শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ০৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৯ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সাহিত্য

সুকান্ত ভট্টাচার্য তার প্রতিবাদী চেতনা

ড. আশরাফ পিন্টু | প্রকাশের সময় : ১৮ মে, ২০১৮, ১২:০০ এএম

সুকান্ত ভট্টাচার্য; যার সময়কাল ১৯২৬ থেকে ১৯৪৭। মাত্র ২১ বছর। বাংলাদেশে ২১ বছর বয়সে অনেক কবি প্রতিষ্ঠা পাওয়া তো দূরের কথা কবিতা লেখাই শুরু করেন নি। ইংরেজকবি পার্সি বিশি শেলি (১৭৯২-১৮২২) ৩০ বছর এবং জন কিটস (১৭৯৫-১৮২১) ২৬ বছর বেঁচে ছিলেন। এদিক দিয়েও সুকান্তই বিশ্বসাহিত্যের একমাত্র কবি যিনি সবচেয়ে অল্প সময়ে কবিজীবন অতিবাহিত করেছেন। এই অতি অল্প সময়ে তিনি বাংলাসাহিত্যকে দিয়ে গেছেন এক অসাধারণ রতœভাÐার; যার মধ্যে আমরা পাই দেশপ্রেম, সমাজের সাধারণ মানুষের দুঃখ-দূর্দশার চিত্র ও প্রতিবাদী চেতনা।
সুকান্ত জন্মে ছিলেন এক দারিদ্রপীড়িত পরিবারে। দারিদ্রের কশাঘাতে সুকান্তের পরিবার সদা বিপর্যস্ত ছিল। শুধু সুকান্তের পরিবার নয়, গোটা বিশ্ব তখন বিপর্যস্ত। যুদ্ধ বিধ্বস্ত পুরো পৃথিবীময় জ্বলছিল তখন এক অশান্তির আগুন। পরাধীন ভারতেও ছড়িয়ে পড়েছিল সে দাবানল। যুদ্ধ-দুর্ভিক্ষ বিধ্বস্ত এ পৃথিবী তথা ভারতবর্ষের রূপ ক্ষত-বিক্ষত করেছে তার হৃদয়। তাই তো ব্যথিত চিত্তে তিনি বলেছেনÑ
অবাক পৃথিবী! অবাক করলে তুমি।
জন্মেই দেখি ক্ষুদ্ধ স্বদেশ ভূমি।
অবাক পৃথিবী! আমরা যে পরাধীন।
অবাক, কী দ্রæত জমে ক্রোধ দিন দিন।
(অনুভব : ১৯৪০)
সুকান্ত জন্ম থেকেই জ্বলেছেন; বলা যায় জীবনভর জ্বলেছেন। আর এ জ্বলা থেকেই তিনি প্রতিবাদী হয়ে উঠেছেন। তার বুকের ভিতরে লুকায়িত বেদনাবেগ প্রতিবাদীর হাতিয়ার হয়ে রূপ নিয়েছে কবিতায়। যে শিশুটি সবেমত্র জন্ম গ্রহণ করেছে পৃথিবীতে তার মধ্যেও তিনি লক্ষ্য করেছেন প্রতিবাদী চেতনাÑ
যে শিশু ভূমিষ্ঠ হলো আজ রাত্রে
তার মুখে খবর পেলুম :
সে পেয়েছে ছাড়পত্র এক,
নতুন বিশ্বের দ্বারে তাই ব্যক্ত করে অধিকার
জন্মমাত্র সুতীব্র চিৎকারে।...
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাবো আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
(ছাড়পত্র)
ভূমিষ্ঠের পর যে শিশুটির জন্য কবির দরদ, তাকে কি সত্যিকারের বাসযোগ্য পৃথিবীতে স্থান দিতে পেরেছেন? না, এ দারিদ্রপীড়িত শিশুরা চিরদিনই অবহেলিতÑঅপাঙক্তেয়। যারা পথে-ঘাটে ঘুরে বেড়ায়, ফুটপাতে প্লাটফরমে রাত কাটায়Ñতারা কীভাবে খাদ্য খায় কীভাবে শীতের কাপড় যোগার করেÑ এ নিয়ে মাথাব্যথা নেই কারো। এ সব শিশুর জন্য সূর্যের প্রতি সুকান্তের আহŸান ও প্রত্যাশাÑ
হে সূর্য!
তুমি আমাদের উত্তাপ দিওÑ
শুনেছি তুমি এক জ্বলন্ত অগ্নিপিÐ,
তোমার কাছে উত্তাপ পেয়ে পেয়ে
একদিন হয়ত আমরা প্রত্যেকেই এক একটা অগ্নিপিÐে পরিণত হবো।
তারপর সেই উত্তাপে যখন পুড়বে আমাদের জড়তা
তখন হয়ত গরম কাপড়ে ঢেকে দিতে পারব
রাস্তার ধারের ঐ উলঙ্গ ছেলেটাকে।
(প্রার্থী)
সুকান্ত দুঃখী-দরিদ্র সাধারণ মানুষকে নিয়ে লিখেছেন অধিকাংশ কবিতা। এসব কবিতার মধ্যে কিছু কবিতা আছে যা রূপকধর্মী। এগুলোতে অন্য বস্তুর রূপক-প্রতীকে কবি দরিদ্র-নিঃস্ব মানুষের বেদনার কথা ব্যক্ত করেছেন। এসব কবিতার মধ্যে সিঁড়ি, একটি মোরগের কাহিনী, কলম, সিগারেট, দেশলাই কাঠি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এসব কবিতার রূপকের আড়ালেও দেখা যায় প্রতিবাদী চেতনাÑ
আমরা বার বার জ্বলি, নিতান্ত অবহেলায়Ñ
তা তো তোমরা জানই।
কিন্তু তোমরা তো জান না :
কবে আমরা জ্বলে উঠবÑ
সবাই শেষবারের মতো।
(দেশলাই কাঠি)
বাংলাসাহিত্যে গণমুখী কবিতা রচনায় সুকান্তের দান অবিস্মরণীয়। অবশ্য বাংলাসাহিত্যে গণমুখী চেতনা চলে আসছে সেই প্রাচীনকাল অর্থাৎ চর্যাপদ থেকে। চর্যাপদের ধারাবাহিক পথ ধরে মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগের কবিরাও গণমুখী কবিতা লিখেছেন। তবে তুলনামূলক ভাবে আধুনিক যুগের কবিরাই সবচেয়ে বেশি গণমখী কবিতা লিখেছেন। সুকান্তের কবিতাও এরই ধারাবাহিকতার ফসল। তবে তিনি এসব কবিতা লেখায় বেশি অনুপ্রাণিত হয়েছেন মার্কসীয় দর্শন ও লেনিনের আদশের্র কারণে। তার কবিতায়ও এর প্রমাণ মেলেÑ
লেনিন ভেঙেছে রুশ জন¯্রােতে অন্যায়ের বাঁধ,
অন্যায়ের মুখোমুখি লেনিন প্রথম প্রতিবাদ।...
লেনিন ভূমিষ্ঠ রক্তে, ক্লীবতার কাছে নেই ঋণ,
বিপ্লব স্পন্দিত বুকে মনে হয় আমিই লেনিন।
(লেনিন)
সুকান্তের গণমুখী কবিতার প্রতিবাদী চেতনার মধ্যে দেশপ্রেম লুকায়িত আছে কিংবা বলা যায় দেশপ্রেমমূলক কবিতার মধ্যে রয়েছে তার এ গণমুখী চেতনা। মূলত তার দেশপ্রেম ও গণমুখিতা ওৎপ্রোত ভাবে জড়িত। তার ‘‘দুর্মর’’ কবিতার কিয়দংশ লক্ষ্য করা যাকÑ
সাবাস, বাংলাদেশ, এ পৃথিবী
অবাক তাকিয়ে রয় :
জ্বলে-পুড়ে মরে ছাড়খার
তবু মাথা নোয়াবার নয়।
সুকান্তের এসব কবিতা সামন্তবাদকে তীব্র ভাবে আঘাত করেছে এবং তাদের ভিতকে প্রবল ভাবে নাড়িয়ে দিয়েছে। যখন অনেক কবি প্রকৃতির প্রেমে মগ্ন, চাঁদকে তুলনা করছেন প্রেয়সীর মুখের সাথে তখন একমাত্র সুকান্তই বাস্তবজীবনের মুখোমুখি হয়ে বলতে পারেনÑ
ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময় :
পূর্ণিমা চাঁদ যেন ঝলসারো রুটি।
(হে মহাজীবন)
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় যখন কবিতায় এ নতুন ¯্রােতের (গণমুখী চেতনা) জোয়ার প্রবাহিত করেছেন ব্যাপক ভাবে। এমনি সময় কবি সুভাষের কাছে পৌঁছে যায় কিশোর কবি সুকান্তের একটি কবিতার খাতা। সুকান্তের কবিতা পড়ে সুভাষ মুখোপাধ্যায় মুগ্ধ হলেন এবং বাংলাসাহিত্যে এক শক্তিমান কবির আগমন লক্ষ্য করলেন। সুকান্তের কবিতা সম্পর্কে বিশিষ্ট সাহিত্যিক বদরুদ্দীন উমর বলেছেন, ‘‘যে যুগে সুকান্তের আবির্ভাব সে যুগের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো শ্রেণিসংগ্রামের অপেক্ষাকৃত তীব্রতা এক উচ্চতর পর্যায়ে তার উত্তরণ।’’
পরিশেষে তুরস্কের বিপ্লবী কবি নাজিম হিকমতের বক্তব্য উপস্থাপন করে বলা যায়, ‘‘সেই শিল্প খাঁটি শিল্প, যার দর্পণে জীবন প্রতিফলিত। তার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে যা কিছু সংঘাত, সংগ্রাম আর প্রেরণা; জয় ও পরাজয় আর জীবনের ভালোবাসা। খুঁজে পাওয়া যাবে একটি মানুষের সবকটি দিক। সেই হচ্ছে খাঁটি শিল্প, যা জীবন সম্পর্কে মানুষকে মিথ্যা ধারণা দেয় না।’’ সুকান্তের কবিতার মধ্যেও আমরা এ বক্তব্যের যথার্থতা খুঁজে পাই।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
সাইফুল ইসলাম খান ২২ এপ্রিল, ২০২১, ১২:০৬ পিএম says : 0
ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময় পূর্ণিমা-চাঁদ যেন ঝল্‌সানো রুটি [হে মহাজীবন- সুকান্ত ভট্টাচার্য]
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন