বুধবার, ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১, ২৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

উপ সম্পাদকীয়

শিক্ষাঙ্গনকে সন্ত্রাস-দলীয়করণ ও অনৈতিক বাণিজ্যমুক্ত করতে হবে

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ১৮ জুলাই, ২০১৮, ১২:০২ এএম

প্রায় ৮০০ বছর মুসলমানদের দ্বারা শাসিত হওয়ার পর ভারতীয় উপমহাদেশ বৃটিশদের দখলে যায়। মোঘল শাসনের আগে দিল্লীকেন্দ্রিক অখন্ড রাজনৈতিক মানচিত্র ছিলনা। মুসলমান শাসকরা শত শত বছরে এসব রাজ্য দখল করে প্রথম এই বিশাল ভ‚-ভাগকে একক রাষ্ট্রশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। অতএব ভারতের প্রথম রাজকার্য, আইন ও বিচারব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা ও সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল মুসলমানদের প্রবর্তিত। মোঘল আমলে হিন্দু-মুসলমানের সহাবস্থান ও সম্প্রীতির বন্ধনই রাষ্ট্রশক্তি হিসেবে ভবিষ্যতের সম্ভাবনাময় ভারতের ভিত্তি রচনা করেছিল। আজকের হিন্দুত্ববাদি ভারতীয়রা যে যা’ই বুলন, হিন্দু-মুসলমানের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও সম্প্রীতি না থাকলে প্রায় হাজার বছর ভারত শাসন করা মুসলমানদের পক্ষে সম্ভব হতনা। শুধুমাত্র তরবারি বা বন্দুকের জোরে হাজার বছর কোন জাতিকে দাবিয়ে রেখে শাসন করা যায়না। হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে জাতিগত যেটুকু হিংসা ও বিভেদ-বৈরীতা ছিল তা] শতগুণ বাড়িয়ে তোলার ইন্ধন যোগিয়েই বেনিয়াবেশি ইংরেজরা ভারত দখলের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝিতে মধ্য প্রদেশের রায়ঘর এলাকায় মোঘলদের সাথে ছত্রপতি শিবাজির বিদ্রোহ এবং হিন্দু ও শিখদের মধ্যকার দ্বন্দ ও আধিপত্যের লড়াই ছিল ভারতে ইংরেজদের আধিপত্য বিস্তারের প্রাথমিক ক্ষেত্র। আর হাজার বছর ধরে ভারতের হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে যে লৌকিক ও আধ্যাত্মিক যোগ ছিল তা থেকে বিচ্যুত করার মধ্য দিয়েই বৃটিশরা ভারতে দীর্ঘস্থায়ী ঔপনিবেশিক শাসনের ভিত্তি গড়ে তোলার উদ্যোগ হিসেবে তারা ভারতের হিন্দু-মুসলমানের উপর একটি বস্তুবাদি শিক্ষাব্যবস্থা চাপিয়ে দিতে সচেষ্ট হয়েছিল। অষ্টাদশ শতকের শুরুতে ভারতে নতুন শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে গিয়ে বৃটিশরা প্রথমেই হিন্দু-মুসলমানের ট্রাডিশনাল শিক্ষাব্যবস্থা যেখানে মোঘলরা সংস্কৃত- ফার্সি ভাষায় লিখিত হিন্দু ও মুসলমানদের ধর্মীয় ঐতিহ্য, গ্রীক ও পারস্যের জ্ঞানবিজ্ঞানের সমন্বয় ঘটেছিল সেই শিক্ষাব্যবস্থাকে অগ্রাহ্য করে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানীর নিয়োগকৃত শিক্ষাবিদ রাজনীতিক টমাস বেবিংটন ম্যাকলে শিক্ষার একমাত্র মাধ্যম হিসেবে ইংরেজী ভাষার প্রস্তাবের পাশাপাশি শিক্ষাকে কর্মমূখী করে তোলার প্রস্তাব পেশ করেন। তাঁর প্রস্তাব অনুসারে বৃটিশ পার্লামেন্ট ১৮৩৫ সালের শিক্ষা আইন পাস করে। বিশেষত মুসলমানদের কোরানের শিক্ষা থেকে বিচ্যুত করা এবং হিন্দুদের সংস্কৃত ও বেদ-উপনিষদের শিক্ষা থেকে বিচ্যুত করাই ছিল ম্যাকলের শিক্ষানীতির মূল লক্ষ্য। ম্যাকলের শিক্ষাব্যবস্থাকে হিন্দুরা সাদরে গ্রহণ করলেও মুসলমানরা তা মেনে নিতে পারেনি। যেখানে অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে শুধুমাত্র বাংলা ও বিহারের গ্রামাঞ্চলে ১০০ হাজারের বেশী গুরুকুল, মক্তব ও মাদরাসা ছিল, সেখানে ১৮৩৫ সালের পর নতুন ইংরেজী মাধ্যম স্কুলে যাত্রা শুরুর পর সে সব ট্রাডিশনাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা মাত্র কয়েক হাজারে নেমে আসে। নতুন শিক্ষায়তনে ১৮৯০ সাল নাগাদ প্রায় ৬০ হাজার ভারতীয় মেট্টিক পাস করেছিল বলে জানা যায়। এদের মধ্যে প্রায় এক-তৃতীয়ংশ সরকারী চাকুরীতে নিয়োগ পায়। ১৮৮৭ সালে হিসাবে প্রায় ২১ হাজার নি¤œ ও মধ্য সারির সরকারী চাকুরীর মধ্যে শতকরা ৪৫ ভাগ পেয়েছিল হিন্দুরা, ৪৮ ভাগ পেয়েছিল (যথাক্রমে ২৯ ও ১৯ ভাগ) বৃটিশ ও বৃটিশ বংশোদ্ভুতরা (বৃটিশ বাবা ও ভারতীয় মা) আর বাকি ৭ ভাগ পেয়েছিল মুসলমানরা। তবে উচ্চপদে নিয়োগ পাওয়া প্রায় সকল পদই ছিল অক্সব্রিজ ডিগ্রীধারি বৃটিশদের দখলে। ইংরেজের দুইশ বছরের ঔপনিবেশিকতার যুগ পেরিয়ে গত ৭০ বছরে উপমহাদেশের রাজনৈতিক মানচিত্রে আরো দুইবার বড় ধরনের পরিবর্তন সূচিত হওয়ার পরও মুসলমানদের সেই পিছিয়ে পড়ার ধারাক্রম এখনো অব্যাহত আছে।
আমাদের রাজনৈতিক সংগ্রামের সাথে যে চেতনাগত জাতীয় লক্ষ্য ছিল তার সাথে শিক্ষাব্যবস্থার যেন কোন সম্পর্কই নেই। যে কোন জাতির শিক্ষাব্যবস্থা তার রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক জাতীয় লক্ষ্যকে সামনে রেখেই পরিচালিত হওয়ার কথা। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মধ্যে শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে একটি সাধারণ কনসেনশাস থাকলেও আমাদের রাষ্ট্র এখনো সুনির্দিষ্ট কোন প্রাতিষ্ঠানিক রূপরেখা তুলে ধরতে পারেনি। রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং ইসলামী মূল্যবোধ এখনো একটি প্রচ্ছন্নতার ধোঁয়াসায় আটকে আছে। যে কোন জাতিরাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থায় অবশ্যই রাষ্ট্রীয় মূলনীতির প্রতিফলন থাকা বাঞ্ছনীয়। রাজনৈতিক নেতৃত্ব যখন রাষ্ট্রীয় মূলনীতির প্রশ্নে জনগনের অবস্থান ও ইচ্ছার প্রতিফলন স্পষ্ট করতে ব্যর্থ হয় তার প্রভাব শিক্ষাব্যবস্থায় পড়তে বাধ্য। শিক্ষার জাতীয় লক্ষ্যের প্রতিফলন শুধুমাত্র উৎপাদনব্যবস্থা ও কর্মসংস্থানের উপর নিবদ্ধ থাকতে পারেনা। অথচ ইংরেজদের হাত ধরে অদ্যাবধি আমরা তথাকথিত কর্মমূখী শিক্ষার বিষময় ফল প্রত্যক্ষ করছি। ইংরেজদের লক্ষ্য ছিল এ দেশে এমন একটি শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তণ করা, যেখান থেকে কিছু ইংরেজী জানা লোকবল বেরিয়ে আসবে, যাদেরকে ইংরেজের প্রশাসনে পিয়ন-চাপরাশি, কেরানী বা হিসাব রক্ষক পদে কাজ করানো যায়। বিশাল ভারত শাসনের জন্য এত বিপুল সংখ্যক কর্মচারী ্ইংল্যান্ড থেকে এ দেশে আনা সম্ভব ছিলনা। তবে সব উচ্চ পদে বৃটিশ অথবা বৃটিশ বংশোদ্ভুত নাগরিকদেরই বসানো হয়েছিল। আরো পিছিয়ে গেলে দেখা যাবে, মুঘল স¤্রাট আকবরের রাজদরবারের বিশেষ বিশেষ উচ্চপদে হিন্দুদের বসানো হয়েছিল। মুঘলদের রাষ্ট্র পরিচালিত শিক্ষাব্যবস্থায় পতঞ্জলির সংস্কৃত, চরক ও আর্য়ুবেদ শাস্ত্র, ইবনে সিনা ও আরিস্টেটলের বিজ্ঞানও দর্শনেরও চর্চা হত। এমনকি অপেক্ষাকৃত রক্ষণশীল স¤্রাট হিসেবে পরিচিত আওরঙ্গজেবের সময়ও শিক্ষায় ভারতীয় পারস্য ও গ্রীক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও দর্শনের মেলবন্ধন অক্ষুন্ন ছিল। ইংরেজের প্রবর্তিত কর্মমূখী শিক্ষা এবং শিক্ষাকে সার্টিফিকেট সর্বস্ব করে তোলার পাশাপাশি ‘লেখাপড়া করে যে, গাড়িঘোড়া চরে সে’ ইত্যাদি শ্লোগান ছড়িয়ে দিয়ে শিক্ষিত প্রজন্মের মধ্যে বিলাসী ও আয়েশী জীবনের স্বপ্ন জাগিয়ে শিক্ষাকে কার্যত সমষ্ঠির সম্দ লুষ্ঠনের হাতিয়ারে পরিনত করা হয়েছিল। ভারতে ইংরেজের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও কৌশলগত দিক থেকে এটি হয়তো সঠিক ছিল। কিন্তু ঔপনিবেশোত্তর ৭০ বছরেও কেন আমরা একটি সমৃদ্ধ জাতি ও আলোকিত মানুষ গড়ার উপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার কোন উদ্যোগ দেখলাম না? বৃটিশদের ইংরেজী মাধ্যমের শিক্ষা প্রবর্তিত হওয়ার মধ্য দিয়ে আগের গুরুকুল, মক্তব ও মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা অনেকটাই ধ্বংস হয়ে গেলেও ইংরেজী বিমুখ মুসলমানরা সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই ধর্মীয় শিক্ষার একটি ধারা অক্ষুন্ন রাখতে সচেষ্ট থাকে। স্বনিয়ন্ত্রিত ও স্বাবলম্বি ধারা হিসেবে কওমী মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা এখনো অক্ষুন্ন আছে। সরকারী সুযোগ-সুবিধার বিনিময়ে তারা কখনোই নিজেদের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য ও স্বাধীনতায় আপস করেনি। সমাজের উৎপাদনব্যবস্থা তথা কর্মমূখী শিক্ষার ক্ষেত্রে মাদরাসাগুলো পিছিয়ে থাকলেও মাদরাসা শিক্ষিতরা কখনোই তাদের চাকুরী ও কর্মসংস্থানের জন্য সরকারের কাছে তদবির বা আন্দোলন করেনি। তবে শত বছর ধরে একটি স্বতন্ত্র ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবী জানিয়ে এসেছে, যা’তে মাদরাসা শিক্ষার মানোন্নয়নে বিশ্বমানের আলেমদের প্রাতিষ্ঠানিক সম্পৃক্ততা বাড়ে এবং মাদরাসা শিক্ষার মৌলিক লক্ষ্য বিসর্জন না দিয়ে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও কর্মমূখী শিক্ষার সমন্বয় করা যায়। এখন সমাজের সুবিধাভোগি ও উচ্চশিক্ষিত শ্রেনীর একটি বড় অংশ যখন আপাদমস্তক অনিয়ম-দুর্নীতি, লুণ্ঠন, দখলবাজিসহ নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে ,তখন অত্যন্ত স্বল্প আয়ের জীবন জীবিকা নিয়েও মাদরাসা শিক্ষিত হাফেজ, ক্বারী, মুফতি মাওলানারা , সৎ নির্লোভ ও স্বচ্ছ জীবন যাপনের দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা যখন দলীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তির মধ্য দিয়ে নিয়োগবাণিজ্য, টেন্ডারবাজিসহ নানা ক্ষেত্রে পেশাগত অসততা ও বিশৃঙ্খলায় জড়িয়ে পড়েছে, তখন আমাদের শিক্ষামন্ত্রী স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছেন, মাদরাসা শিক্ষিতরা শিক্ষক, ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হলে সমাজের মানুষ আরো ভাল সেবা পেত। তারা কখনো স্থাপনা নির্মানে রডের বদলে বাঁশ দিতনা। শিক্ষার্থী বা রোগীদেরকে জিম্মি করে শিক্ষা বাণিজ্য বা চিকিৎসার নামে মুনাফাবাজি করতনা। শিক্ষার মৌলিক লক্ষ্য ব্যর্থ হলে তথাকথিত কর্মমূখী শিক্ষা সমাজের শান্তি, শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তাকে কতটা বিপন্ন করে তোলতে পারে আমাদের বর্তমান সমাজবাস্তবতায় তারই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে।
বৃটিশদের প্রবর্তিত শিক্ষা কাঠামোর মূল লক্ষ্য ছিল উপমহাদেশে ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক শিক্ষার স্থলে ইংরেজী শিক্ষিত একটি বস্তুবাদি শ্রেণী গড়ে তোলা। মাত্র তিন দশকের মধ্যেই তাদের লক্ষ্য সফল হয়েছিল। এ দেশের প্রশাসনিক কর্মকান্ড, উন্নয়ন কর্মকান্ড এবং উৎপাদন ব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় দক্ষ শ্রমিক-কর্মচারির চাহিদা পুরণে তাদের শিক্ষাব্যবস্থা যথেষ্ট সক্ষম ছিল। নিজেদের ঔপনিবেশিক নিয়ন্ত্রণ ঠিক রাখতেই তারা উচ্চপদে বৃটিশ অথবা অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান নাগরিকদের নিয়োগ দিয়েছিল। তবে আমাদের বর্তমান রাষ্ট্র ও সমাজ যে ধরণের অবক্ষয়, অনিয়ম-লুণ্ঠনের শিকার হয়েছে বৃটিশ আমলেও তা ছিল কল্পনাতীত। শিক্ষিত শ্রেনীর এই লোভাতুর অবক্ষয়ের বীজ ঔপনিবেশিক বৃটিশদের হাতেই বপিত হয়েছিল। গত ৭০ বছরেও শিক্ষাব্যবস্থায় বস্তুবাদি ধারা পরিবর্তন না করে তা ক্রমশ একটি শিক্ষাবাণিজ্যে পরিনত করা সত্বেও এখন আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা সামাজিক-অর্থনৈতিক চাহিদা পুরণে পুরোপুরি ব্যর্থ হচ্ছে। দেশে সরকারী বেসরকারী শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয়, কারিগরী ও বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শত শত ভোকেশনাল ইনস্টিটিউট গড়ে উঠেছে। এমপিওভুক্তির মাধ্যমে জনগনের রাজস্ব থেকে এসব প্রতিষ্ঠানে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ হলেও তারা সমাজের কোন ধরনের চাহিদাই পুরণ করতে পারছেনা। প্রায় এককোটি অশিক্ষিত, অদক্ষ, অর্ধশিক্ষিত শ্রমিক বিদেশে শ্রম বিক্রি করে বছরে প্রায় দেড় হাজার কোটি ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখছে। দেশের লাখ লাখ শিক্ষিত যুবক চাকুরীর জন্য হণ্যে হয়ে ঘুরেও কর্মসংস্থান পাচ্ছেনা। এর বিপরীতে দেখা যাচ্ছে, দেশের রফতানীমূখী গার্মেন্টস শিল্পসহ ম্যানুফেকচারিং ও সেবাখাতে বেশ কয়েক লাখ বিদেশী (প্রধানত ভারতীয়)শ্রমিক আমাদের প্রবাসী শ্রমিকদের কষ্টার্জিত রেমিটেন্সের প্রায় অর্ধেক নিয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ আমাদের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, বিশেষায়িত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ভোকেশনাল ইনস্টিটিউটগুলো বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় মানসম্পন্ন যোগ্য নেতৃত্ব ও দক্ষ জনবল গড়ে তোলা দূরে থাক দেশের উৎপাদন ব্যবস্থার জন্য প্রয়োজনীয় জনবলের যোগান নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হচ্ছে, অথবা কোন কারণে নিয়োগ দাতারা দেশীয় জনবলের চেয়ে বিদেশীদের নিয়োগ দিতে বেশী উৎসাহী হয়ে উঠেছেন। সরকার দেশকে সামনে এগিয়ে নেয়ার রাজনৈতিক রূপকল্প শোনাচ্ছে বটে। বাস্তবতা হচ্ছে, দেশের বাণিজ্য ঘাটতি এখন উদ্বেগজনক অবস্থায় উপনীত হয়েছে। আমদানীর তুলনায় দেশের রফতানী বাণিজ্য পিছিয়ে পড়ছে। বৈদেশিক কর্মসংস্থানে নেতিবাচক ধারা দেখা দিলেও দেশীয় কর্মক্ষেত্রে বিদেশী শ্রমিকদের নিয়োগ বেড়ে চলেছে। বিদেশি বিনিয়োগ শুণ্যের কোঠায় নেমে এলেও প্রতিমাসে দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। একদিকে সরকারী চাকুরীতে কোটা ব্যবস্থার খড়গ, অন্যদিকে বেসরকারী চাকুরীতে বিদেশি শ্রমিকদের নিরব আগ্রাসন দেশের কর্মসংস্থান ও সামাজিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে ভেতর থেকে ফোঁকলা ও ভঙ্গুর করে তুলেছে। আমাদের সমাজে, আমলাতন্ত্রে, গণতন্ত্রে ও রাজনৈতিক পরিমন্ডলে, অর্থনৈতিক বাস্তবতায় সর্বগ্রাসী অবক্ষয় গ্রাস করেছে। এর জন্য মূলত দেশের ঠুটো জগন্নাথ শিক্ষাব্যবস্থা দায়ী।
দেশের শিক্ষাব্যবস্থার প্রাক-প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত একটি অবাধ ও প্রতিযোগিতামূলক সার্টিফিকেট বাণিজ্যে পরিনত হয়েছে। তথাকথিত নামিদামী স্কুলগুলোর ভর্তি বাণিজ্য, কোচিং বাণিজ্য, প্রাইভেট টিউশনীর মচ্ছব নতুন করে উদ্ধৃত করার প্রয়োজন নেই। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষক নিয়োগ থেকে শুরু করে ছাত্র ভর্তি, টিউশন ফি আদায়, পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ পাওয়া এবং পরীক্ষার্থীদের কাছে আগেই প্রশ্নপত্র পৌছে দেয়া এবং পরীক্ষার পর খাতা মূল্যায়ন ও উচ্চ গ্রেড নিশ্চিত করা পর্যন্ত প্রতিটি ধাপেই অনৈতিক তৎপরতা, যোগসাজশ ও কোটি কোটি টাকার ঘুষ বিনিময় এখন অনেকটা ওপেনসিক্রেট। অনেক বিত্তশালী পরিবার শিক্ষার জন্য সন্তানদের বিদেশে পাঠিয়ে দিলেও মধ্যবিত্ত-নিম্ম-মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরা এভাবে বাধ্যতামূলক অনৈতিক বাণিজ্যের ধকল সয়ে দেশে লাখ লাখ টাকা ব্যয় করে উচ্চশিক্ষার পাঠ সমাপ্ত করার পর প্রত্যাশিত চাকুরী পেতে অস্বাভাবিক কোটার খড়গ অথবা লাখ লাখ টাকা ঘুষের নতুন ফাঁদে পড়তে বাধ্য হচ্ছে। সার্টিফিকেট সর্বস্ব পাবলিক পরীক্ষা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাধারণ মানুষের ব্যয়বাহুল্য ও অনৈতিক লেনদেনের এই চিত্র আমূল বদলাতে না পারলে সামাজিক-রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ণ, অবক্ষয়, অস্থিরতা ও নিরাপত্তাহীনতা দূর করা যাবেনা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে উচ্চশিক্ষা, গবেষনা, জ্ঞানবিজ্ঞান, রাজনৈতিক ও দার্শনিক মতবাদ চর্চার নিরাপদ ক্ষেত্রে পরিনত করার মধ্য দিয়েই বিশ্ব সভ্যতা এক সময় পূর্ণতা লাভ করেছে। জাতি হিসেবে আমাদের ঐতিহাসিক-রাজনৈতিক বিবর্তনের সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবিস্মরণীয় ভ’মিকা রয়েছে। আর আমাদের সামাজিক-রাজনৈতিক অধ:পতনের শুরুও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যর্থতা থেকেই উৎসারিত। গত তিন দশকের বেশী সময় ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাকসু নির্বাচন না দিয়ে ক্ষমতাসীনরা বিশ্ববিদ্যালয়কে নিজ দলের অনুগত শিক্ষক ও ছাত্র সংগঠনের একচ্ছত্র আধিপত্যের জায়গায় পরিনত করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যাশিত পরিবেশ ও মৌলিক বৈশিষ্ট্যের বিপরীত অবস্থা এটা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যর্থতা ও সীমাবদ্ধতার প্রভাব দেশের অন্য সব বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চশিক্ষাঙ্গনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এক সময়ের প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখন রাজনৈতিক নিপীড়নের অভয়ারণ্যে পরিনত হয়েছে। সাম্প্রতিক কোটা আন্দোলনে সাধারণ শিক্ষার্থী অধিকার সংরক্ষণ আন্দোলনের কর্মী-সমর্থকদের উপর ছাত্রলীগ কর্মীদের বেপরোয়া সন্ত্রাসী ভ’মিকা এবং ভিসি, শিক্ষক সিন্ডিকেট ও প্রভোস্ট কমিটির বিতর্কিত বক্তব্য এবং নিরাপত্তার নামে বিশ্ববিদ্যালয়কে জনবিচ্ছিন্ন করে ফেলার মত সিদ্ধাš, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারি শিক্ষার্থীকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে পঙ্গু করে ফেলা, ছাত্রীদের ধর্ষণের প্রকাশ হুমকি ইত্যাতি থেকে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বাস্তব অবস্থা এখন জাতির সামনে পরিষ্কার। গত সোমবার দৈনিক ইনকিলাবসহ বেশকিছু দৈনিক পত্রিকায় এবং কুষ্টিয়া ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় একজন চাকুরী প্রার্থীর সাথে ২০ লাখ টাকা লেনদেনের তথ্য জানা যায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ সংক্রান্ত একাধিক অডিও ক্লিপ ছড়িয়ে পড়েছে। এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়ে এটুকু বলা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ছাত্রলীগ এবং সরকারী দলের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা এখন নিয়ামক শক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। দলীয়করণের কারণে মেধাবীরা বঞ্চিত হওয়ায় পুরো শিক্ষাব্যবস্থাই এখন অকার্যকর হয়ে পড়েছে। দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাব্যবস্থাকে এ অবস্থা থেকে মুক্ত করতে না পারলে আমাদের সব সম্ভাবনা ও সামাজিক-রাজনৈতিক প্রত্যাশা ব্যর্থতায় পর্যবশিত হবে।
bari_zamal@yahoo.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন