানে হাজার হাজার বেসরকারী শিক্ষক এমপিওভুক্তির বাইরে থেকে রীতিমত বেগার খেটে যাচ্ছে, যেখানে সরকারী-বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভবনসহ অবকাঠামো সমস্যায় ভুগছে সেখানে সরকারী স্কুলে এসকেলেটর স্থাপনের উদ্যোগ বা সিদ্ধান্তকে অপরিনামদর্শী সিদ্ধান্ত বা টাকা মারার ফন্দি ছাড়া আর কী বলা যায়?
সামগ্রিকভাবে শিক্ষা ব্যবস্থার যে বেহাল লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তাতে জাতিধ্বংসের পথই প্রশস্ত ও দ্রæতায়িত হচ্ছে। এভাবে লেখাপড়ার পাঠ উঠে গেলে কিংবা মেধা সৃষ্টি ও তা লালন-পালনের পথ রুদ্ধ হয়ে গেলে দেশ অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, অযোগ্য, অদক্ষ মানুষ ভরে যাবে। সুশিক্ষিত, মেধাবী ও সৃনজশীল মানুষ ছাড়া দেশ এগিয়ে যেতে, উন্নতি লাভ করতে পারে না। তখন দেশ ও সমাজের অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা অনুমান করা মোটেই কষ্টকর নয়। সরকার, নাগরিক সমাজ এই আশঙ্কার দিকটি যদি এখনই উপলদ্ধি না করে, প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ শিক্ষাক্ষেত্র বিদ্যমান অনিয়ম-দুর্নীতি দূর করার তাকিদ অনুভব না করে তবে শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গে দেশ-জাতি ও রসাতলে নিক্ষিপ্ত হবে। প্রশ্নপত্র ফাঁসের দুষ্কর্ম ও অপরাধ দমনে সরকারকে শূণ্য সহনশীলতা প্রদর্শন করতে হবে। এর সঙ্গে যারা জড়িত তাদের কঠোরই শুধু নয়, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে এর বিরুদ্ধে সামাজিক সচেনতা বৃদ্ধিসহ দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
দুদক প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ শিক্ষা ক্ষেত্রে অনিয়ম-দুর্নীতি প্রতিরোধ ৩৯ দফা সুপারিশসহ একটি প্রতিবেদন পেশ করেছে। শিক্ষামন্ত্রী এ প্রতিবেদন সম্পর্কে বলেছেন, দুদকের প্রতিবেদন সময়োপযোগী। আমরা খুশী, কারণ এর অধিকাংশ সুপারিশই আমাদের নজরে রয়েছে। সমস্যাগুলো আমরা দুদককে সাথে নিয়ে যৌথভাবে দূর করবো। পর্যবেক্ষক মহল মনে করে, দুদকের প্রতিবেদনে খুশি হওয়া কিংবা সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে অঙ্গীকার করাই যথেষ্ট নয়, বাস্তবায়ন দ্রæত সম্ভব করতে হবে। শিক্ষাক্ষেত্রে যে ধস দেখা দিয়েছে, অধিক বিলম্বে তা শেষ পর্যন্ত পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়তে পারে। অতএব, যা কিছু করার এখনই করতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থাকে বাঁচাতে হবে, আগামী প্রজন্মকে বাঁচাতে হবে, দেশ ও জাতিকে বাঁচাতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন