কোরআন ও হাদিসে ‘গীবত’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, যার অর্থ কোনো লোকের অনুপস্থিতিতে তার দোষের কথা প্রকাশ করা, তার বদনাম ও তার নিন্দা, সমালোচনার মাধ্যমে তার সুনাম খর্ব করা, লোকসমাজে তাকে হেয় প্রতিপন্ন করা ইত্যাদি।
তবে মহানবী (সা.) গীবতের যে অর্থ করেছেন তা জানা থাকা উচিত। তিনি এক হাদিসে (গীবত/পরনিন্দা) ও ‘বোহতান’ (অপবাদ) এর মধ্যে পার্থক্য প্রসঙ্গে বলেছেন, হজরত আবু হোরায়রা (রা.) বর্ণিত এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা কি জান, গীবত কি? সাহাবাগণ বললেন, ‘আল্লাহ ও তার রাসূল ভালো জানেন।’
তিনি বললেন, ‘গীবত হচ্ছে এই যে, তুমি নিজের ভ্রাতার কথা এমনভাবে উল্লেখ করো যে, যা সে পছন্দ করে না।’ অতঃপর তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়, ‘বলুন, আমি যে কথাটি বলছি তা যদি আমার ভাইয়ের মধ্যে থেকে থাকে?’ তিনি বললেন, ‘এটাই তো গীবত, যা তুমি বলছো। তার মধ্যে তা থাকলেই গীবত। আর যদি যে কথা বলা হয়েছে তার মধ্যে তা না থাকে তা হলে তুমি তার ওপর অপবাদ (বোহতান) আরোপ করেছ।’ (মেশকাত)।
গীবত ও বোহতান সম্পর্কে হুজুর (সা.)-এর এ অর্থের পর আর কোনো ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয় না। কোরআনের সূরা ‘হুমাযাহ’ এর প্রথম আয়াতেই গীবতকারীর কঠোর শাস্তির কথা বলা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘দুর্ভোগ প্রত্যেকের যে পশ্চাতে ও সম্মুখে লোকের নিন্দা করে।’
গীবত বা পরনিন্দাকে সূরা ‘হুজুরাত’ এ অতি ঘৃণ্য অপরাধ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘হে মোমেনগণ! তোমরা অধিকাংশ অনুমান হতে দূরে থাকো, কারণ অনুমান কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাপ এবং তোমরা একে অপরের গোপনীয় বিষয় সন্ধান করো না এবং একে অপরের পশ্চাতে নিন্দা করো না। তোমাদের মধ্যে কি কেউ তার মৃত ভ্রাতার গোশত খেতে চাইবে। বস্তুত: তোমরা তো এটাকে ঘৃণ্যই মনে করো। তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। আল্লাহ তাওবা গ্রহণকারী পরম দয়ালু।’ (আয়াত-১২)
এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, হুজুর (সা.) বলেছেন; ‘শবে মেরাজে এমন এক জাতির কাছে আমি গমন করি যাদের নখ ছিল তামার এবং তারা তা দ্বারা নিজেদের চেহারা ও বুক খামচাচ্ছিল। আমি জিবরাইলকে (আ.) জিজ্ঞাসা করি, এরা কারা? তিনি বললেন, ‘এরা সে সব লোক যারা লোকেদের গোশত খেত এবং তাদের ইজ্জত আব্রæ হরণ করত।’ (আবু দাউদ) এরা লোকদের গীবত করত বলে এ শাস্তি।’
একবার ভীষণ দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। রাসূলুল্লাহ (সা.) সাহাবাদেরকে বললেন, ‘তোমরা জানো এটা কি?’ তিনি নিজেই বললেন, ‘এটি ওইসব লোকের দুর্গন্ধ যারা মুসলমানদের গীবত করত।’ (আদাবুল মোফরাদ)
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, ‘দুই ব্যক্তি জোহর অথবা আছরের নামাজ আদায় করে এবং তারা দুই জনই রোজা রেখেছিল। রাসূলুল্লাহ (সা.) নামাজ শেষ করার পর তাদেরকে বললেন, ‘তোমরা পুনরায় অজু করো এবং আবার নামাজ পড়ো এবং রোজা পূরণ করো। তবে তা অপর কোনো সময় কাজা হিসেবে আদায় করবে।’ তারা উভয়ই বলল, ‘হুজুর! এর কারণ কি?’ তিনি বললেন, ‘তোমরা অমুক ব্যক্তির গীবত করেছিলে।’ (মেশকাত)
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘গীবত, জেনা (ব্যভিচার) অপেক্ষা গুরুতর পাপ।’ সাহাবাগণ আরজ করলেন, ‘হুজুর! গীবত জেনা অপেক্ষা গুরুতর কিভাবে’ হুজুর বললেন, ‘মানুষ জেনা করার পর তওবা করলে আল্লাহ তা কবুল করেন।’
অপর এক বর্ণনায় আছে, মানুষ তওবা করলে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেন। কিন্তু গীবতকারীকে ক্ষমা করেন না, যতক্ষণ না যার গীবত করা হয়েছে সে ক্ষমা করে দেবে। হজরত আনাস (রা.) এর বর্ণনায় আছে, হুজুর (সা.) বলেছেন, ‘জেনাকারীর জন্য তওবার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু গীবতকারীর জন্য তওবার সুযোগও নেই।’ (মেশকাত)
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘গীবতের একটি কাফ্ফারা এই যে, তুমি যার গীবত করেছ তার মাগফিরাতের জন্য দোয়া করবে এবং এভাবে বলবে, হে আল্লাহ! তুমি আমার ও তার মাগফিরাত করো।’ (মেশকাত)
হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মৃত ব্যক্তিদেরকে মন্দ বলো না, কেননা তারা নিজেদের আমলগুলো পর্যন্ত পৌঁছে গেছে।’(বোখারি)
অনেক মুসলমান মুসলমানের গীবতচর্চায় লিপ্ত থাকে। কোরআন ও হাদিসের শিক্ষার কথা স্মরণে রাখলে এবং সেই মোতাবেক আমল করলে গীবতচর্চা হতে আত্মরক্ষা করা যেতে পারে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন