ঈদ অর্থ আনন্দ। মুসলমানদের জন্য আল্লাহপাক আনন্দ উদযাপনের জন্য দু’টি দিন নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এ দু’টি দিন হলো, ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার দিন। ইসলামপূর্ব যুগে আরবে উৎসবের জন্য দু’টি দিন নির্ধারিত ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ওই দু’টি দিনের চেয়ে উত্তম দু’টি দিন আল্লাহপাক নির্ধারণ করে দিয়েছেন। সব ধর্মীয় জাতি-সম্প্রদায়ের মধ্যেই আনন্দ উদযাপনের প্রচলন রয়েছে। মুসলমানদের আনন্দ উদযাপনের জন্য নির্ধারিত দিক দু’টি লক্ষ্য ও তাৎপর্যগত দিক থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এ দু’দিনে আল্লাহ তায়ালার নির্দেশিত ইবাদত-বন্দেগির একটি দিন যেমন আছে, তেমনি মানবিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিকও রয়েছে। বলা যায়, আধ্যাত্মিক দিক যেমন আছে, তেমনি জাগতিক দিকও রয়েছে। এক মাস সিয়াম সাধনার পর আসে ঈদুল ফিতর। সিয়াম সাধনার মর্মবাণী হলো তাকওয়া অর্জন করা। সিয়াম পালন তাকওয়া অর্জনের লক্ষ্যে প্রশিক্ষণ। আর ঈদুল আজহা ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর। আল্লাহপাকের উদ্দেশ্যে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের শিক্ষা ও প্রেরণা যোগায় ঈদুল আজহা।
দুই ঈদের এই আধ্যাত্মিক দিকের পাশাপাশি রয়েছে অসাধারণ সামাজিক ও মানবিক কল্যাণের দিক বিশেষ করে সামাজিক ও মানবিক সমতা, মঙ্গল ও উন্নয়নের এই ঈদকে আলাদাভাবে মহিমান্বিত করেছে। দুই ঈদ উপলক্ষে যে অর্থনৈতিক কার্যক্রম পরিচালিত হয় তার মধ্যেই নিহিত রয়েছে সেই সামাজিক ও মানবিক কল্যাণ। ঈদকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক কার্যক্রম আমাদের রাষ্ট্রীয় অর্থনীতিকে বিশেষভাবে পুষ্ট ও সমৃদ্ধ করে। এ সময় অর্থনীতিতে ব্যাপক মুদ্রা সরবরাহ পণ্য-সামগ্রী উৎপাদন ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটে। এর উপকারভোগী হয় কোনো না কোনোভাবে দেশের সকল মানুষ। অর্থনীতিবিদদের মতে, ঈদুল ফিতরে দেশের অর্থনীতির আকার এক লাখ কোটি টাকা এবং ঈদুল আজহায় কমপক্ষে ৬০-৭০ হাজার কোটি টাকায় উপণীত হয়। রমজানে ইফতার সামগ্রী ও খাদ্যদ্রব্য থেকে শুরু করে ঈদ উপলক্ষে পোশাক-আশাক, জুতাসহ গৃহস্থালী পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে ব্যাপকভিত্তিক অর্থনৈতিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এ সময় জাকাত-ফিতরা ও দান-খয়রাতের সূত্রে দরিদ্র ও পিছিয়ে থাকা মানুষের মধ্যে অর্থের স্থানান্তিরত হয়। এ কারণে এক ধরনের স্বচ্ছলতা ও স্বাচ্ছন্দ্য আসে।
ঈদুল আজহায় প্রধানত কয়েকটি খাতে আর্থিক লেনদেনসহ বহুমুখী অর্থনৈতিক কর্মকাÐ পরিচালিত হয়। কোরবানি ঈদুল আজহার অপরিহার্য অনুসঙ্গ। গত বছর প্রায় ৭৮ লাখ গরু ও খাসি কোরবানি হয়। এবার হয়েছে তার চেয়েও বেশি। অর্থনীতিবিদদের মতে, এবার এ খাতে কম করে হলেও ১০ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। গরু-খাসির চামড়া আমাদের রফতানিযোগ্য, পাদুকা শিল্পে, পোশাক ও হস্তশিল্পে একটি বড় উপাদান। এই ঈদে শতকরা ৭০ ভাগ চামড়া সংগৃহীত হয়। চামড়া সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াকরণ, বিক্রয় ও ব্যবহারে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ ও প্রতিষ্ঠান জড়িত থাকে। এ খাতে অন্তত দেড় হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ ও ব্যবসা হয়। কোরবানির পশু উৎপাদন, লালন-পালন ইত্যাদির জন্য সারা বছরই কাজ চলে। এ খাতেও শত শত কোটি টাকার লেনদেন ও ব্যবসা হয়। এ ছাড়াও কোরবানির পশুর হাট, পশু আনা নেয়া, গোশত বানানো প্রভৃতি কাজেও অর্থের লেনদেন ও হাত বদল হয়। বাংলাদেশ থেকে লক্ষাধিক লোক হজে গমন করে। এ খাতে কয়েক হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়। ঈদ উপলক্ষে লাখো লাখো লোক শহর থেকে গ্রামে যায়। পরিবহন খরচসহ আনুষাঙ্গিক অন্যান্য পণ্য ক্রয় বাবদ মোটা অঙ্কের অর্থ ব্যয় হয়। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, পরিবহন খাতে এসময় অন্তত দু’হাজার কোটি টাকার অতিরিক্ত ব্যবসা হয়।
ঈদকেন্দ্রিক মুদ্রা লেনদেন, বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্য গোটা দেশের অর্থনীতির উজ্জীবন ঘটায়। দুই ঈদে যত কেনাবেচা ও লেনদেন হয়, সারা বছরেও তা হয় না। বলা হয়, ঈদে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয় দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষ। তাদের দারিদ্র্য মোচনে ঈদ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। কোরবানির পশুর গোশতের একটা অংশ দরিদ্রদের প্রাপ্য। সারা বছর যারা সামর্থের অভাবে গোশত কিনে খেতে পারে না, এ সময় তারাও অন্তত কয়েকদিন গোশত খেতে পারে। তা ছাড়া কোরবানির পশুর চামড়ার বিক্রয়লব্ধ অর্থের হকদার দরিদ্র, এতিম ও অসহায় মানুষ। কোরবানির পশুর চামড়ার অর্থে দেশের বহু মাদরাসা ও এতিমখানার সারা বছরের খরচ চলে।
সামগ্রিক বিবেচনায়, অন্যান্য ধর্মীয় জাতি-সম্প্রদায়ের আনন্দ-উৎসবের তুলনায় মুসলমানদের আনন্দ-উৎসব যে আধ্যাত্মিক, সামাজিক, মানবিক, অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ভিন্নতর তাৎপর্যে মহিমাময় ও কল্যাণবহ তাতে কোনো সন্দেহ আছে কি?
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন