ভিত্তিহীন, কাল্পনিক ও অনির্ভরযোগ্য কোনো খবর জ্ঞাতসারে, অজ্ঞাতসারে যাচাই না করে প্রচার করা অথবা অসৎ উদ্দেশ্যে বানিয়ে বানিয়ে মৌখিক বা লিখিতভাবে বাজারে, জনসমাবেশে ছেড়ে দেয়ার নাম গুজব। যার ফলে জনমনে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হতে পারে। এমনকি মারাত্মক ও ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতি এবং খুনাখুনি ও রক্তাক্ত ঘটনারও সূত্রপাত হতে পারে। গুজব মিথ্যাচারেরও অংশ। তাই মিথ্যাচারের ন্যায় ইসলামে গুজবও নিষিদ্ধ। গুজব রটনা ও অপপ্রচারণার কারণে দেশে দেশে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ পর্যন্ত সংঘটিত হয়েছে। যার ভুরিভুরি নজির ইতিহাসে বিদ্যমান।
ইসলামের ইতিহাসে এ সম্পর্কে বহু নির্মম কাহিনী নজরে পড়ে। উদাহরণস্বরূপ এখানে মহানবী (সা.)-এর মদিনা জীবনের দু’টি ঘটনার উল্লেখ করতে চাই। প্রথমটি- ওহুদ যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর শহীদ হওয়ার গুজব। যুদ্ধের এক কঠিন পর্যায়ে ‘ইবনে কামিয়া’ কাফেরদের মধ্যে মিথ্যা প্রচার করেছিল যে, সে রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে হত্যা (শহীদ) করেছে। এ কথা শোনে মুসলমানগণ দারুণভাবে বিচলিত ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। আনাস ইবনে নযর (রা.) অর্থাৎ হযরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) এর চাচা দেখতে পান যে, উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) এবং তালহা ইবনে উবায়দুল্লাহ (রা.) কয়েকজন মোহাজের ও আনসারের সাথে এক স্থানে বসে আছেন।
হযরত আনাস ইবনে নযর (রা.) জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমরা কেন বসে রয়েছ?’ তারা বললেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সা.) শহীদ হয়ে গেছেন।’ আনাস ইবনে নযর (রা.) বললেন, ‘অতঃপর তোমরা জীবিত থেকে কী করবে? ওঠো, যে কাজে রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রাণ দিয়েছেন; তোমরাও প্রাণ দাও।’ অতঃপর তিনি যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন ও শহীদ হন। তার দেহে ৭০ কিংবা ৮০টি আঘাত ছিল।
ওহুদ যুদ্ধে ইবনে কামিয়ার মিথ্যা প্রচার ছিল গুজব রটনারশামিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই যখন রাসূলুল্লাহ (সা.) কে জীবিত উদ্ধার করা হয় তখন শয়তানী প্রচারণা ফাঁস হয়ে যায়। মুসলমানগণ যদি গুজবে বিশ্বাস করে যুদ্ধ থেকে বিরত থাকতেন এবং আনাস ইবনে নযর (রা.) তাদেরকে যুদ্ধে ঠেলে না দিতেন তাহলে মুসলমানগণ ও ইসলামের কী করুণ পরিণতি হতে পারত তা অভাবনীয়।
দ্বিতীয় ঘটনাটি হচ্ছে- তাবুক যুদ্ধ, যাতে গুজবে বিভ্রান্ত হয়েছিলেন রোমান সম্রাট। নবম হিজরি রজব মাসের ঘটনা। ইবনে সাদের বর্ণনা অনুযায়ী, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট খবর আসে যে, শাম-এ (সিরিয়ায়) রোমকরা বিরাট সৈন্য সমাবেশ করেছে এবং হিরাক্লিয়াস এক বছরের সমস্ত খরচের অর্থ তার লোকেদের বিতরণ করে দিয়েছেন। তাদের সাথে আরো কয়েকটি গোত্র এসে যোগ দিয়েছে এবং তাদের অগ্রগামী দলগুলো ‘বালকা’ নামক স্থান পর্যন্ত এসে গেছে।
‘মাদারেজুন নবুওয়াত’ গ্রন্থের বর্ণনা অনুযায়ী,ওই এলাকার খ্রিষ্টানরা হিরাক্লিয়াসকে মিথ্যা খবর দিয়েছিল যে, মদিনায় যে ব্যক্তি নবুওয়াতের দাবি করতেন, তার ইন্তেকাল হয়ে গেছে। সেখানে বর্তমানে ভীষণ দুর্ভিক্ষ ও অভাব বিরাজ করছে এবং তাদের সহায়-সম্বল সবই বিনষ্ট হয়ে গেছে। এ জন্য এই দেশটি এখন সহজেই অধিকার করা যাবে। আগ্রাসী হিরাক্লিয়াস এ মিথ্যা খবরের সত্যতা যাচাই না করে এক রুম সেনাপতির নের্তৃত্বে ৪০ হাজার সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী মদিনা দখলের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেন। হুজুর (সা.) খবর পেয়ে মোকাবেলার জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করেন।
সংক্ষেপে বলতে হয় হুজুর (সা.) মোহাম্মদ ইবনে মাসলামা আনসারী (রা.) কে মদিনার খলিফা নিযুক্ত করেন এবং হযরত আলী (রা.) কে আহলে বায়তের দেখভালের জন্য রেখে,৩০ হাজার সৈন্য ও ১০ হাজার ঘোড়সওয়ারসহ যাত্রা করেন। মোনাফেকরা বিরত থাকে। হুজুর (সা.) তাবুক পৌঁছে ২০ দিন অবস্থান করেন। রোমক বাহিনী তখন ‘হিমস’ এ অবস্থান করছিল। তারা মুসলমানদের আগমনে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে সন্ধি করে এবং জিজিয়া বা কর প্রদান করে রক্ষা পায়। এটি ছিল মুসলমানদের বিনা যুদ্ধে এক বিরাট বিজয় এবং গুজবে কান দিয়ে রোমকদের শোচনীয় পরাজয়। (এ ঘটনার পূর্ণ বিবরণের পরিবর্তে আমরা কেবল গুজবের দিকটাই নিয়ে এসেছি)
কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে গুজব রটনা-প্রচারণার পথ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নেই তার অনুসরণ করো না, কর্ণ, চোখ, হৃদয় ওদের প্রত্যেকটি সম্পর্কের কৈফিয়ত তলব করা হবে’ (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত: ৩৬)।
‘হে মোমিনগণ! যদি কোনো পাপাচারী তোমাদের নিকট কোনো বার্তা আনয়ন করে, তোমরা তা পরীক্ষা করে দেখবে, পাছে অজ্ঞতাবশত তোমরা কোনো সম্প্রদায়কে ক্ষতিগ্রস্ত করে বসো এবং পরে তোমাদের কৃতকর্মের জন্য তোমাদেরকে অনুতপ্ত হতে হয়’ (সূরা হুজুরাত, আয়াত: ৬)।
শয়তান কিভাবে গুজব প্রচার করে, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর এক হাদিসে তার বর্ণনা রয়েছে। হযরত ইবনে মাসউদ (রা.) বর্ণনা করেন, হুজুর (সা.) বলেছেন, ‘শয়তান মানুষের রূপ ধারণ করে কাজ করে। সে লোকদের নিকট এসে মিথ্যা কথা বলে। অতঃপর লোকেরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে (অর্থাৎ আসর খতম হয়ে যায়)। তখন তাদের মধ্য হতে একজন বলে যে, ‘আমি এ কথা এক ব্যক্তিকে বলতে শুনেছি, তার চেহারা চিনি কিন্তু নাম জানি না’ (মিশকাত)।
কুরআনের বর্ণিত আয়াতদ্বয় ও উল্লিখিত হাদিস অনুযায়ী, মুসলমানদের তাগিদ দেয়া হয়েছে যে, কোনো কথা অনুসন্ধান যাচাই ও পরীক্ষা করা ছাড়া যেন বলা বা প্রচার করা না হয়। হতে পারে, যে ব্যক্তি কথাটি বলেছে; সে মিথ্যাবাদী ও শয়তান। যদি পরীক্ষা বা যাচাই ছাড়া জামাত-সমাবেশে কথা বলার প্রচলন শুরু হয়ে যায়, তাহলে তাতে ধ্বংসাত্মক বহু ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। তাই বার্তা প্রদানকারী সম্পর্কে যাচাই করতে হবে, সে ব্যক্তি কেমন। যদি প্রমাণিত হয়ে যে, সংবাদদাতা মিথ্যাবাদী; তাহলে তার কথা প্রত্যাখ্যান করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন