আমাদের দেশে সরকারি ও বেসরকারি এতিম খানা বিক্ষিপ্ত ভাবে রয়েছে। ধর্ম প্রাণ বিত্তশালী লোকদের আর্থিক সাহায্য সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা-তত্ত¡াবধানে প্রতিষ্ঠিত এসব এতিম খানা মানবতার অন্যতম সেবা কেন্দ্র এরূপ প্রশংসনীয় উদ্যোগ প্রয়াস আরও অধিক হওয়া যেমন জরুরী তেমনি উন্নয়ন, সংস্কার তৎপরতাও বৃদ্ধি পাওয়া উচিত।
বিভিন্ন এতিম খানায় লালিত, প্রতিপালিতদের বিয়ে-শাদীর ব্যবস্থা করে দেওয়ার উদ্যোগের খবর মাঝে মধ্যে দেখা যায়। এরূপ উদ্যোগ নি:সন্দেহে উৎসাহ ব্যঞ্জক এবং প্রশংসনীয়। বিভিন্ন জাতির মধ্যেও এতিম খানার প্রচলন রয়েছে বলে জানা যায়। তারা এতিম শিশুদের আপন সন্তান মনে করে এবং এতিমদের সুযোগ সুবিধার জন্য উন্নত ব্যবস্থা করে থাকে। এতিম খানা কর্তৃপক্ষ ওদের শিক্ষা দীক্ষায় উন্নত ব্যবস্থা করে থাকে। এতিম খানা থেকে বের হয়ে ওরা রাষ্ট্রে ও সমাজে সুখী স্বাচ্ছন্দ্য জীবন যাপন করতে সক্ষম হয়। কিন্তু আমাদের দেশে সরকারি, বেসকারি পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত এতিম খানাগুলোর ব্যবস্থাপনার নানা অভিযোগ রয়েছে। এতিম খানাগুলোকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং মাদ্রাসায় পরিণত করা হলে সেখান থেকে এতিমরা সুশিক্ষিত ও স্বনির্ভর হয়ে বের হতে পারে। পথে-ঘাটে, এখানে-সেখানে লাগামহীন ভাবে ঘোরা-ফেরাকারী শিশুদেরকে এতিম খানাগুলোতে ভার্তি করা হলে, তাদেরকে শিশু শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার করার সুযোগ থাকবে না। তাছাড়া রাস্তা-ঘাটে, হাটে-বাজারে এবং যত্রতত্র ঘোরাফেরা করে বিপথে পরিচালিত হওয়ার সুযোগও থাকবে না।
এক এতিম বাচ্চার সাথে রসূলুল্লাহ (সা:) এর কথোপকথনের অদ্ভুত কাহিনী:
বিখ্যাত আরবী সাহিত্যিক হযরত শাহাবুদ্দীন কালয়ূবী তাঁর ‘নাওয়াদিরাত’ গ্রন্থে একটি অদ্ভুত ঘটনা বর্ণনা করেছেন, যার সংক্ষিপ্ত সার এই;
“এক ঈদের দিন রসূলুল্লাহ (সা:) ঈদের নামাজের জন্য গমন করছিলেন। পথে তিনি কয়েকটি শিশুকে খেলা ধূলা করতে দেখেন, কিন্তু একটি বিষণœ, ক্রন্দনরত শিশুকে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হে বৎস, তুমি কেন চিন্তিত?’ শিশুটি তাকে চিনত না। সে একটি ঠান্ডা নি:শ^াস নিয়ে বেপরোয়া ভাবে জবাব দেয়, ‘হে ব্যক্তি, আপনি কি জানেন, আমার পিতা একটি যুদ্ধে শহীদ হয়েছে, আমার মা দ্বিতীয় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে এবং আমার পিতার সমস্ত সহায়-সম্পদ নিয়ে চলে গিয়েছে। দ্বিতীয় পিতা (মায়ের দ্বিতীয় স্বামী) আমাকে বের করে দিয়েছে, এখন আমার কোন অভিভাবক নেই, কোন লালন পালনকারীও নেই। এ দু:খজনক অবস্থায় আমি বিষণœ বসে আছি।’ রসূলুল্লাহ (সা:) এ শিশুর বেদনা দায়ক কাহিনী শ্রবণ করে বললেন; তুমি কি এই কথা পছন্দ কর যে, তোমার পিতা নেই। মোহাম্মদ (সা:) তোমার পিতা হয়ে যাবেন, আয়েশা (রা:) তোমার মা হয়ে যাবেন এবং হাসান (রা:) ও হোসেন (রা:) এবং ফাতেমা (রা:)তোমার ভাই-বোন হয়ে যাবেন?’ শিশুটি আরজ করল; মোহাম্মদ (সা:) অপেক্ষা হাজারবার আমার পিতাকে আমি কোরবান করতে প্রস্তুত, আয়েশা (রা:) হতে উত্তম মা এবং খাতুনে জান্নাত হতে উত্তম বোন ও হাসান (রা:) এবং হোসেন (রা:) অপেক্ষা উত্তম ভাই আমি কোথায় পাব?’ এরপর হুজুর (সা:) শিশুটিকে তাঁর ঘরে নিয়ে আসেন এবং হযরত আয়েশা (রা:) কে নির্দেশ দেন, তাকে খাওয়াতে এবং পোষাক পরিধান করাতে। শিশুটি হুজুর (সা:) এর তত্ত¡াবধানে থেকে বড় হতে থাকে। তাঁর ওফতের পর এ শিশু মাথায় মাটি মেখে চিৎকার এবং বিলাপ করতে থাকে এবং বলতে থাকে যে, ‘আজ আমি এতিম হয়েছি। যতদিন হুজুর (সা:) জীবিত ছিলেন, একদিনও আমার মনে হয়নি আমি এতিম।’ হুজুর (সা:) এর ওফাতের পর হযরত আবু বকর ছিদ্দীক (রা:) তার অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেন।
হুজুর আকরাম (সা:) নিজেও ছিলেন এতিম। তাই এতিমদেরকে তিনি অত্যন্ত ভালোবাসতেন, ¯েœহাদর করতেন। এতিমদের লালন পালন ও তাদের স্বার্থ ও অধিকার সংরক্ষণের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপা করতেন। মুসলমানগণ ইসলামের এ মহান আদর্শ শিক্ষা হতে দূরে সরে যাওয়ায় আমাদের সমাজে এতিম মিসকিন ও দরিদ্র, অভাবীদের দুরাবস্থা চরম আকার ধারণ করেছে। এ উপেক্ষিত নিগৃহীত, বঞ্চিত শ্রেণীর কথা বিস্মৃত হয়ে যখন বিত্তশালী, অর্থবান লোকেরা তাদের ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদেরকে নিয়ে ঈদ উৎসবের কেনা কাটায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে, তখন ঐ বঞ্চিত, অবহেলিত শ্রেণীর ছেলে-মেয়েদের মনের অবস্থা কি হতে পারে তা কি কেউ একবারও ভেবে দেখে? অভিভাবকহীন এ বিরাট শিশু সমাজ ও অবস্থাবান পরিবারগুলোর শিশু সন্তানদের ন্যায় ঈদের আনন্দ ভোগ করার অধিকারী। এ আনন্দঘন মূহুর্তে তাদের প্রতি যথাযথ সহানুভ‚তির দৃষ্টি প্রদর্শণ করা রাষ্ট্র ও সমাজপতিদের দায়িত্ব।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন