বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ধর্ম দর্শন

রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর তাবলীগ

এ.কে.এম ফজলুর রহমান মুনশী | প্রকাশের সময় : ২৯ নভেম্বর, ২০১৮, ১২:০৩ এএম

তাবলীগ শব্দটির অর্থ হচ্ছে পয়গাম পৌঁছানো। এর ব্যবহারিক অর্থ হচ্ছে এই যে, যে বস্তুকে আমরা উত্তম জানি, তার উত্তমতা এবং সৌন্দর্যকে অন্যান্য লোকের সামনে এবং অন্যান্য জাতি ও দেশে পৌঁছে দেয়া এবং তাদেরকে উহা গ্রহণ করার জন্য আহ্বান জানানো। কুরআনুল কারীমে তাবলীগের সমার্থবোধক আরও শব্দবলি আছে। তন্মধ্যে একটি হচ্ছে ‘ইনজার’ এর অর্থ হুঁশিয়ার এবং সতর্ক করা। দ্বিতীয় হচ্ছে ‘দাওয়াত’ অর্থাৎ ডাকা এবং আহ্বান করা। তৃতীয়টি হচ্ছে ‘তাজকীর’ অর্থাৎ স্মরণ করিয়ে দেয়া ও নসীহত করা।
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আবির্ভাবের প্রাক্কালে দুনিয়াতে দু’ধরনের ধর্ম ছিল। এই দু’টি ধর্মই ছিল তাবলীগী বা আহ্বানসূচক। এর একটি খ্রিষ্টান ধর্ম এবং অপরটি বৌদ্ধ ধর্ম। অন্যান্য ধর্মগুলো যেমন তেমনই ছিল, কিন্তু তাবলীগী ছিল না। যেমন ইহুদিবাদ, অগ্নি পূজাবাদ এবং পৌঁত্তলিকতা। যে দু’টি ধর্ম তাবলীগী ছিল, এগুলো সম্পর্কে এই ফায়সালা করা কঠিন যে, এই তাবলীগ কি তাদের মৌলিক ধর্মের হুকুম ছিল, না কি উহা এর অনুসারীদের আমল? কেননা তাদের ধর্মীয় কিতাবাদিতে এই সাধারণ আহ্বাবানের সুস্পষ্ট হেদায়েত এবং উহার প্রবর্তকদের জিন্দেগিতে এর ব্যবহারিক নমুনা ও সাধারণ আহ্বানের সুস্পষ্ট হেদায়েত এবং উহার প্রবর্তকদের জিন্দেগিতে এর ব্যবহারিক নমুনা ও উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যায় না। মোটকথা, সকল ধর্মমতের মাঝে শুধু ইসলামই এমন একটি মাজহাব, যেখানে তাবলীগের গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে এবং এ সম্পর্কে স্বীয় কিতাবে সুস্পষ্ট নির্দেশ প্রদান করেছে। এমনকি এই ধর্মের প্রবর্তক স্বীয় জিন্দেগিতে এর ব্যবহারিক উদাহরণসমূহ পেশ করেছেন।
যে সকল ধর্মে তাবলীগ ও প্রচারকে স্বীয় বিধানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, সেগুলোর মাঝে তাবলীগের ব্যবহার মূলত: দুটি কারণেই হতে পারে। প্রথমত: তাদের নিকট এই সত্যকে কবুল করার সম্মানের যোগ্যতা ও অধিকার তাদের পয়দায়েশের মাধ্যমেই হাসিল হতে পারে, চেষ্টা ও তদবিরের দ্বারা নয়। দ্বিতীয়ত: যে সত্য তাদের নিকট আছে, সেটি তাদের কাছে এতই পাক ও পবিত্র যে, তাদের নির্দিষ্ট পবিত্র, মর্যাদাপূর্ণ ও সম্মানিত বংশ ও গোত্র ছাড়া অন্যান্য বংশ ও গোত্র যেগুলো নাপাক ও অপবিত্র এবং অকুলীন, তাদের পর্যন্ত নিজেদের পবিত্র ধর্ম ও মাজহাবকে নিয়ে যাওয়া স্বয়ং এই ধর্মকে আঘাত করারই শামিল। এটাই হচ্ছে এমমাত্র কারণ যে, হজরত ঈসা মাসীহ (আ.) একবার যখন তার কাছে একজন কিনআনী। (মথি-১) অথবা ইউনানী (মার্কস) মহিলা বরকত চাইলো, তখন বললেন, “আমি ইস্রাঈলের গৃহের হারিয়ে যাওয়া মেষপাল ছাড়া আর কারও প্রতি প্রেরিত হইনি। (মথি ১৫-৪৫) তারপর বললেন: এটা মোটেই সঙ্গত নয় যে, বাচ্চাদের রুটি (বনী ইস্রাঈলের ধর্ম) কুকুরগুলোকে (অইস্রাঈলী গোত্র) নিক্ষেপ করে দেই (মথি-২৮); তারপর বলেছেন: ভিন্ন গোত্রগুলোর দিকে গমন করো না এবং সামেরীদের কোনো শহরে প্রবেশ করো না, বরং প্রথমে ইস্রঈলীদের হারানো মেষগুলোর দিকে গমন করো, এবং চলার পথে ঘোষণা করে দাও (মথি-১০-৬); তারপর বলেছেন: ঐ বস্তু যা পাক ও পবিত্র, উহা কুকুরগুলোকে দিয়ো না এবং নিজেদের মোতিসমূহ শূকরগুলোর সামনে নিক্ষেপ করো না। (মথি-৭-৬)
হিন্দু এবং পৌত্তলিকরাও নিজেদের ধর্মকে অন্যান্য সকল জাতিগোষ্ঠী থেকে লুকিয়ে রেখেছে। এর কারণও সম্ভবত: এই ছিল যে, তারা তাদের পবিত্র ধর্মকে সেচ্ছ এবং অসম্পৃশ্যদেরকে শিখিয়ে উহাকে নাপাক করতে চাইত না। তাছাড়া ইহুদিদেরও এই খেয়াল ছিল যে, খাতনাবিহীন সম্প্রদায় এই নিয়ামতের যোগ্য নয়।
রাসূলুল্লাহ (সা.) দুনিয়ার সকল জাতিগোষ্ঠীকে সম্মান ও সমপর্যায়ের একই সমতলে এনে দাঁড় করিয়েছিলেন এবং আল্লাহর পয়গাম পৌঁছানোর অধিকার ও দায়িত্ব সকলকে সমানভাবে দান করেছেন। এ জন্য স্বীয় তাবলীগের ক্ষেত্রে কুরাইশ, গায়রে কুরাইশ, হেজাজ ও ইয়েমেন, আরব ও আযম, হিন্দুস্থান ও রূমের কোনো বাধ্য-বাধকতা রাখেননি; বরং দুনিয়ার সকল কাওম, সকল ভাষা এবং সকল অংশে আল্লাহর ধ্বনিকে পৌঁছে দেয়া ফরজ সাব্যস্ত করেন। অহী প্রারম্ভে অজানা লোকদের হুঁশিয়ার করা, বেখবরদেরকে অবহিত করা সর্বপ্রথম নির্দেশ ছিল। ইরশাদ হচ্ছে: “হে চাদব আবৃত নবী! উঠুন এবং সতর্ক করুন।” (সূরা মুদ্দাসসির) তারপর বারবার হুকুম হতে থাকে : (ক) “যা আপনার নিকট নাজিল করা হয়েছে, তা পৌঁছে দিন।” (খ) “মানুষকে দাওয়াত দিন এবং দৃঢ়ভাবে কায়েম থাকুন, যেভাবে আপনাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।” (গ) “মানুষকে নসীহত করুন, যদি নসীহত উপকারী হয়।” (ঘ) “এবং নসীহত করুন, নসীহত ঈমানদারদের উপকার সাধন করে।” (ঙ) “কুরআনের মাধ্যমে ভয় দেখাও যেন আমার শাসনকে ভয় করে।” এ ছাড়াও অসংখ্য আয়াতে এই ফরজের গুরুত্বকে তুলে ধরা হয়েছে “একবার রাসূলুল্লাহ (সা.) হজরত আলী (রা.)-কে লক্ষ্য করে বললেন: বড় হতে বড় দৌলতের চেয়েও শ্রেষ্ঠ।” (সহীহ মুসলিম: খায়বর অধ্যায়) এর চেয়েও অধিক তাৎপর্যের কথা হচ্ছে এই যে, ইসলাম তার প্রত্যেক অনুসারীদের ওপর মঙ্গল কাজের প্রতি আহ্বান জানানো, সৎকাজের নির্দেশ করা, অসৎকাজ হতে নিষেধ করা, পরস্পর একে অন্যকে সত্যতার নসীহত করাকে আবশ্যক সাব্যস্ত করেছে এবং মুসলমানদের এটা ফরজ করা হয়েছে যে, তারা যেন নিজেদের সাথে অন্যান্যদেরকেও অন্ধকার হতে আলোর দিকে নিয়ে আসার জন্য চেষ্টা ও সাধনা করে। রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে হুকুম করা হয়েছে যে, সকল প্রকার ভয়ভীতি উপেক্ষা করে যেন আল্লাহর পয়গামকে মানুষের নিকট পৌঁছে দেয়। আর যদি এমন না করেন, তাহলে রিসালতের দায়িত্ব ও আঞ্জাম দিতে পারবেন না। আল-কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে: “হে আল্লাহর পয়গাম পৌঁছানোকারী! যা কিছু আপনার প্রতিপালকের নিকট হতে আপনার প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে তা মানুষের নিকট পৌঁছে দিন। যদি আপনি এমন না করেন, তাহলে আপনি আল্লাহর পয়গাম পৌঁছাননি; আর অবশ্যই আল্লাহপাক আপনাকে মানুষের খপ্পর হতে রক্ষা করবেন।” (সূরা মায়িদাহ: রুকু-১০)
এরপর এই তাবলীগী দায়িত্ব ও কর্তব্যের বিস্তৃতি ও পরিব্যাপ্তির প্রসঙ্গ সম্পর্কে আলোচনা করা যাক। পয়গামে ইলাহী সত্যের প্রবহমান প্রস্রবণ। যা আস্তে আস্তে স্বাভাবিক গতিতে প্রথম নিকটস্থ ভূ-খন্ডকে, তারপর সম্মুখস্থ ভূ-খন্ডকে, তারপর দূরবর্তী ভূ-খন্ডকে প্লাবিত করতে থাকে। এমনি করেই এই মহা প্লাবন বিশ্বের প্রান্তসীমা পর্যন্ত পৌঁছে যায়। রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে এই তাবলীগের হুকুম পর্যায়ক্রমে প্রদান করা হয়। সর্বপ্রথম গৃহবাসী আপনজনদের খান্দানের লোকজনদের বুঝানোর নির্দেশ দেয়া হয়। ইরশাদ হচ্ছে: “এবং নিকটতম পরিবার-পরিজনদেরকে সতর্ক করো।” (সূরা শোয়ারা: রুকু-১১) তারপর এই বৃত্তের বাইরে মক্কা শহরের অধিবাসী ও শহরতলীতে অবস্থানকারীদেরকে সতর্ক করো।” (সূরা শোরা: রুকু-১)
তারপর তাবলীগের পরিমন্ডল আরও বর্ধিত হয়। প্রত্যেক জীবিত প্রাণ অর্থাৎ জ্ঞান-বুঝ, উপলদ্ধি, বুদ্ধি সম্পন্ন যাদের মাঝে জীবনের মৌলিক চিহ্নসমূহ বিদ্যমান, তাদেরকে লক্ষ্য করে ইরশাদ করা হয়: “এই কুরআন শুধুমাত্র নসীহত এবং সুস্পষ্ট আল্লাহর কালাম, যেন উহা সতর্ক করে ঐ ব্যক্তিকে যে জীবিত” (সূরা ইয়াসীন: রুকু-৫) তারপর সে প্রান্ত পর্যন্ত উহার আওয়াজ পৌঁছে যাওয়া সম্ভব, সকল কে লক্ষ্য করে বলা হয়েছে: “যেন আমি তোমাদেরকে সতর্ক করি এবং তাদেরকে যাদের নিকট এই আওয়াজ পৌঁছে।” (সূরা আনয়াম: রুকু-২) তারপর সমগ্র মানুষ পর্যন্ত তাবলীগের বিস্তৃিত ঘটে। ইরশাদ হচ্ছে: “এই কুরআন সকল মানুষের জন্য পয়গাম।” (সূরা ইব্রাহীম: রুকু-৭) তারপর রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে খেতাব করে বলা হয়েছে: “এবং আমি তোমাকে সকল মানুষের জন্য খোশ-খবরী দাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি।” (সূরা সাবা: রুকু-৩) তারপর রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে হুকুম করা হয়, সকল মানুষকে খেতাব করে যেন এই ঘোষণা দেয়া হয়: “বলে দাও, হে মানব সম্প্রদায়! অবশ্যই আমি আল্লাহর রাসূল, তোমাদের সকলের প্রতি প্রেরিত হয়েছি।” (সূরা আ’রাফ: রুকু-২০) এর চেয়েও অধিক সতর্কতা হচ্ছে এই যে, সমস্ত কায়েনাত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর তাবলীগের আওতাভুক্ত। ইরশাদ হচ্ছে: “বরকতময় সেই আল্লাহ যিনি সত্য এবং মিথ্যার পার্থক্য নিরূপণকারী কিতাব স্বীয় বান্দাহর ওপর নাজিল করেছেন, তিনি পৃথিবীবাসীদের জন্য সতর্ককারী ও ভীতিপ্রদর্শনকারী ঐ আল্লাহর যিনি নভোমন্ডল ও ভূ-মন্ডলের অধিপতি।” (সূরা ফুরকান: রুকু-১)
এর চেয়েও বড় কথা হচ্ছে এই যে, এই তাবলীগ ও দাওয়াতের বিস্তৃতি এবং এর কামিয়াবীর খোশ-খবরী ঠিক ঐ সময়ে দেয়া হয়েছিল, যখন মুসলমানদের অন্তরে এক প্রকার নিরাশার প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছিল। ইরশাদ হচ্ছে: “এই কুরআন পৃথিবীর জন্য নসীহত এবং তোমরা একটি সময়ের পর তা জানতে পারবে।” (সূরা- সোয়াদ : রুকু-৫)
আম্বিয়ায়ে কেরাম মাজহাব প্রবর্তকদের ব্যবহারিক জীবনের নমুনাসমূহ ও উদাহরণগুলোর প্রতি অনুসন্ধিৎসা আলোকে তাকান, তাহলে এই বিশেষত্বটি আরও সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে যে, একমাত্র ইসলাম ছাড়া অন্যান্য যে সকল মাজহাবকে তাবলীগী ও প্রচারধর্মী মনে করা হয়, সেগুলো মূলত: প্রচারধর্মী নয়। স্বয়ং বুদ্ধ ও হিন্দুদের ছাড়া অন্য কাহারো মুক্তির পথের কথা বলেননি এবং প্রচারের জন্য হুকুমও দেননি। হজরত ঈসা (আ:) বনী ইস্রাঈলীদের ছাড়া অন্য কোনো সম্প্রদায়কে স্বীয় নসীহত শোনাননি। অন্যদেরকে উপলক্ষও করেননি। তাদের মধ্যে হতে নিজের কোনো সাগরেদও নির্বাচন করেননি। নিজের জীবনে অন্য কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি নসীহতকারী ও ধর্ম প্রচারকও প্রেরণ করেননি। অথচ তৎকালে ফিলিস্তিনে রোমীয়দের ও ইউনানীদের একটি বৃহৎ জামায়াত অবস্থান করছিল।
রাসূলুল্লাহ (সা.) মক্কায় অবস্থানকালে মক্কা এবং তৎসংলগ্ন এলাকার লোকজনদেরকে সতর্ক করেছেন, জাগ্রত করেছেন। হজের মৌসুমে আরবের প্রতিটি গোত্রে গমন করে সত্যের পয়গাম পৌঁছিয়েছেন এবং তৎকালেই ইয়েমেন এবং আবিসিনিয়া পর্যন্ত তাঁর আওয়াজ পৌঁছে গিয়েছিল। মানুষ সত্যের সন্ধানে তাঁর নিকট আগমন করতে শুরু করে। তারপর তিনি মদীনা আগমন করলেন। কুরাইশরা যদিও কয়েক বছর যাবত অন্যান্য গোত্রে ইসলাম প্রচারের পথে বাধার পাহাড় গড়ে তুলেছিল, কিন্তু তারপরও মুবাল্লিগ এবং আহ্বানকারী প্রেরণ করে অন্যান্য গোত্রে ইসলামের ধ্বনি পৌঁছানো হয়েছিল। পরিশেষে কুরাইশদের বিরুদ্ধে এজন্য তরবারি উত্তোলিত হয়েছিল, যেন শান্তি ও নিরাপত্তার সাথে ইসলামের তাবলীগ কাজ চালানো সহজতর হয়। দীর্ঘ দু’বছর যুদ্ধ-বিগ্রহের পর হুদায়বিয়াতে কুরাইশরা ইসলামের এই দাবিকে মেনে নেয় এবং স্বাধীনভাবে তাবলীগের কাজ চালানোর অনুমোদন দান করে। কুরআনুল কারীম ইসলামের এই আত্মিক বিজয়কে “ফতহে মুবীন” বা সুস্পষ্ট বিজয় বলে সাব্যস্ত করেছে। ইরশাদ হচ্ছে: “অবশ্যই আমি তোমাকে সুস্পষ্ট বিজয় দান করেছি।” এরপরই পূর্ণোদ্যমে আরবে এবং আরবের বাইরে ইসলামের নসীহতকারী, কাসেদ এবং মুবাল্লিগ প্রেরণ করা হয় এবং দুনিয়ার বিভিন্ন রাজা-বাদশাহদের নিকট ইসলামের দাওয়াত সম্বলিত চিঠি প্রেরণ করা হয়েছিল। আরবদের ছাড়া দাইলাম, ইরান, আবিসিনিয়া এবং রোমীয়দের সত্য প্রত্যাশীর দল ইসলাম গ্রহণ করে এবং সত্যের ফয়েজ দ্বারা আপ্লুত হয়ে যায়। আরবের মুশরিকীন, ইহুদি, খ্রিষ্টান এবং পার্সিয়ানরা সকলেই রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জমানায় তাঁর নিকট হতে হেদায়েতের নূর লাভ করেছিল। (সহিহ মুসলিম: হুদায়বিয়া সন্ধি অধ্যায়)।
কিন্তু শুধু কেবল তাবলীগের অপরিহার্যতা ও গুরুত্ব হতে অধিক মাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ বস্তু হচ্ছে তাবলীগের নিয়ম-নীতি ও বিধানাবলি। তাই এ সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো।
এই দিক নির্দেশনা যে, কিভাবে মানুষের সত্য গ্রহণের দাওয়াত দিতে হবে? পৃথিবীতে সর্বপ্রথম রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জবানে অহীর ভাষায় তা প্রকাশ করা হয়েছে। ঐ সকল ধর্ম যেগুলো প্রচারধর্মী হওয়ার দাবি করে, কিন্তু এ কথা বলতে পারে না যে, তাদের সহীফাসমূহ তাদের জন্য তাবলীগের মুখ্য বিধানসমূহ বিশ্লেষণ করেছে। কিন্তু সহীফায়ে মুহাম্মদী (সা.) অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত অথচ পরিপূর্ণ বিশ্লেষণাত্মক ভঙ্গিতে স্বীয় অনুসারীদেরকে বলে দিয়েছে যে, পয়গামে ইলাহীকে কিভাবে মানুষের নিকটে পৌঁছানো যায় এবং তাদেরকে সত্য গ্রহণের দাওয়াত কিভাবে পেশ করা যায়। এ প্রসঙ্গে কুরআনুল কারীমে ঘোষণা করা হয়েছে: “স্বীয় প্রতিপালকের পথের দিকে মানুষের হেকমত ও বুদ্ধিমত্তা, উত্তম উপদেশসহ আহ্বান করো এবং তাদের সাথে সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশে বিতর্ক করো।” (সূরা নহল : রুকু-১৬)
এই আয়াতে কারীমায় তাবলীগ ও দাওয়াতের এই তিনটি বিধান মুসলমানদেরকে শিখানো হয়েছে। বুদ্ধিমত্তা ও হেকমত, উত্তম সদুপদেশ এবং সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশে বিতর্ক করা। মুসলিম যুক্তিবিদ মনীষীগণ বলেছেন: তাবলীগ ও দাওয়াতের এই তিনটিই বিধান। যেগুলোকে যুক্তিবিদ্যার ব্যবহারিক ক্ষেত্রে সাধারণত: কাজে লাগানো হয়। অর্থাৎ একটি হচ্ছে ‘বুরহানিয়াত’। যেখানে ইয়াকীনী মুখবন্ধসমূহের দ্বারা দাবি প্রতিপন্নের উপর দলিল প্রমাণ দাঁড় করানো হয়। দ্বিতীয়টি হচ্ছে ‘খিতাবিয়াত’। যেখানে প্রভাবশীল এবং হৃদয়স্পর্শী বাক্যসমূহ দ্বারা উদ্দেশ্য বস্তুকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। আর তৃতীয়টি হচ্ছে ‘জিদালিয়াত’। যেখানে সাধারণ গ্রহণযোগ্য বাক্যাবলি এবং উভয় দিকের গ্রহণযোগ্য মুখবন্ধসমূহ দ্বারা প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়। কুরআনুল কারীম প্রথমে তরীকাকে হেকমত, দ্বিতীয় তরীকাকে উত্তম সদুপদেশ এবং তৃতীয় তরীকাকে জিদাল বলে বিশ্লেষণ করেছে। দলিল প্রমাণ উপস্থাপনের এই তিনটি তরীকাই আছে। যা দ্বারা এক ব্যক্তি দ্বিতীয় ব্যক্তির সামনে নিজের দাবিকে প্রমাণ করতে পারে।
মোটকথা, এ তো গেলো দার্শনিক তত্তে¡র বিশ্লেষণ। কিন্তু হাকীকত হচ্ছে এই যে, যখন আমরা কাহারও সামনে কোনো নতুন কথা উপস্থাপন করে তা গ্রহণ করার জন্য আহ্বান জানাই, তখন সাধারণত: তিনটি তরীকা অবলম্বন করি। হয়তো সেই কথা প্রমাণ করার জন্য এবং উহাকে প্রতিপন্ন করার জন্য কিছু প্রাণস্পর্শী দলিল প্রমাণ পেশ করি। অথবা তাকে আন্তরিকতার সাথে নসীহত করি হৃদয়গ্রাহীরূপে তাকে নেক ও বদ এবং ভালো ও মন্দ সম্পর্কে অবহিত করি। অথবা তার দলিল প্রমাণকে উত্তম পন্থায় রদ ও বাতিল করে তার ভুলকে তার সামনে তুলে ধরি। প্রথম তরীকার নাম হেকমত, দ্বিতীয় তরীকার নাম উত্তম সদুপদেশ এবং তৃতীয় তরীকার নাম উত্তম পন্থায় বিতর্ক করা। তাবলীগ ও দাওয়াতের এই তিনটি তরীকাই ইসলাম অনুমোদন করেছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
হাজী দীনমোহাম্মাদ ৭ ডিসেম্বর, ২০১৮, ৭:২০ এএম says : 0
ফেতনাফেসাত বাদ দিয়ে সাহি তরিকায় তাবলিগের কাজকরা উচিত।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন