মুসলিম বিশ্ব অস্থির অবস্থায় কাটছে। এক কথায় তাদের সময়টা খারাপ যাচ্ছে। প্রধানত: দুটো কারণকে নির্দিষ্ট করা যেতে পারে। প্রথমত, মুসলমানদের ভেতর দলাদলি ও অনৈক্য এবং মুসলিম নামধারী ধর্মত্যাগীদের অন্তর্ঘাত। দ্বিতীয়ত, মুসলিম ও ইসলামবিরোধীদের ক‚টকৌশল।
কুরআন মুসলিম ঐক্যের ব্যাপারে পরিষ্কার নির্দেশ দিয়েছে। কুরআন বলে, ‘আর তোমরা সকলে আল্লাহর রশিকে শক্ত করে ধর’ বিভক্ত হয়ো না।... আর তোমরা তাদের মতো হয়ো না যারা তাদের কাছে স্পষ্ট নিদর্শন আসার পর বিভক্ত হয়েছে ও নিজেদের মধ্যে মতান্তর সৃষ্টি করেছে। তাদের জন্য রয়েছে মহা শাস্তি। (সূরা আলে-ইমরান ১০৩, ১০৫ আয়াত)। আর মুসলিমবিরোধীদের ক‚টকৌশল সম্পর্কে আল্লাহ সাবধান করেন এভাবে : ‘হে বিশ্বাসীগণ তোমাদের আপনজন ছাড়া অন্য কাউকেও অন্তরঙ্গ বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করো না। তারা তোমাদের বিভ্রান্ত-অনিষ্ট করতে ছাড়বে না। তোমাদের সর্বনাশ হোক, তাই তারা চায়। তাদের মুখে বিদ্বেষ প্রকাশ পায়। আর যা তাদের অন্তর গোপন রাখে তা আরও মারাত্মক। তোমাদের জন্য নিদর্শনসমূহ পরিষ্কার করে বয়ান করছি, যদি তোমরা বুঝে দেখ। তোমরা বন্ধু ভেবে তাদের ভালোবাস, কিন্তু তারা তোমাদের ভালোবাসে না। আর তোমরা সব কিতাবে (ইহুদি-খ্রিষ্টানদের) বিশ্বাস করো।’ (সূরা আলে-ইমরান: ১১৮-১১৯ আয়াত)। আল্লাহ আরও বলেন, ‘ইহুদি ও খ্রিষ্টানরা তোমার প্রতি কখনও সন্তুষ্ট হবে না, যতক্ষণ না তুমি তাদের আদর্শ অনুসরণ করো।’ (সূরা বাকারা ১২০)।
মোটামুটি ১৭০০ সালের পর থেকেই মুসলমানদের দুর্দিন আসে। পলাশীর তথাকথিত যুদ্ধে দেখা গেল বিদেশী সেনাবাহিনীর বেশির ভাগ সিপাহি দালাল ছিল এই দেশীয়। ইংরেজ অফিসারও সিপাহি খুবই নগণ্য। পরবর্তীতে সুলতান টিপু সুলতানকেও নবাব সিরাজউদ্দৌলার মতো হত্যা করা হলো এ দেশীয় দালালদের সহযোগিতায়। ক‚টকৌশল ও দালালদের সহায়তায় পাশ্চাত্য সমগ্র উপমহাদেশ ছাড়াও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা দখল করে নিলো। এই সুযোগে রাশিয়া ও চীনও বিশাল মুসলিম এলাকা হাতিয়ে নিলো। পাশ্চাত্যের দূরবর্তী মুসলিম এলাকাসমূহ অনেক কষ্টে স্বাধীনতা ফিরে পেলেও নিজ ভূখন্ডের সন্নিহিত হওয়ার দোহাই দিয়ে বিশল তুর্কি অধ্যুষিত এলাকাকে ছাড়তে নারাজ রাশিয়া-চীন।
অতীতে পাশ্চাত্য ক‚টকৌশলের মাধ্যমে মুসলিম অনৈক্য সৃষ্টি করে স্পেন-পর্তুগাল থেকে মুসলিম-ইহুদি নিশ্চিহ্ন করেছিল। আবার বিশাল ওসমানী মুসলিম সাম্রাজ্যে পাশ্চাত্য ও রাশিয়া বিদ্রোহ উসকিয়ে, সন্ত্রাসে ঘি ঢেলে বিভিন্ন প্রদেশকে বিচ্ছিন্ন করল। ইউরোপ থেকে বিতাড়িত ইহুদিদের ওসমানী সুলতান আশ্রয় দিলেও ইহুদিরা ওসমানী তুর্কি ও আরব উভয়েরই পিঠে ছুরিকাঘাত করে ওসমানী তথা মধ্যপ্রাচ্যকে পাশ্চাত্যের পায়ে নজরানা হিসেবে দিলো। ইহুদিরা বিভ্রান্ত মেজবানদের নিকৃষ্ট প্রতিদান দিলো।
বর্তমান অবস্থা : হতাশাগ্রস্ত ঐক্যহীন মুসলমানদের ক‚টকৌশলের মাধ্যমে হাত করে পাশ্চাত্য তাদের গাদ্দাফি ও সাদ্দামের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসে সাহায্য করল। পরে সরাসরি মাঠে নেমে তাদের উৎখাত ও হত্যা করা হলো। এখন লাগছে ইরান ও তুরস্কের বিরুদ্ধে। ইরান ও তুরস্কে বিরুদ্ধবাদীদের মাধ্যমে সন্ত্রাস, অভ্যুত্থান-প্রচেষ্টা ও ধ্বংসাত্মক তৎপরতা চালিয়ে এখন প্রকাশ্য হুমকি ধামকি দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। মুসলমানদের সন্ত্রাসী বলা হলেও যুক্তরাষ্ট্র তথা পাশ্চাত্যের বহু কার্যক্রম নিশ্চিতভাবে সন্ত্রাস ও ধ্বংসাত্মক ।
ইহুদি মাতার পুত্র মিসর দখল করেছেন। তারা ফিলিস্তিনকেও ধ্বংস করছেন। কাবার সেবকরা এখন ইহুদিদের সম্মিলিত জোটে। ইসলাম ত্যাগীরা বলছে যে, যুবরাজ ইসলামের পেছনে পেরেক ঠুকছেন। সেকুলার মাহমুদ আব্বাসের উচিত শিক্ষা হয়েছে কারণ তিনিও প্রথম দিকে তেলআবিবের ভক্ত ছিলেন এবং ইহুদি সাহায্য নিয়ে হামাস ও হিজবুল্লাহকে ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন। এখন আব্বাসের চেতনা ফিরেছে, দেরিতে হলেও। তবে সমগ্র ফিলিস্তিনই এখন যুক্তরাষ্ট্রের ক‚টকৌশলে ইহুদিদের মুঠোর ভেতর কোনো না কোনোভাবে। অথচ এক সময় সৌদি বাদশাহ মরহুম ফয়সলের প্রেরণায় হয়েছিল ওআইসি, যার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ফিলিস্তিন উদ্ধার। সেই ফয়সলকে যুক্তরাষ্ট্র প্রেরিত সন্ত্রাসী হত্যা করল। যুক্তরাষ্ট্র শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্বিত ঢেলে চলেছে এবং বর্তমান সৌদি-মিসর নেতৃত্বের মাধ্যমে অনেকটাই সফল।
শুধু পাশ্চাত্য নয়, রাশিয়া-চীনও যে নীতি নিয়েছে তা মুসলিমবিরোধী। রাশিয়া-চীন ইরান-তুরস্কের সঙ্গে কিছুটা বন্ধুত্ব করলেও তাদের অভ্যন্তরীণ মুসলিম নীতি কখনও কখনও খুবই বৈষম্যমূলক। রাশিয়া-চীন মিয়ানমারের জঘন্য মৌলবাদী নীতিকে মান্যতা দিচ্ছে। এদিকে ইন্ডিয়াতেও মিয়ানমারের মতো অবস্থা সৃষ্টির পথে। চল্লিশ লাখ থেকে দুই কোটি মুসলমান দেশহীন হয়ে পড়তে পারে। সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকে মুসলিম নিধন চলছে।
সর্বত্রই মুসলিম নির্যাতন চলছে। নিন্দুকেরা বলে যে, এর জন্য মুসলমানরা দায়ী। আসলে তা নয়। মুসলমানদের রাষ্ট্রগুলো ক্ষুদ্র ও দুর্বল। তাদের কোনো প্রভাব নেই বিশ্ব রাজনীতিতে। তাদের নেই যুক্তরাষ্ট্র ও পাশ্চাত্যের মতো শক্তিশালী খ্রিষ্টান রাষ্ট্রসমূহ, বৌদ্ধ-মঙ্গোলীয় জাতির জাপান, চীনের মতো শক্তিশালী রাষ্ট্র বা ইন্ডিয়ার মতো শক্তিশালী হিন্দু রাষ্ট্র। ০+০+০=০। এই হলো সমগ্র মুসলিম বিশ্বের অবস্থা। সামান্য এক পাদরিকে ছেড়ে দিতে যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ককে হুমকি দিচ্ছে। ভাবসাব দেখে মনে হয় পরিস্থিতি তেমন হলে আবার একটা মার্কিনি অভ্যুত্থান হবে সেখানে। শেষ যুগে মুসলমানদের এ দুর্বল অবস্থার কথা নবী (সা:) পূর্বেই বলে গেছেন। শক্তিশালী অমুসলিম রাষ্ট্রগুলোর আর একটা মতলব হলো প্রতিটি মুসলিম রাষ্ট্র, এমনকি বামপন্থী প্রতিটি মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার দেশে স্বাধীনচেতা সরকারের পরিবর্তে দালাল-সরকার বসাতে চায়। এর জন্য তারা প্রথমে সন্ত্রাস ও পরবর্তীতে সরাসরি যুদ্ধ লাগিয়ে দেয়।
ইসলামী আদর্শের বিরোধিতা : এদিকে চলছে ইসলাম সমালোচনা, নবী (সা:)-এর চরিত্র হনন, অশ্লীল কার্টুন প্রপাগান্ডা, পুস্তক প্রকাশনা, হিজাব-নিকাব-মিনার-আজান বিরোধিতা, প্রকাশ্য নামাজ বিরোধিতা (মসজিদ করতে না দেয়ার ফলে) মাদ্রাসার সমালোচনা, কুরআনের সমালোচনা ইত্যাদি কর্মকান্ড। মোস্তফা জামান আব্বাসী বলেছেন যে, ওয়াশিংটনের লাইব্রেরি অব কংগ্রেসে নবী (সা:)-এর ওপর বহু বই রয়েছে, তবে বেশির ভাগই তাঁর বিরুদ্ধে। আমিও সামান্য সময় সে লাইব্রেরিতে ছিলাম।
ট্রাম্পের আবির্ভাব মৌলবাদীতে আর এক সংযোজন। ইন্টারনেট ঘাটলে দেখবেন মৌলবাদী খ্রিষ্টানরা কি সব লিখছে তাঁকে কেন্দ্র করে। তিনি নাকি ইসরাইলকে সমর্থন করে জেরুজালেমকে ইসরাইলি রাজধানী ঘোষণা করে, বাইবেল বর্ণিত বিশ্বের সর্ববৃহৎ শেষ যুদ্ধ আরমাগেডেনের যুদ্ধ ও হযরত ঈসা (আ:)-এর আগমনকে ত্বরান্বিত করেছেন। এ যুদ্ধে এন্টিক্রাইস্ট বাহিনীসমূহ পরাজিত হবে। আসলে শেষ বৃহৎ যুদ্ধ সম্পর্কে বাইবেলে সামান্য কিছু তথ্য রয়েছে। শেষ যুদ্ধ সম্পর্কে নবী (সা:)-ই বিস্তারিত বলে গেছেন। তখন হযরত ঈসা (আ:) দামাস্কাসের মসজিদের ছাদে এসে অবতরণ করবেন। এ সময় সত্তর হাজার ইহুদি সেনাবাহিনী দামাস্কাসে উপস্থিত হবে। হযরত ঈসা (আ:) ইহুদি বাহিনীকে পরাভূত করে তেলআবিবের নিকট লিডডা বন্দরে ইহুদি নেতাকে হত্যা করবেন। পাঠক দামেস্ক তথা সিরিয়ার বর্তমান পরিস্থিতির দিকে লক্ষ করুন। আর বাইবেলের ব্যাখ্যা অনুযায়ী ক্রাইসটকে যারা মানে না তারাই এন্টিক্রাইস্ট। মুসলমানরা ক্রাইসট, তার মাতা মেরি, জন দি ব্যাপটিস্ট (হযরত এহিয়া আ:)-কে মানে ও খুবই ভালোবাসে। ইহুদিরা এখনও ক্রাইস্টকে মানে না। মুসলমান কখনও এন্টিক্রাইস্ট নয়। যাই হোক প্রতীয়মান হচ্ছে, খ্রিষ্ট মৌলবাদ, বৌদ্ধ মৌলবাদ (মিয়ানমারে) ও হিন্দু মৌলবাদও কম নয়। হ্যাঁ, মুসলিম মৌলবাদও রয়েছে। তবে অন্যেরা কম যায় না।
সামান্য আশা : চারদিকে এত হতাশা। তবুও এর ভেতর সামান্য আশা জেগেছে ফিলিপাইনে মরো সমস্যার আংশিক সমাধানে মিন্দানাও দ্বীপে স্বায়ত্তশাসন প্রদানে। তুরস্ক-ইরানের প্রতি কিছুটা সমর্থন রাশিয়া-চীনের। আর রোহিঙ্গা প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কিছু সমর্থন।
আবার বেদনা : ইন্টারনেটের উন্মুক্ত আকাশ পেয়ে যা তা বলছে একশ্রেণীর তথাকথিত বিদ্বানরা। তারা আবার ধর্মত্যাগী। ব্যথা পেলাম যখন দেখলাম একজন বলছে ‘ইব্রাহীমের মতো একজন উন্মাদ তিন ধর্মের নবী। সে মানসিক বিকৃতিসম্পন্ন যে সন্তানকে হত্যা করতে গিয়েছিল।’
আসলে এটা ছিল পরীক্ষা। কুরআন স্পষ্টই বলে, ‘এটি ছিল একটি প্রকাশ্য পরীক্ষা।’ (সূরা আস-সাফফাত : ১০৬ আয়াত) হযরত ইব্রাহীম (আ:) ছিলেন তিন ধর্মের নবী। তিনি আমাদের মতো নন। তিনি আল্লাহকে ভালোভাবে জানতেন। কাজেই উন্মাদ হয়ে তিনি এ কাজ করেননি। নবীদের সঙ্গে যে যোগাযোগ স্থাপিত হয় আল্লাহর, তা আমাদের হয় না। নবীদের স্বপ্নও এক প্রকারের ওহী-ঐশীবাণী। হযরত ইব্রাহীম (আ:) ভুল করলে, এই কোরবানি-প্রচেষ্টার সমালোচনা করতেন আল্লাহ কুরআনে। ধর্মত্যাগীরা তো আল্লাহকেই মানে না। তাই তারা এসব বুঝবে না। তারাই মানসিক সমস্যার রোগী। হযরত ইব্রাহীম (আ:)ও হযরত ইসমাইল (আ:) যে আল্লাহর ‘ডিসিপ্লিন্ড্’ সৈনিক, তাই প্রমানিত এই ঘটনায়। এ ধরনের স্বপ্ন সাধারণ মানুষ দেখলে তাদের সন্তান কোরবানি করতে হবে না, কারণ তারা নবীও নয়, ওহীও তাদের কাছে আসে না।
লেখক : ইতিহাসবিদ ও প্রবন্ধকার
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন