প্রযুক্তির দুনিয়ায় আলোচিত নাম ‘সোফিয়া’। ঠিক মানুষের আদলে বানানো এই রোবটটি দেখতে বলিউড অভিনেত্রী অড্রে হেপবার্নের মতো। কথা বলে মানুষের ভাষায়। তবে মানুষের মতো যা খুশী তা-ই বলতে পারে না সে। আগে থেকে সেট করা কথাই শুধু রেকর্ডারের মতো বেজে ওঠে সোফিয়ার ঠোঁটে। সোফিয়াকে তৈরি করেছে হংকংয়ের বিখ্যাত রোবট প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান হ্যারিসন রোবটিকস। প্রতিষ্ঠানটির দাবি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন এই রোবট ক্রমেই মানুষের সঙ্গে ভাববিনিময় ও সামাজিক আচার-ব্যবহারের কলাকৌশল রপ্ত করতে পারবে।
গেল অক্টোবর মাসে এই রোবট মানবীকে নাগরিকত্ব দিয়ে বিশ^কে তাক লাগিয়ে দেয় সৌদি আরব। অবশ্য এর আগেই সোফিয়াকে নিয়ে একাধিক সাক্ষাৎকার প্রচার করে গণমাধ্যম। বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করানো হয় তাকে। এরই ধারাবাহিকতায় সোফিয়াকে তিন দিনের জন্য আনা হয় বাংলাদেশে। এই যন্ত্রমানবীকে কেন্দ্র করে আমাদের তরুণ-তরুণীদের আগ্রহ ছিল চোখে পড়ার মতো। বিজ্ঞানের এ সাফল্য প্রত্যক্ষ করতে পেরে আনন্দিত তারাও।
যদিও সোফিয়ার বুদ্ধিমত্তা এখনো তেমন উন্নত নয়, তারপরও বিজ্ঞানের এটি একটি উল্লেযোগ্য অর্জন। কৃত্রিম মানুষ বানানোর যে স্বপ্ন দেখছে বিজ্ঞান, তা যে এখন অবাস্তব নয়, এ কথা চোখ বন্ধ করেই বলা যায়। বলা যায়, কোরআনের এ আয়াতের আলোকে দৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে, ‘ফালা উকসিমু বিশশাফাক। ওয়াললাইলি ওয়ামা ওয়াসাক, ওয়াল কামারি ইজাত্তাসাক। লাতারকাবুন্না তাবাকান আন তাবাক।’ অর্থাৎ অস্তমিত লালিমা যেমন হাঁটি হাঁটি পায়ে রাতের আঁধারের দিকে এগিয়ে যায়, রাতের আঁধার যেমন অল্প অল্প করে পৃথিবীকে ঢেকে ফেলে, চাঁদ যেমন ক্রমে পূর্ণিমায় ভরে ওঠে, তেমনি তোমরাও জ্ঞান-বিজ্ঞানের নায়ে ভেসে পাড়ি দেবে গ্রহ-গ্রহান্তরে। (সূরা ইনশিকাক : ১৬-১৯)।
এখানে খুব স্পষ্টই বলা হয়েছে, প্রকৃতির বিভিন্ন আবর্তন-বিবর্তন যেমন হঠাৎ করে হয় না, তেমনি মানুষও তার জ্ঞান-বিজ্ঞান ও গবেষণায় একলাফে এগিয়ে যাবে না। একটি একটি করে সিঁড়ি ভেঙ্গেই তাকে এগিয়ে যেতে হবে বিজ্ঞানময় স্রস্টার প্রযুক্তি ধরতে, বুঝতে। বলছিলাম, মানুষের বানানো রোবট সোফিয়ার কথা। বিজ্ঞান যতই উৎকর্ষ লাভ করবে, ঈমানের সূর্য ততই তেজস্বী হয়ে আলো ছড়াবে। কোরআনের বাণী আরো জ¦ল জ¦ল সত্য হয়ে বিশ্বাসের বার্তা তুলে ধরবে অবিশ্বাসীর সামনে। মানুষের মস্তিষ্ক থেকে তৈরি রোবট সোফিয়া, আর খোদার থেকে তৈরি ‘রোবট’ হল আদম। আজকের এই সোফিয়াকে বিজ্ঞানীরা যেমন বিভিন্ন দেশে প্রদর্শন করে বেড়াচ্ছে, খোদাও কিন্তু তাঁর রোবট আদমকে একইভাবে ফেরেশতাদের সামনে প্রদর্শনী করেছিলেন। সোফিয়াকে যেমন তার স্রস্টা বিভিন্ন কথা শিখিয়ে দিচ্ছে, তেমনি আদম রোবটের মাঝেও খোদা সব জ্ঞান-বিজ্ঞানের সফটওয়ার ইনস্টল করে দিয়েছিলেন। তারপর প্রদর্শনীতে ফেরেশতা ‘রোবটদের’ বললেন, ‘তোমরা যদি আদম থেকে উন্নত মানের রোবট হয়ে থাকো, তবে এসব জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্পর্কে আমাকে বলো। ফেরেশতারা বুঝল, এ নতুন রোবট তাদের থেকে আরো বেশি বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন, তাই খোদার নির্দেশ পাওয়া মাত্রই তারা আদমের সামনে সেজদায় লুটিয়ে পড়ল।’ (সূরা বাকারাহ : ৩১-৩৪)।
আধুনিক বিজ্ঞানের জন্য সোফিয়া যত বড় মাইলফলকই হোক না কেন, অবিশ্বাসী-নাস্তিকদের জন্য এটি একটি বড় নিদর্শন। এই সোফিয়াই যদি এখন বলে, তাঁর কোন স্রস্টা নেই, কয়েকটি প্লাসটিক আর বৈদ্যুতিক তার হঠাৎ একত্র হয়ে, কালের আবর্তনে সে আজ সোফিয়া রোবট হয়েছে, আস্তে আস্তে সে নিজ থেকেই কথা বলা শিখেছে, কিংবা অদূর ভবিষ্যতে যখন আমাদের মতই রোবট ও ক্লোন মানুষ তৈরি হবে; তারাও যদি বলে, তাদের কোন স্রস্টা নেই, কোন বিজ্ঞানী তাদের তৈরি করেনি, তারা নষ্ট হয়ে গেলে আবার তাদের তৈরি করা যাবে না- এসব কথা যত অবিশ্বাস্য এবং হাস্যকর শোনাবে আমাদের কাছে, যুগ যুগ ধরে অবিশ্বাসীদের কথাও ততটাই হাস্যকর ও উদ্ভট ছিল কোরআনের চোখে। কোরআন বারবার যুক্তির পর যুক্তি, প্রমাণের পর প্রমাণ দিয়ে বলেছে, এ বিশ^জাহান ও এর মাঝে যা আছে, সবকিছুরই একজন স্রস্টা আছে। এ স্রস্টা যেমন মহা রহস্যঘেরা মহাশূন্য সৃষ্টি করেছেন, তেমনি তোমাদেরকেও তিনিই সৃষ্টি করেছেন। এরপর প্রশ্ন করেছেন, মহাকাশ সৃষ্টি কঠিন নাকি মানুষ সৃষ্টি করা কঠিন? বিজ্ঞান হয়ত কোন একদিন কৃত্রিম গ্রহ-নক্ষত্রও বানাতে সক্ষম হবে। তখন বিজ্ঞান প্রশ্ন করবে, ‘রে সোফিয়া! তুই যে বলছিস তোর স্রস্টা নেই, বলত দেখি, তোকে বানানো কঠিন নাকি গ্রহ-নক্ষত্র বানানো কঠিন? তো এই কঠিন রহস্যপূর্ণ গ্রহ-নক্ষত্রই যদি আমরা বানিয়ে ফেলতে পারি, তাহলে তোর মতো রোবট বানাতে পারব না কেন? ঠিক এ যৌক্তিক প্রশ্নটিই করা হয়েছে অবিশ্বাসীদের কাছে। ‘আ আনতুম আশাদ্দু খালকান আমিসসামাউ বানাহা। হে মানুষ! তোমাদের সৃষ্টি করা বেশি কঠিন নাকি ওই মহাকাশ সৃষ্টি করা? আল্লাহই এই রহস্যময় মহাশূন্য সৃষ্টি করেছেন।’ (সূরা নাজিআত : ২৭)।
বিজ্ঞানের জয়যাত্রা যতই এগিয়ে যাবে বিশ্বাসের রশি ততই মজবুত হবে। নাস্তিকতার ভিতও ততটাই নড়বড়ে হয়ে পড়বে। আধুনিক বিজ্ঞানের অন্যতম অবদান সোফিয়া, এও কিন্তু খোদা তায়ালারই একটি বড় নিদর্শন। এসব নিদর্শন দেখেও যারা বিশ্বাসের মালা গলে পরে না তাদের উদ্দেশ্য করেই আল্লাহ বলছেন, ‘ফামালাহুম লা ইউমিনুন। ওয়া ইজা কুরিয়াল কোরআনু আলাইহিম লা ইয়াসজুদুন। তাদের কী হল, এসব নিদর্শন দেখেও তারা স্রস্টায় বিশ্বাস করে না? স্রস্টার বাণী বিজ্ঞানময় কোরআনের সত্যতা দেখেও তারা মাথা ঝুঁকিয়ে দেয় না?’ (সূরা ইনশিকাক : ২০-২১)।
লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন