একটি দস্তুর বা নিয়মতান্ত্রিকতা মাফিক আমল করার পূর্বে আমাদের উচিত, সেই দস্তুরের সৌন্দর্য এবং সত্যতার উপর বিশ্বাস স্থাপন করা। যদি তা না হয়, তাহলে আমরা ঈমানদারীর সাথে না কোন কাজ সম্পন্ন করতে পারব, না আমাদের প্রাণ প্রতিষ্ঠায় এর কোনো প্রভাব ও প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে।
এই হাকীকত ও যথার্থতা সার্বিক দলিল-প্রমাণ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত যে, আমাদের সকল কর্মকান্ড, আমল-অনুষ্ঠান অন্তরের অধীনস্থ। তাই যতক্ষণ পর্যন্ত অন্তর পরিবর্তিত না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের কাজ-কর্ম ও চিন্তা-ভাবনায় পরিবর্তন সাধিত হবে না। অর্থাৎ আমাদের সার্বিক কর্মকান্ডের সংস্কার ও পরিশুদ্ধি আমাদের অন্তরের পরিশুদ্ধি ও সংস্কারের প্রভাবাধীন। আর ঈমান এবং বিশ্বাসের উদ্দেশ্য হচ্ছে এই আত্মিক সংস্কার ও বিশুদ্ধতা। কেননা অন্তর যদি ঠিক হয়ে যায়, যথার্থ অবস্থায় নীত হয়ে যায়, তাহলে সব কিছুই পরিশুদ্ধ ও বিশুদ্ধ হতে বাধ্য।
এক্ষেত্রে একটি সুনির্দিষ্ট দিক-নির্দেশনা সম্পর্কে সচেতন হওয়া দরকার যা অনুধাবন না করা পর্যন্ত সামনে অগ্রসর হওয়া ঠিক নয়।
ইহুদিরা সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছিল ব্যবহারিক রীতি-নীতি ও আমলের ওপর। আর খ্রিস্টানরা এর বিপরীত শুধু ঈমানের উপরই মুক্তি ও নিষ্কৃতির মানদন্ড কায়েম করেছিল। এ জন্যই হাওয়ারীদের পত্রাবলী ও বাক্যাবলীর মাঝে এই শিক্ষাকে অনেক পরিপাটিসহ তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে যে, আমল নয়; বরং শুধু কেবল ঈমানই মুক্তির উপায়।
কিন্তু ইসলামের পরিপূর্ণতার প্রথম শান হচ্ছে এই যে, এই উভয় দিকের সংস্কার সাধন করে উভয় মতবাদকে একই বৃন্তে গ্রথিত করা। এজন্য ইসলামী আদর্শ হলো, নাজাত বা মুক্তি কেবল ঈমান অথবা আমলের উপরই নির্ভরশীল নয়; বরং মুক্তি ও নিষ্কৃতি বিশুদ্ধ ঈমান এবং নেক আমলের সমষ্টির উপরই নির্ভরশীল। আল কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে: “যারা ঈমান এনেছে এবং নেক আমল করেছে।” দ্বিতীয়তঃ, ইসলাম ঈমানকে শুধু কেবল ঈমানের কারণেই গুরুত্ব প্রদান করে না। তবে এজন্য গুরুত্বদান করে যে, ঈমানই হচ্ছে নেক আমলের কারণ ও হেতু। অর্থাৎ ঈমানই নেক আমলের জন্য পথ প্রস্তুত করে এবং এর ফল ও ফসলের জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করে।
একথা অবশ্যই সুস্পষ্ট যে, বৃক্ষকে ফল দ্বারাই চেনা যায়। এজন্য ঈমানের বীজের পরিচয়ও তার ফল দ্বারা চিহ্নিত হয়। তাই এমন কোনও লোক যদি তোমার নজরে পড়ে যে, মুখে ঈমানের দাবি করে, কিন্তু তার কার্যাবলীর মাঝে ঈমান মোতাবেক কোনও উত্তম আদর্শ পরিলক্ষিত না হয়, তাহলে বুঝতে হবে যে, ঈমান তার মুখ হতে নেমে এসে তার অন্তরের নিভৃত পরিসরে ফুল ও পল্লবের সমাবেশ করতে পারেনি। এজন্যই কুরআনুল কারীমে প্রত্যেক নেকী ও উত্তম কাজকে ঈমানের মূল উৎস এবং বিশ্বাসীদের অপরিহার্য গুণ বলে সাব্যস্ত করেছে। প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ কাজে মুসলামনদেরকে “হে ঈমানদারগণ” বলে সম্বোধন করেছে। যার দ্বারা বুঝা যায় যে, এ সকল আহকামের উপর তারাই আমল করতে পারে যারা ঈমানের সাথে সংশ্লিষ্ট। আল কুরআনের বহু স্থানে বলা হয়েছেঃ “যদি তোমরা মুমিন হও।” এতে বুঝা যায়, এ কথাটি শুধুমাত্র ঈমানদারদের জন্যই সংশ্লিষ্ট এবং তারাই এ কাজের যথার্থ উপযুক্ত ও উপযোগী।
অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছেঃ “ঈমানদারগণ সবচেয়ে বেশি আল্লাহকে মহব্বত করে।” (সূরা বাকারাহঃ রুকু-২০) এতে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহর মহব্বত ঈমানের অনেক বড় আলামত। অপর এক সূরাতে ইরশাদ হয়েছেঃ “ঈমানদারদের কথা হচ্ছে এই যে, যখন তাদেরকে ফায়সালা করার জন্য আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি আহবান করা হয়, তখন তারা বলে, আমরা শ্রবণ করেছি এবং আমরা মেনে নিয়েছি এবং তারাই হচ্ছে সফলকাম।” (সূরা নূরঃ রুকু-৭) এর দ্বারা বুঝা যায়, ঈমানের একটি ফল হলো আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের আনুগত্য প্রকাশ করা এবং তাঁর ফায়সালাকে নত মস্তকে মেনে নেয়া। অপর এক আয়াতে ঘোষণা করা হয়েছেঃ “ঈমানদারগণ পরস্পর ভাই।” (সূরা হুযুরাতঃ রুকু-১) এর দ্বারা প্রতীয়মান হয়, মুসলমানদের মাঝে পরস্পর মহব্বত এবং বন্ধুত্ব হওয়াও ঈমানের চিহ্ন। অপর এক আয়াতে ঘোষণা করা হয়েছেঃ “ঈমানদারদের উচিত আল্লাহর উপর ভরসা করা।” (সূরা আলে-ইমরানঃ রুকু-১৭) এক্ষেত্রেও দেখা যায় যে, আল্লাহর উপর ভরসা ও তাওয়াক্কুল করা ঈমানদারদের বৈশিষ্ট্য। সুরা মু’মিনুনে ঈমানদারদের গুণাবলী সম্পর্কে ঘোষণা করা হয়েছেঃ “নিঃসন্দেহে ঈমানদারগণই নিষ্কৃতি লাভ করেছে যারা বিনীতভাবে নামাজে নিরত থাকে এবং যারা বাজে কথায় কর্ণপাত করে না এবং যারা যাকাত আদায় করে এবং যারা লজ্জাস্থানের হেফাজত করে... যারা নিজেদের আমানত এবং অঙ্গীকার সম্পর্কে সচেতন থাকে এবং স্বীয় নামাজের পাবন্দী করে।” (সূরা মু’মিনুনঃ রুকু-১)
এই আয়াতসমূহের দ্বারা ঈমানদারদের আবশ্যকীয় গুণাবলীর কথা জানা যায়। নামাজে একান্ত বিনয়ী হওয়া, নিরর্থক কথাবার্তা পরিহার করা, যাকাত ও খয়রাত দান করা, পবিত্রতা অর্জন করা, কুরবানী করা, আমানত রক্ষা করা, অঙ্গীকার পূরণ করা এবং নামাজের পাবন্দী করা এই আয়াতসমূহের মাঝে এক আশ্চর্য রহস্য। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, ঈমানদারদের গুণাবলীর প্রারম্ভ নামাজ থেকেই হয়েছে এবং শেষ পরিণতিও নামাজের উপরই রাখা হয়েছে। এর দ্বারা ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, নামাজ ঈমানের প্রাথমিক ও সর্বশেষ চিহ্ন। এ কারণেই ঈমানের পরে এর উপর বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
এখানে আমরা কয়েকটি আয়াত উদাহরণস্বরূপ উপস্থাপন করেছি। অন্যথায় কেউ যদি তালাশ করে, তাহলে কুরআনুল কারীমে ঈমানের নিদর্শনাবলী ও শুভফল অনেক লাভ করবে এবং হাদীস শরীফেও এই বিষয়বস্তুর কমতি নেই। সহীহ হাদীসে আছে, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “ঈমানের সত্তরেরও অধিক শাখা রয়েছে।” হাফেজ বায়হাকী স্বীয় কিতাব ‘শুয়াবুল ঈমানে’ বিভিন্ন হাদীসের মাধ্যমে ঈমানের এই সত্তরটি শাখা উপস্থাপন করেছেন এবং এই কিতাবের সংক্ষিপ্ত সারাংশ ‘শুয়াবুল ঈমান’ নামে প্রকাশিতও হয়েছে।
একটি হাদীসে ঈমানের পরিচয় বলতে চারিত্রিক পবিত্রতাকে তুলে ধরা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, “মুমিনদের মাঝে ঐ ব্যক্তির ঈমান সবচেয়ে বেশি কামেল, যার চরিত্র সবচেয়ে উত্তম।” (সুনানে আবু দাউদ) সচ্চরিত্রতার মৌলিক কেন্দ্র হচ্ছে মহব্বত। এই মহব্বত সর্বপ্রথম ঐ সত্তার সাথেই হওয়া দরকার যিনি সকল মহব্বতের পাদপীঠ এবং কেন্দ্রস্থল, তিনি আল্লাহ তায়ালা এবং তারপর সেই ঐশী মহব্বতের ছত্রছায়ায় এবং আনুগত্যের ভিত দিয়ে ঐ সত্তার সাথেও মহব্বত কায়েম করা যার হেদায়েত এবং শিক্ষার ফলে এই ঈমানরূপ জাওহার আমরা লাভ করেছি। এই মহব্বতের সামনে অপরাপর দুনিয়াবী মহব্বত এবং আত্মীয়তা ও প্রতিবেশীসুলভ আচরণ খুবই নগণ্য। রাসুলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, “তোমাদের মাঝে কেউ ঐ সময় পর্যন্ত কামেল ঈমানদার হতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তার অন্তরে আমার মহব্বত তার সন্তানাদি, পিতামাতা এবং সমস্ত মানুষ হতে বেশী না হবে।” (সহীহ বুখারী ও মুসলিমঃ কিতাবুল ঈমান)
ঈমানের তৃতীয় নিদর্শন ও নমুনা হচ্ছে, মু’মিন ব্যক্তির স্বীয় জাতি, ভ্রাতৃত্ব এবং প্রতিবেশীর প্রতিও অনুরূপ মহব্বত, পিয়ার এবং আন্তরিকতা থাকতে হবে, যেমনটি নিজের প্রতি আছে। রাসুলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, “শপথ ঐ সত্তার যাঁর হাতে আমার প্রাণ নিহিত। তোমাদের মাঝে কাহারো ঈমান ঐ সময় পর্যন্ত কামেল হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা আপোষে একে অন্যকে মহব্বত না করবে। আমি কি তোমাদেরকে বলে দেব যে, পরস্পরের মাঝে মহব্বত কিভাবে হয়? তোমরা পরস্পর সালাম প্রদান কর”। (সহীহ মুসলিমঃ কিতাবুল ঈমান) এই মহব্বত যেন লোক দেখানো অথবা ব্যক্তিগত উপকার ও অপকারের জন্য না হয়; বরং শুধু আল্লাহর জন্যই হবে। তিনি বলেছেন, “তিনটি জিনিস যার মাঝে পাওয়া যাবে সে অবশ্যই ঈমানের আস্বাদ লাভে ধন্য হবে। (১) তার অন্তরে আল্লাহ ও রাসূলের চেয়ে বেশি মহব্বত অন্য কাহারো জন্য হবে না। (২) সে আল্লাহর বান্দাদের সাথে শুধু কেবল আল্লাহর উদ্দেশ্যেই মহব্বত করবে। (৩) কুফর হতে নাজাত লাভ করার পর পুনরায় কুফরের সাথে সংশ্লিষ্ট হওয়াকে সে এমনই দুঃখজনক মনে করবে, যেমনি সে আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়াকে বেদনাকর মনে করে।” একজন জিজ্ঞেস করলো, “ইয়া রাসূলুল্লাহ! কোন মুসলমানের মাঝে কামেল ইসলাম আছে?” ইরশাদ হলো, “ঐ মুসলমানের মাঝে যার হাত এবং জবান হতে অপর মুসলমান নিরাপদ থাকে।” তিনি আরও বললেন, “ঈমানের সত্তরেরও অধিক শাখা রয়েছে। যার মাঝে একটি হচ্ছে লজ্জা ও শরম।”
তিনি এ শিক্ষাও দিয়েছেন যে, “যার আল্লাহ ও আখেরাতের উপর ঈমান আছে, তার উচিত জবানে উত্তম কথা বলা অন্যথায় নিশ্চুপ থাকা। যার আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাস আছে, তার উচিত স্বীয় প্রতিবেশীকে দুঃখ না দেয়া। যার আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাস আছে, তার উচিত মেহমানকে ইজ্জত করা।” জনৈক সাহাবী রাসুলুল্লাহ (সা:)-এর বাণী উদ্ধৃত করে বলেছেন, “তোমাদের মাঝে কেউ যদি খারাপ ক্রিয়া দেখতে পায় তার উচিত হাতে প্রতিরোধ করা, যদি সম্ভব না হয় তাহলে জবানে প্রতিরোধ করা, যদি এটাও সম্ভব না হয়, তাহলে অন্তরে একে ঘৃণা করা এবং এটা হচ্ছে দুর্বল ঈমানের নি¤œতম পর্যায়।” (এ সকল বর্ণনা সহীহ বুখারী ও মুসলিমের কিতাবুল ঈমান খন্ডে বর্ণিত আছে)
পক্ষান্তরে রাসূলুল্লাহ (সা:) সতর্ক করে বলেছেন, মুনাফেকীর নিদর্শন হচ্ছে চারটি। যার মাঝে এর একটি সামান্যতম উপাদানও পাওয়া যাবে, তার মধ্যে অবশ্যই মুনাফেকী আছে। যথা (১) কথা বললে সে মিথ্যা বলে। (২) অঙ্গীকার করলে তা ভঙ্গ করে। (৩) কোন বস্তু আমানত রাখলে তা খেয়ানত করে। (৪) এবং কখনো রাগ করলে, গালি-গালাজ করে।” (সহীহ বুখারী ও মুসলিমঃ কিতাবুল ঈমান)
এই বিস্তৃত আলোচনার নিরিখে স্পষ্টতই বুঝা যায় যে, সকল পূণ্যকর্ম, সকল প্রকার মঙ্গল কাজ এবং উত্তম কর্মানুষ্ঠান একই মূলের শাখা-প্রশাখা মাত্র। মূলটি হচ্ছে ‘ঈমান’। এ কারণেই ঈমান সকল ধর্মের মূল উৎস। ঈমান না থাকলে মানবিক পূণ্য কর্মাদির যাবতীয় ইমারত ভিত্তিহীন।
এ বিশ্লেষণের দ্বারা কেউ যেন সন্দেহ না করে যে, ঈমান আনয়নের পর আমলের প্রয়োজনীয়তা নেই। কিন্তু ইসলাম বারবার এই বিষয়টি তুলে ধরেছে যে, “মুক্তির নির্ভরশীলতা ঈমান এবং নেক আমল উভয়টির উপর।” এ জন্য ঈমান আনা নির্দেশের সাথে নেক আমল করেছে-এর উপরও সব সময় জোর দেয়া হয়েছে।
বরং উপরে যা কিছু বলা হয়েছে, এর লক্ষ্য হচ্ছে এই যে, এ দুয়ের মাঝে ঈমান হচ্ছে মূল এবং নেক আমল হচ্ছে এর শাখা। ঈমান হচ্ছে অপরিহার্য এবং নেক আমল হচ্ছে এর বৈশিষ্ট্য ও সম্পূরক উপাদান। অর্থাৎ এ দুয়ের মাঝে সম্পর্ক হলো মূল এবং শাখার এবং অপরিহার্যতা ও এর সম্পূরক উপাদানের। যা একটি অপরটি হতে পৃথক হতে পারে না। যা কুরবানীর মূল চেতনা।
ঈমান ছাড়া নেক আমল যেমন তরতাজা ও সজীব হতে পারে না, অনুরূপভাবে আমল ছাড়া কুরবানি ছাড়া ঈমানও ফুল এবং লতা-পাতাহীন বৃক্ষতুল্য। যা উপকারের দিক থেকে অস্তিত্বহীনের মত। এ কারণে যেখানে ঈমান আছে, সেখানে এর আমলী পরিণাম ও নিদর্শনাবলীর অস্তিত্বও অবশ্যম্ভাবী।
লেখক : ধর্ম গবেষক ও সাংবাদিক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন