শাবান আরবি মাসসমূহের মধ্যে অন্যতম একটি মাস। প্রিয়নবী (সা.) এ মাসকে অত্যধিক গুরুত্ব দিতেন। ইসলামের বুনিয়াদ রোজা পালনের মাস মাহে রমজানের পূর্ববর্তী মাস যেহেতু এই শাবান মাস, তাই এ মাসটি হলো পবিত্র রমজান মাসে একাগ্রচিত্তে সিয়াম-সাধনা ও অধ্যবসায়ের প্রস্তুতি গ্রহণের মাস।
শাবান মাসের বরকত ও ফজিলত অনেক। এর অন্যতম কারণ হলো, এ মাসের ১৪ তম তারিখ দিবাগত রাতেই হয়ে থাকে বিশ্বসৃষ্টির মুক্তি ও ভাগ্য নির্ধারণের বিশেষ ও বরকতপূর্ণ রজনী ‘শবে বরাত’ বা লাইলাতুল বরাত। এ রাতের ফজিলত সম্পর্কে এবং ইবাদতের ব্যাপারে নির্দেশ দিয়ে রাসুল (সা.) বলেন, ‘পনেরো শাবানের রাত (চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাত) যখন আসে তখন তোমরা তা ইবাদত-বন্দেগীতে কাটাও এবং পরদিন রোযা রাখ। ( ইবনে মাজাহ: ১৩৮৪)। এ মাস এলে প্রিয়নবী (সা.) স্বীয় আমলের পরিমাপ স্বাভাবিক অবস্থা থেকে অধিক বাড়িয়ে দিতেন। উম্মুল মু’মিনীন হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, ‘একবার রাসুল (সা.) রাতে নামাযে দাঁড়ালেন এবং এত দীর্ঘ সেজদা করলেন যে, আমার আশঙ্কা হল, তাঁর হয়তো ইনতেকাল হয়ে গেছে। আমি তখন উঠে তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম। তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল। যখন তিনি সেজদা থেকে উঠলেন এবং নামায শেষ করলেন তখন আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘হে আয়েশা! অথবা বলেছেন, ও হুমায়রা! তোমার কি এই আশঙ্কা হয়েছে যে, আল্লাহর রাসুল তোমার হক নষ্ট করবেন? আমি উত্তরে বললাম, না, ইয়া রাসুলুল্লাহ। আপনার দীর্ঘ সেজদা থেকে আমার আশঙ্কা হয়েছিল, আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন কি না। নবীজী জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি জান এটা কোন রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসুলই ভালো জানেন। তিনি তখন বললেন, এটা হল অর্ধ শা’বানের রাত। (শা’বানের চৌদ্দ তারিখের দিবাগত রাত)। আল্লাহ তায়ালা অর্ধ শাবানের রাতে তাঁর বান্দাদের প্রতি রহমতের দৃষ্টি প্রদান করেন, ক্ষমা প্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন এবং অনুগ্রহপ্রার্থীদের প্রতি অনুগ্রহ করেন। আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের ছেড়ে দেন তাদের অবস্থাতেই। (বায়হাকী ৩/৩৮২,৩৮৩)। উপরোক্ত হাদীস থেকে এ রাতের ফজীলত যেমন জানা যায় তদ্রূপ এ রাতের আমল কেমন হওয়া উচিত তাও বোঝা যায়। অর্থাৎ দীর্ঘ নামাজ পড়া, সেজদা দীর্ঘ হওয়া, দোয়া ইস্তেগফার করা ইত্যাদি।
লাইলাতুল বরাত পরিচিতি :
হাদিসে এ রাতকে বলা হয়েছে, ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’ বা শাবানের অর্ধ মাসের রাত। । আবার কোথাও বলা হয়েছে ‘লাইলাতুল বরাত’ বা মুক্তির রজনী। হজরত জালালুদ্দিন মহল্লী (রাহ.) এ রাতের আরও দুটি নামের কথা উল্লেখ করেছেন এভাবে, ক. ‘লাইলাতুল রাহমাত’ বা করূণার রাত। খ. ‘লাইলাতুস সাফ’ বা চুক্তিনামার রাত। (জালালাইল : ২/৪১০)। কেননা, এ রজনীতে সমগ্র সৃষ্টির প্রতি পরম দয়াময়ের পক্ষ হতে তার অপার করূণার বান বয়ে যায় এবং মানুষের জীবন-মরণ ইত্যাদি অন্যান্য বিষয়ে অজ¯্র চুক্তিনামা বা দলিলাদি স্বাক্ষরিত হয়। এ রাতকে শাফায়াতের রাতও বলা হয়। লাইলাতুল বরাত অধিক মর্যাদাপূর্ণ রাত। এ রাতে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে অনেক বরকত নাজিল হয়। অসংখ্য নেকী দান করা হয়। অনুগ্রহ ও দয়ার ভাÐার খুলে দেয়া হয়। গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেয়া হয়। বিশেষ করে এ রাত গুনাহের কাফফারা হিসেবে পরিগণিত হয়।
শবে বরাতের উদ্দেশ্য :
মহান রাব্বুল আলামিন মানবজাতিকে সৃষ্টি করে পৃথিবীতে অবস্থানকালীন সময়ে কিভাবে চলতে হবে এবং কী কী আমল করতে হবে এবং কোন কোন কাজ পরিহার করতে হবে তা পরিষ্কারভাবে বলে দিয়েছেন। তবুও মানুষ শয়তানের ধোকায় পড়ে অনেক পাপ করে থাকে। আল্লাহ বড়ই দয়ালু। তিনি চান অপরাধ করার পর বান্দাদেরকে একটি সুযোগ দিতে, যাতে তারা তাদের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়ে তার কাছে তাওবা করে। তাই তারা যদি এই রাতে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে, তবে তিনি ক্ষমা করে দিবেন। আর এ জন্য রাতটি ক্ষমা প্রার্থনার রাত। সুতরাং পাপী পারে এ রাতে ক্ষমা চেয়ে নিতে মহান রাব্বুল আলামিনের কাছ থেকে।
শবে বরাতে করণীয় :
প্রথমে গোসল করে নেয়া মুস্তহাব। তবে রাত আগমণের পূর্বেই আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন থাকলে তা ঠিক করে নিতে হবে। কারও হক থাকলে তা আদায় করে দিতে হবে। অন্তরকে কলুষমুক্ত করে নিবে। হজরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, শাবানের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাত যখন আসে তখন তোমরা এ রাতটি ইবাদত-বন্দেগীতে কাটাও এবং দিনের বেলা রোজা রাখ। কেননা, এ রাতে সূর্যাস্তের পর আল্লাহ তায়ালা প্রথম আসমানে আসেন এবং বলেন, কোন ক্ষমাপ্রার্থী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করব। আছে কি কোন রিজিকপ্রার্থী? আমি তাকে রিজিক দেব। এভাবে সুবহে সাদিক পর্যন্ত আল্লাহতায়ালা মানুষের প্রয়োজনের কথা বলে তাদের ডাকতে থাকেন। (ইবনে মাজাহ: ১৩৮৪)। তবে এ ক্ষেত্রে এই বিষয়টিও মনে রাখতে হবে যে, এ রাতের নফল আমলসমূহ, বিশুদ্ধ মতানুসারে একাকীভাবে করণীয়। ফরজ নামাজতো অবশ্যই মসজিদে আদায় করতে হবে। এরপর যা কিছু নফল পড়ার তা নিজ নিজ ঘরে একাকী পড়বে। এসব নফল আমলের জন্য দলে দলে মসজিদে এসে সমবেত হওয়ার কোন প্রমাণ হাদিস শরীফেও নেই আর সাহাবায়ে কেরামরে যুগেও এর রেওয়াজ ছিল না। (মারাকিল ফালাহ ২১৯)।
শবে বরাতে বর্জনীয় :
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, শবে বরাত একটি পূর্ণময় রজনী হওয়া সত্ত্বেও নানা পারিপার্শ্বিক কারণে তাতে এমন কিছু কুসংস্কার ও অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটেছে যা থেকে বিরত থাকা আবশ্যক। অন্যথায় এসব কার্যাবলী আমাদের ইহ ও পরকালের জীবনে কল্যাণ ও মুক্তির পরিবর্তে অকল্যাণ ও বিপদ বয়ে আনবে। যেমন: ১. আতশবাজি। ২. হালুয়া-রুটির বিশেষ আয়োজন। ৩. প্রয়োজনাতিরিক্ত আলোকসজ্জা। ৪. মাজারে বা গোরস্তানে মেলা উৎসব করা। ৫. একাগ্রতার প্রতি লক্ষ্য না দিয়ে ইবাদত ইত্যাদিতে বাহ্যিক জাঁকজমকের দ্বারা অনুষ্ঠানসর্বস্ব করে তোলা। ৬. হাড়ি-বাসন বদলানো। ৭. গলিকুচায়, শহরে-বন্দরে ঘোরাফেরা ও হই-হল্ল করা ইত্যাদি।
শবে বরাতে ক্ষমার অযোগ্য যারা :
এ রাতে দয়াময় আল্লাহ অসংখ্য মানুষের অপরাধ ক্ষমা দিলেও খাঁটি অন্তরে তওবা করা পর্যন্ত নিম্নবর্ণিত অপরাধীদের ক্ষমা করবেন না বলে কোরআন হাদিসে উল্লেখ রয়েছে।
১. মুশরিক, ২. জাদুকর, ৩. গণক, ৪. হিংসুক, ৫. গায়ক-গায়িকা, ৬. যারা বাদ্যযন্ত্র বাজায় ও বানায়, ৭. রেখা টেনে ফালনামা দেখে ভাগ্য ভবিষ্যৎ নির্ধারণকারী, ৮. আত্মীয়তা ছিন্নকারী, ৯. পরস্পর শত্রুতা পোষণকারী, ১০. জালেম শাসক ও তার সহযোগী, ১১. মিথ্যা শপথের মাধ্যমে পণ্য বিক্রয়কারী, ১২. পায়ের গিরার নীচে গর্বসহকারে জামা পরিধানকারী, ১৩. মদ্যপ, ১৪. পরস্ত্রীগামী, ১৫. মা-বাবার অবাধ্য সন্তান, ১৬. কৃপণ, ১৭. পরনিন্দাকারী, ১৮. অন্যায়ভাবে শুল্ক আদায়কারী। এ ছাড়া আরও অনেক অপরাধীর কথা বর্ণিত হয়েছে। যার সব কটি গুনাহে কবিরা। শবে বরাত ও শবে কদরের বরকতে সগীরা গুনাহ মাফ হয় বটে তবে গুনাহ থেকে ক্ষমা পেতে হলে খাঁটি মনে তাওবা করা আবশ্যক।
এ বরকতময় রাতে যেন আমরা আল্লাহর ইবাদতে মশগুল থাকতে পারি, কোরআন তেলাওয়াত করতে পারি, দেশ-জাতি ও আত্মীয়-স্বজনদের জন্য দোয়া করতে পারি, আল্লাহ আমাদের সে তাওফিক দান করুন। আমিন!
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন