২১ জানুয়ারি রাজধানীর পুরান ঢাকার লালবাগ এলাকায় পাঁচতলা ভবন পাশের একটি ভবনে ওপর হেলে পড়ে। চার তলার অনুমোদন নিয়ে অবৈধভাবে পাঁচতলা ভবন নির্মাণ করেছিলেন বাড়ির মালিক। ভাগ্যিস কোন হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। ঘটতে পারতো। ঝুঁকিপূর্ণ ওই ভবন থেকে বাসিন্দাদের সরে যেতে নির্দেশনা দেয় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। ভবনটি হেলে না গিয়ে দেবে কিংবা ভেঙ্গে পড়লে বহু লোকের প্রাণ যাবার ভয় ছিলো। পাঁচতলা এই ভবনে মোট ২২টি পরিবার বসবাস করতো। দুপুরে হঠাৎ করেই বাড়িটি দক্ষিণ দিকে হেলে পড়ে। বর্তমানে বাড়িটির ছাদ পাশের বাড়ির ছাদের সাথে কাত হয়ে হেলে রয়েছে। সাম্প্রতিকালে দেশে এভাবে ভবন হেলে পড়ার ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। রাজধানী ঢাকায় ভবন হেলে পড়ার ঘটনা বেশি ঘটছে। আলোচিত সাভারের রানা প্লাজা ধসে ব্যাপক হতাহতের ঘটনার পর গত কয়েক বছরে রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য ভবন হেলে পড়ার খবর পত্রিকায় এসেছে।
প্রশ্ন হলো, এভাবে নতুন নতুন ভবন ধসে বা হেলে পড়ছে কেন? কারণতো আছেই? এ যাবৎ দেশে যত ভবন ধস কিংবা হেলে যাবার ঘটনা ঘটেছে তার কোনটিই সঠিক পন্থায় তৈরি হয়নি বলে আমরা জেনেছি। সর্বশেষ ঢাকার লালবাগের হেলে পড়া ভবনটির অনিয়মের বিষয়টিও স্পষ্ট। দেখা গেছে, হেলেপড়া বা ধসে পড়া ভবনগুলো ব্যাপক নির্মাণ ত্রুটি নিয়ে তৈরি হয়। দেখা গেছে, ভবনগুলোর অধিকাংশই ডোবা, পুকুর ভরাট করে অপরিকল্পিতভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। এভাবে দেশে অসংখ্য বাড়িঘর নির্মাণ করা হয়েছে এবং হচ্ছে। নিয়ম ছাড়া ভবন করলে ভবনতো টিকবে না। কথা হলো, ভূমিকম্পজনিত কোন কারণ ছাড়াই যখন এসব ভবন হেলে পড়ে তখন ভূমিকম্প হলে কী হবে? বোধকরি, যারা বোঝেন তারা এর পরিণতি নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পারছেন। একটি ত্রুটিপূর্ণ রানা প্লাজাই এর জ্বলন্ত প্রমাণ। ধসেপড়া রানা প্লাজার মতো একটি ভবনের পেছনে গোটা শক্তি প্রয়োগের পরও কতটা সময় লেগেছে উদ্ধার কাজে! ক’জন জীবিত আর ক’জনের লাশ উদ্ধার করা গেছে তা তো দেশবাসী জানে। বহুজনকে উদ্ধারও করা সম্ভব হয়নি।
একটু বড় মাত্রার ভূমিকম্প হলে কী হবে দেশে? কে কাকে বাঁচাবে? আপনি-আমি কি বেঁচে থাকবো? কে কার খবর নেবে? তখনতো ধসবে ৫ লাখেরও বেশি ভবন। ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হলে পুরো দেশে প্রায় ৫ লাখ ভবন ধসে পড়বে! আমাদের ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা তো তাই বলছেন। একটি ভবন থেকে মাত্র ক’হাজার মানুষ উদ্ধার করতে এই অবস্থা হলে ৫ লাখ ভবন ধসে পড়লে বাঁচার কোনো পথ আছে কি? এ দেশ মারাত্মক ভূমিকম্পপ্রবণ দেশ হলেও তাতে ভাবনা নেই কারোরই। সরকারও এ ব্যাপারে সজাগ নয়। এখনও দেশে প্রতিদিন অপরিকল্পিতভাবে ভবন নির্মিত হচ্ছে। কেবল ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে ভবন নির্মাণই নয় ভবনগুলোতে যেসব সামগ্রী ব্যবহার করা হচ্ছে তা খুবই নিম্নমানের।
দেশে নির্মাণ কাজে প্রতিদিন যে পরিমাণ রড ব্যবহার করা হয় তার ৭০ ভাগই অতি নিম্নমানের। এর মধ্যে ১৫/২০ গ্রেডের রডও ব্যবহার করা হয় বলে মাঝে মাঝে শুনি। এমনকি রডের বদলে বাঁশ দেওয়ার ঘটনা তো এখন আলোচিত বিষয়। ভবন তৈরির ক্ষেত্রে ভেজাল সিমেন্ট, দুর্বল ইট ব্যবহার হচ্ছে হরহামেশাই। এ অবস্থায় ভূমিকম্প হলে আমাদের ভাগ্যে কী ঘটবে তা হয়তো আমাদের ভাবনায়ও নেই। জাপানে ঘনঘনই ভূমিকম্প হয়। তারা তা মোকাবিলাও করে। ভূমিকম্প হলে তারা এই অবস্থা থেকে দু-একদিনে বেরিয়ে আসতে পারে। জাপানের ভবনগুলো সেভাবেই নির্মাণ করা হয়। জাপানে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ভবন দুললেও কিন্তু ধসে পড়বে না। আমাদের ভবনগুলো যদি জাপানের মতো করে বানানো হয় তাহলে বোধহয় এই অবস্থা থেকে আমরা কিছুটা হলেও বাঁচতে পারি। কিন্তু এখনও সেভাবে ভাবছে না মানুষ। সরকারতো ভাবেই না। এ ব্যাপারে সরকারের কোনো পরিকল্পনা কিংবা প্রচার-প্রচারণা চোখে পড়ার মতো নয়।
দেশে কী হারে ভবন হেলেপড়া কিংবা ধসের ঘটনা ঘটছে তার হিসাব কারো কাছে নেই। ভবন হেলে পড়া আর ধসে পড়ার যেসব সংবাদ আমাদের পত্রিকাগুলো ছেপেছে তার কয়েকটি আপনাদের এখন স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। মনে আছে, পুরান ঢাকার একটি ভবন ধসের ঘটনা। পুরান ঢাকায় পরিত্যাক্ত একটি ছয়তলা ভবন পাশের দুটি তিনতলা ভবনের ওপর ভেঙে পড়ে অন্তত একজন আহত হয়েছে। চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে হেলে পড়েছে পাঁচতলা ভবন। মৌলভীবাজারে শহরে হেলে পড়েছে একটি ৫ তলা ভবন। খুলনায় নির্মাণাধীন একটি ভবন হেলে পড়েছে। ময়মনসিংহ শহরের শিকদারবাড়ি মার্কেট সংলগ্ন আর কে মিশন রোডে একটি চারতলা ভবন হেলে পড়েছে। রাজধানীর কাঁঠালবাগান ঢালের পুকুরপাড় এলাকায় হেলে পড়েছে নির্মাণাধীন একটি সাততলা ভবন। পিলার ভেঙে এশিয়ান হায়দার টাওয়ার নামের ওই ভবনের নিচতলা প্রচন্ড শব্দে দেবে যায়। সর্বশেষ রাজধানীর কদমতলী চারতলা একটি ভবন পাশের ছয়তলা ভবনের দিকে হেলে পড়ে। একটু সতর্ক হলেই ভবন ধসে পড়ার কথা না। আর এ জন্য যিনি ভবন নির্মাণ করবেন তাকে কটি শর্ত মেনে ভবন নির্মাণ কাজ করতে হবে। ভবন নির্মাণের সময় যেসব বিষয়ের প্রতি বিশেষ নজর রাখতে হবে তাহলো: ভবন নির্মাণের জয়গার সয়েল টেস্ট করা হয়েছে কি না, জলাশয় ভরাট করা হলে সেখানে মাননিয়ন্ত্রিতভাবে ভবন নির্মাণ হচ্ছে কি না? ভবনের নকশা কোনো নির্ভরযোগ্য স্থপতি দিয়ে তৈরি করা হয়েছে কি না, ভবনের জন্য নির্ধারিত স্থানটি সঠিকভাবে পাইলিং করা হয়েছে কিনা? ভবন কাঠামোর ডিজাইন নির্ভরযোগ্য কোনো কাঠামো প্রকৌশলীকে দিয়ে করানো হয়েছে কি না, ভবন নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত কংক্রিট, সিমেন্ট ও রডের মাননিয়ন্ত্রণে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে কি না? ভবন নির্মাণে ওয়ার্কিং ড্রয়িং অনুসারে করা হচ্ছে কি না? ভবন নির্মাণ কোনো প্রকৌশলীর তত্ত্বাবধানে হচ্ছে কি না, এসব দিকে নজর রাখতে হবে।
ভবন ধসের অন্যতম কারণ হলো, পুরনো পুকুর, খাল ও বিল ভরাট করে তৈরি করা। একটি বিষয় জানা দরকার যে, খাল ও বিলের তলদেশ বিশেষ ধরনের খনিজ পদার্থ দিয়ে তৈরি হয়। এসব পদার্থ উপরিভাগের ভর সহ্য করতে পারে না এবং জলাশয়ের তলদেশে জন্মে বিভিন্ন জলজ উদ্ভিদ পরবর্তীকালে এসব পচে তৈরি হয় জৈব মাটি। এই জৈব মাটির উপর তৈরি হওয়া ভবনগুলোর ধসের আশঙ্কা বেশি। কারণ এর চাপ ধারণক্ষমতা কম। সুতরাং যেসব ভবন লেক ভরাট করে তৈরি করা হযেছে সেগুলো অল্প ভূমিকম্পে ধসে যাবে। অপরদিকে ঢাকার পাশে রয়েছে চ্যুতি সে কারণে ভূমিকম্প অনেক শক্তিশালী হবার আশঙ্কা রয়েছে।
দেশে শক্তিশালী ভূমিকম্পের আশঙ্কা ক্রমেই বাড়ছে! তাই আমাদের ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে অধিক সতর্ক হওয়া দরকার। সা¤প্রতিকালে ঘন ঘন ভূমিকম্পে এক অজানা শঙ্কা তৈরি করছে সবার মনে। বাংলাদেশ একটি বড়মাত্রার ভূমিকম্পের দ্বারপ্রান্তে, বিশেষজ্ঞদের এমন সতর্কবাণীর পর এ বিপদাশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না কিছুতেই। তাই এখনই আমাদের সতর্ক হওয়ার সময়। আর ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রেই বেশি সতর্ক হতে হবে। কারণ ভূমিকম্প কিংবা ভূমিধসের আঘাতটা সাধারণত ভবনের উপরই বেশি আসে। ভবন ধসে জানমালের সমূহ ক্ষতি ঠেকাতে ভবন নির্মাণ কৌশল, ধরন পাল্টাতে হবে; নির্মাণ ক্ষেত্রে অধিক সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে এ বিষয়ে নজরদারি বাড়াতে হবে। বিশেষ করে ভবন নকশা এবং নির্মাণ কাজের সঠিক মান নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন