একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দায়িত্ব পালনে সেনাবাহিনী মাঠে নামছে আজ। সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা নির্বাচন নিয়ে দেশময় যে ভীতি-আতঙ্ক বিরাজমান বাহিনীটির সদস্যরা নামলে তা কেটে যাবে। ৯ নভেম্বর তফসিল ঘোষণার পর থেকে বহুদলীয় প্রার্থীর ভোটের মাঠে যে এক দলীয় প্রচার-প্রচারণা চলছে তার অবসান ঘটবে। স্টেকহোল্ডার সব পক্ষই প্রচারণার সমান সুযোগ পাবে; আতঙ্কিত মানুষের মধ্যে ভোট কেন্দ্রে যাওয়া নিয়ে ভীতি ও ভোট দেয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা কেটে যাবে।
আইন শৃংখলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ বাহিনীর কিছু কর্মকর্তার দুর্নীতি, গ্রেফতার বাণিজ্য, ক্ষমতাসীন দলের দাসত্ব ওপেন সিক্রেট। এখন নির্বাচনী মাঠে সরকারি দলের প্রতিপক্ষ প্রার্থীদের মাঠে নামতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করায় প্রতিষ্ঠানটির ইমেজ তলানীতে। অপ্রিয় হলেও সত্য গত কয়েক বছরে পুলিশ প্রশাসনে দলীয়করণ এবং ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছামতো ব্যবহারের কারণে সাধারণ মানুষ বাহিনীটির উপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। নির্বাচনী প্রচারণার মাঠে আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীটির বিপুল সংখ্যক কর্মকর্তার আইন বহিভূত ও পক্ষপাতিত্ব ভূমিকায় সব দলের প্রার্থীরা নির্বাচনী প্রচারণায় নামতে ভয় পাচ্ছে। অনেক প্রার্থী এখনো ঘর থেকে বের হতে পারছেন না; অনেকেই রয়েছেন পলাতক।
এখনো গভীর রাতে বিএনপির প্রার্থী ও কর্মী সমর্থকদের বাসায় বাসায় গিয়ে তল্লাসী চালানো হচ্ছে। সাধারণ ভোটারদের ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। সেনাবাহিনী মাঠে নামলে পুলিশ এই বিতর্কিত ভূমিকা পালনে সাহস পাবে না এবং পালিয়ে থাকা প্রার্থীরা প্রকাশ্যে প্রচারণায় নামবে এবং মানুষের ভয় কেটে যাবে। এতে সব দলের প্রার্থীরা নির্বিঘেœ নির্বাচনী প্রচারণায় নামাতে সাহসী হবেন এবং ভোটাররাও নির্ভয়ে ভোট দেয়ার ব্যাপারে আশাবাদী হয়ে উঠবে।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মাঠের একপক্ষীয় প্রচারণার চিত্র ওপেন সিক্রেট। মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে সব খবর মানুষের নখদর্পনে। ইতোমধ্যেই ভোটের অনেক অপ্রীতিকর খবর ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে গেছে। সেসব খবর নিয়ে চলছে তর্ক-বিতর্ক। নির্বাচনকে দেশের মানুষ উৎসব মনে করলেও এখনো অনেক এলাকায় ভয়েই ধানের শীষের প্রার্থী ও সাধারণ মানুষ প্রচারণায় নামতে পারছেন না। ধানের শীষ প্রতীকের পক্ষ্যের লোকজনকে গ্রেফতার-হামলা-মামলা চলছে ফ্রি-স্টাইলে।
ঐক্যফ্রন্ট তথা বিএনপির ১৭ জন প্রার্থী বর্তমানে কারাগারে। তসফিল ঘোষণার পর এদের অনেককেই গ্রেফতার করা হয়। কয়েকজন প্রার্থীর প্রার্থীতা নজীরবিহনীভাবে আদালত থেকে বাতিল করা হয়। কারো কারো প্রার্থীতা স্থগিত করা হয়। আবার পুলিশ এমন ভাবে ধানের শীষ প্রতীকের কর্মী-সমর্থনদের গ্রেফতার করছে যে ভোটের দিন পুলিং এজেন্ট দেয়াই তাদের জন্য কঠিন হয়ে যাবে। অথচ ইসি নির্বিকার। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কর্তা নিত্যদিন বাক-বাকুম করে যাচ্ছেন।
রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের রাস্তা-ঘাট, বিল্ডিংয়ের দেয়াল, অফিস-আদালত পাড়া, গাছগাছালি নৌকার প্রতীকের পোষ্টারে ঢেকে দেয়া হয়েছে। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে একই চিত্র। নাম সর্বস্ব কিছু দলের প্রার্থীদের পোষ্টার চোখে পড়লেও নৌকার প্রধান প্রতিদ্ব›দ্বী ধানের শীষের কোনো পোষ্টার চোখে পড়ছে না। বহুদলীয় গণতন্ত্রের দেশে এ কেমন চিত্র! পাকিস্তান আমলেও এই অঞ্চলে নির্বাচনের এমন একপক্ষীয় প্রচারণা দৃশ্য দেখা যায়নি।
প্রার্থীরা অভিযোগ করছেন ধানের শীষের পোষ্টার লাগাতে বাধা দেয়া হচ্ছে। এই বাধা যেমন নৌকা প্রতীকের প্রার্থী কর্মীদের পক্ষ থেকে আসছে; তেমনি আইন শৃংখলা রক্ষা বাহিনীও বাধা দিচ্ছে। এমনকি ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। সিইসি ভোটের নিরপেক্ষ পরিবেশ তৈরি হয়েছে দাবী করলেও নির্বাচন কমিশনের ভুমিকা কার্যত প্রশ্নবিদ্ধ। নির্বাচন বিশেষজ্ঞ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন বলেছেন, জীবনে এতো অসমতল মাঠে নির্বাচন আমি দেখিনি। ইসির সব ভুমিকাই প্রশ্নবিদ্ধ। মাঠ সমতলের বদলে ইসি এক পক্ষকে জিতিয়ে দেয়ার জন্য যেন মরিয়া হয়ে উঠেছেন।
অধ্যাপক তোফায়েল আহমদ, ‘সুজন’ সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, ব্রতীর প্রধান নির্বাহী শারমিন মুর্শিদ প্রায় অভিন্ন বক্তব্য দিয়েছেন। সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ইসির অনেক কিছুই করার ছিল; কিন্তু তারা কিছুই করছে না। এতে ক্ষমতাসীনরা সুবিধা নিচ্ছে। অংশগ্রহণমূল নির্বাচন হলেই যে তা নিরপেক্ষ হয় না সেটা মাঠের চিত্র দেখেই বোঝা যায়। ইসি চরমভাবে ব্যর্থ। সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেছেন, এ অবস্থায় সেনাবাহিনী ভুমিকা রেখে সকল প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারণা বাধাহীন করতে পারে। দেশের মানুষ সেনাবাহিনীর কাছে ভোাাট দেয়ার অধিকার নিশ্চিতকরণ প্রত্যাশা করে।
সিইসি কে এম নুরুল হুদা দাবি করছেন নির্বাচনের ‘চমৎকার পরিবেশ’ সৃষ্টি হয়েছে। অথচ নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার সংশ্লিষ্টদের নির্বাচনী পরিবেশ নিয়ে ‘বিবেকের’ কাছে প্রশ্ন করার আহবান জানিয়ে বলেছেন, মাঠ এখনো অসমতল। সিইসি দাবি করছেন আইন শৃংখলা বাহিনী ইসির কথামতো চলছে। বাস্তবে আইন শৃংখলা বাহিনী ইসিকে পাত্তাই দিচ্ছে না। রিটানিং অফিসারের দায়িত্ব পালনরত ডিসিদের ‘ভূমিকা’ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। রিটানিং অফিসার, নির্বাচন কমিশন, পুলিশ প্রশাসন, আদালত সর্বত্রই একই অবস্থা।
একটি দলকে জিতিয়ে দেয়ার সিন্ডিকেট যেন তৈরি হয়ে গেছে। নির্বাচনের দিন ঘনিয়ে আসছে অথচ সাধারণ মানুষ কোথাও আস্থা পাচ্ছেন না। ভোট দিতে যাবেন কিনা সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। ভীতি আতঙ্কে শুধু বিপুল সংখ্যক প্রার্থীরাই নয়, ভোটারদের মধ্যেও। সাধারণ ভোটার তো বটেই বিশেষ করে যারা ভোট দিতে গিয়ে ঝামেলায় পড়তে চান না সেই তরুণ ভোটার, নতুন ভোটার, মহিলা ভোটার এবং স্যুয়িং ভোটাররা ভোট দিতে যাবেন কিনা তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন। এই অবস্থায় সেনাবাহিনী লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির লক্ষ্যে ভোটের মাঠে নামছে।
অপ্রিয় হলেও সত্য যে দেশের পুলিশ বাহিনীর কিছু উর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিতর্কিত ও দলবাজী ভূমিকায় জনগণের ট্যাক্সের অর্থে পরিচালিত বাহিনীটিকে মানুষ প্রতিপক্ষ ভাবতে শুরু করছে। দেশের বিপুল সংখ্যক ভোটার ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বললে তারা নিজেদের এই অভিমত জানান। ফলে সেনাবাহিনীর প্রতি মানুষের প্রত্যাশা বেড়ে গেছে অনেক বেশি। মানুষ এখনো মনে করে সেনাবাহিনী সব সময় দেশের দুর্যোগ মুহুর্তে মাঠে নেমে জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে। এবারও তার ব্যাতিক্রম হবে না। বহুদিন থেকে মানুষ ভোট দিতে পারেন না। সেনাবাহিনী জনগণের ভোটের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠায় ভুমিকা রাখবে।
ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, ’৭১ সালে পাকিস্তানীদের বর্বরোচিত হামলা শুরু হলে রাজনৈতিক নেতারা যখন প্রাণ বাঁচাতে পালাতে ব্যাতিব্যস্ত হয়ে পড়েন, পরিবারের সদস্যদের নিরাপদে নেয়ার জন্য ঘাম ঝড়ান; তখন সেনাবাহিনীই পাকিস্তানী বর্বরদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। সেনাবাহিনী আমাদের পাশে রয়েছে বুঝতে পেরে পাকিস্তানী বাহিনীর বন্দুকের নলের মুখে বিপন্ন মানুষ ঘুরে দাঁড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েন। মুক্তিযুদ্ধে সেনাবাহিনীর নতৃত্ব ও গৌরবোজ্বল ভুমিকার কথা মানুষ ভোলেনি। সেই ’৭১ থেকে এখন পর্যন্ত সেনাবাহিনী দুর্যোগ, সময়-অসময়ে জনগণের পাশে থেকেছে। দেশের রাজনৈতিক দুর্যোগময় মূহুর্তে এবারও সেনাবাহিনী মানুষের পাশে থাকবে এবং ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠায় ভুমিকা রাখবে সে প্রত্যাশা আমজনতার।
এবারের নির্বাচনের নিরপেক্ষতার ওপর নির্ভর করছে বিশ্বদরবারের দেশের ভাবমূর্তি অর্থনীতি গতিধারাসহ অনেক কিছুই। আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ অনেক উন্নয়ন সহযোগী বার্তাও দিয়েছে। জাতিসংঘ, ওআইসি, কমনওয়েলথ, দাতাদেশ-সংস্থা, উন্নয়ন সহযোগী দেশ-সংস্থা সবাই তাকিয়ে রয়েছে নির্বাচনের দিকে। তাদের সবার প্রত্যাশা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন যেন গ্রহণযোগ্য হয়। সব দল যেন সমান ভাবে প্রচারণা এবং ভোটাররা যেন নির্বিঘে্ন ভোট দেয়ার সুযোগ পায়। পাতানো নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন নয়; মানুষের ভোটে যেন এবার সরকার গঠিত হয়। ভোটের মাত্র ৫দিন বাকী অথচ কে এম নুরুল হুদা কমিশনের নজীরবিহীন ব্যর্থতা ও আইন শৃংখলা বাহিনীর পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণের কারণে সে পরিবেশ এখনো সৃষ্টি হয়নি।
বহুদল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও চলছে এক দলীয় প্রচারণা। টিভি মিডিয়া বিজ্ঞাপনের নামে ক্ষমতাসীন দলের স্তুতি গাইছে। এ অবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের মাঠে সেনাবাহিনী প্রত্যাশা করে। অনেক দিন থেকে বিএনপিসহ কিছু রাজনৈতিক দল সেনাবাহিনীর অধিনে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে। নির্বাচন কমিশনে লিখিতভাবে এ দাবি জানানো হয়েছে। তাদের বক্তব্য সেনাবাহিনী দেশের জনগণের পাশে যেমন সব সময় থেকেছে; তেমনি জাতিসংঘের হয়ে বিশ্বের দেশে দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সুনাম অর্জন করেছে। আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টির মধ্যেই জনগণের প্রত্যাশিত সেনাবাহিনী মাঠে নামছে। ফলে তাদের প্রতি মানুষের প্রত্যাশার পারদ একটু বেশি বৈকি।
পুলিশী বাধার মুখেই নির্বাচনের মাঠে প্রচারণা চলছে। ঘনিয়ে আসছে ভোটের দিন। পুলিশ ও প্রশাসনের পক্ষপাতিত্ব আচরণের মাধ্যমে বিশ্ব সম্প্রদায়ের চোখে ধূলা দিয়ে এক পক্ষ্যকে জিতিয়ে দেয়ার যেন সব আয়োজন সম্পন্ন। হাজারো চাপাচাপির পরও নির্বাচনী মাঠের রেফারি (ইসি) মাঠ নিরপেক্ষ করার চেষ্টা করছেন না। উল্টো স্ববিরোধী কথাবার্তা বলে বাতাস গরম করছে। আবার এক পক্ষ্য বিপুল প্রচারণা চালিয়ে কৌশলের মধ্যেদিয়ে বিজয়ের জন্য অপেক্ষা করছে; অন্যপক্ষ্যের বিপুল সংখ্যক প্রার্থীর প্রার্থীতা করে রাখা হয়েছে দোদুল্যমান।
নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে পারবে কিনা তা হয়ে গেছে অনিশ্চয়তার খেলা ক্রিকেটের মতোই। খেলার শেষ মুহুর্তে হাতে এক বল আর জিততে প্রয়োজন ৬ রান। দুই পক্ষ্যেই অনিশ্চয়তা। খেলোয়ার তো বটে; মাঠের দর্শকদের মধ্যেও টান টানা উত্তেজনা। কে হারে কে জেতে বলা মুশকিল। বর্তমান নির্বাচনের অসমতল মাঠের যুথসই উদাহরণ ক্রিকেট খেলার মতোই। ক্রিকেট দর্শকের মতোই সাধারণ মানুষের মধ্যে টান টান উত্তেজনা। নির্বাচনে কে জিতবে কে হারবে তার চেয়ে মানুষের উত্তেজনা ভোটাররা কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে পারবে কিনা তা নিয়ে? গ্রেফতার-হামলা-মামলার ভয়ে পলাতক প্রার্থীরা ভোটের আগে দু’চারদিন প্রচারণা চালাতে পারবেন তো?
আমজনতার প্রত্যাশা সেনাবাহিনী মাঠে নামলে পালিয়ে থাকা প্রার্থীরা প্রকাশ্যে এসে প্রচারণায় নামার সুযোগ পাবেন। ভোটের পরিবেশ কিছুটা হলেও স্বাভাবিক হবে। প্রবাদে আছে ‘যে যায় লংকা সেই হয় রাবণ’। নির্বাচনের মাঠে ক্ষমতাসীনদের আচরণ দেখে মানুষ প্রবাদটি স্মরণ করছে। সেনাবাহিনী মাঠে নামলে ক্ষমতাসীনদের হুন্ডা-গুন্ডা ও আইন শৃংখলা বাহিনী যারা প্রবাদের রাবণের মতো প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করছেন; জনগণের মধ্যে ভীতি সৃষ্টি করছেন; তারা কিছুটা হলেও হোচট খাবেন। সেনাবাহিনীর কাছে আমজনতার সে প্রত্যাশায় রয়েছেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন