শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

ইকোনমিস্টের দৃষ্টিতে বাংলাদেশের ভোট

কূটনৈতিক সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ৬ জানুয়ারি, ২০১৯, ১২:০২ এএম

আওয়ামী লীগ চিত্তাকর্ষক একটি সংগঠন। ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া সংগঠনটির নেতৃত্বে যে আন্দোলন হয় তার মাধ্যমেই ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা লাভ করে বাংলাদেশ। গত এক দশকসহ স্বাধীনতার পর এই ৪৭ বছরের ১৯ বছরই দেশ শাসন করেছে দলটি। ৩০শে ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ ফের ৫ বছর মেয়াদে ক্ষমতা পেয়েছে। ছোটখাটো কিছু মিত্র সমেত দলটি মোট আসনের ৯৬শতাংশ লাভ করেছে। ক্ষমতাসীন জোট ২০১৪ সালে যত আসন পেয়েছিল, এবার পেয়েছে তার চেয়েও বেশি আসন। সেবার প্রধান প্রতিদ্ব›দ্বী বিএনপির নির্বাচন বয়কটের কারণে ভোটার উপস্থিতি একেবারেই কমে যায়। অর্ধেকেরও বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্ব›দ্বীতায় জয় পায় ক্ষমতাসীন জোট।
কিন্তু ২৯৯ টি আসনের মধ্যে ২৮৮টিতে আওয়ামী লীগ ও দলের নেত্রী শেখ হাসিনার জয় কি এটাই বোঝায় যে, তাদের জনপ্রিয়তা বাড়ছে? সেটা জানার আর কোনো উপায় নেই। এই নির্বাচনে মাঠ এতটাই অসমতল ছিল, ভোটাভুটি এতটাই ত্রুটিপূর্ণ ছিল ও ভোটগণনা এতটাই অস্বচ্ছ ছিল যে, খোদ দলের অনেক সমর্থকই এই ফলাফল নিয়ে সন্দিহান।
মতামত জরিপ ও নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকদের মতে, এই ধরনের ভয়াবহ জালিয়াতি ছাড়াও শেখ হাসিনার দল সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেত। স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পৃক্ততা, স্বাধীনতার নায়কের কন্যা হিসেবে শেখ হাসিনার মর্যাদার কারণে দলটি দেশের প্রায় এক তৃতীয়াংশ ভোটারের সমর্থন এমনিতেই পেয়ে আসছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে প্রবল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, মানব সম্পদ উন্নয়নে বড় অগ্রগতি ও চরমপন্থার প্রতি কঠোরতা দেশে তার জনপ্রিয়তা বাড়িয়েছে। তার বিভিন্ন নীতিমালার প্রশংসা বিদেশেও হয়, বিশেষ করে প্রতিবেশী ভারতে।
বাংলাদেশের খুব কম বুদ্ধিজীবী কিংবা বিদেশী কূটনীতিক প্রত্যাশা করেছিলেন কিংবা খুব করে চেয়েছিলেন যে বিএনপি জিতুক। বিএনপিরও ঐতিহাসিকভাবে সমর্থক ঘাঁটি ছিল যেটি হয়তো আওয়ামী লীগের চেয়ে কিছুটা ছোট। ২০০১-২০০৬ সালে সর্বশেষ বিএনপি ক্ষমতায় ছিল। স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি ও চরমপন্থীদের সঙ্গে হৃদ্যতার দুর্নাম জুটেছিল দলটির। পার্লামেন্টে দশ বছর নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে শাসন করে আওয়ামী লীগ দেশের সমস্ত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে করায়ত্ত করেছে। এ নিয়ে দলটির অনেক সমর্থকদের মধ্যেও সমালোচনা জন্ম নিয়েছে। জবাবদিহির আওতায় না থাকা পুলিশ ও সরকারী কৌঁসুলিরা প্রায়ই বিএনপি সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে ও গ্রেফতার করে হয়রানি করে।
সন্দেহভাজন মাদক কারবারিদের ব্যাপারে ‘আগে গুলি করো’ নীতির কারণে মে মাসের পর থেকে প্রায় ৪০০ জন নিহত হয়েছেন। দলটির ‘ছাত্র সংগঠনে’র গুন্ডারা কাউকে শত্রু মনে করলেই মেরে ফেলে। সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে ঢাকায় ছাত্ররা বিক্ষোভ করলে, সরকারের এই গুন্ডারা বেশ নৃশংস প্রতিক্রিয়া দেখায়। তাদের আচরণ ছিল এমন যেন খোদ রাষ্ট্রই বিপদে আছে। এছাড়া আওয়ামী লীগ এমন সব আইন প্রণয়ন করেছে যা গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে ব্যাপকভাবে সীমিত করে।
এ ধরনের চাপের কারণে অনেকেই আশঙ্কা করছিলেন যে, বিএনপি হয়তো ২০১৪ সালের মতো ফের নির্বাচন বয়কট করতে পারে। তবে অক্টোবরে অনেককে অবাক করে দিয়ে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ছাড় দেয়। ৮১ বছর বয়সী সাংবিধানিক আইনজীবী প্রখ্যাত উদারবাদী ও আওয়ামী লীগেরই সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল হোসেনের নেতৃত্বে বৃহত্তর জোটে যোগ দেয়। নির্বাচনের সময় ব্যাপক ভয়ভীতি প্রদর্শন ও হয়রানি সত্তে¡ও এই জোট মাটি কামড়ে ছিল। এর মধ্যে বিএনপির ওয়েবসাইট বন্ধ করে দেয়া হয়, বিএনপিকে সমাবেশ করতে দেয়া হয়নি, প্রায় ১০ হাজার কর্মী আটক হয়।
তবে বিএনপি নির্বাচনে থাকায় স্থানীয় পর্যবেক্ষক ও বিদেশী কূটনীতিকরা তখন সম্ভাব্য ফল নিয়ে জল্পনা-কল্পনা শুরু করেন। তারা ভেবেছিলেন, নির্বাচনী ফল হাসিনার অনুকূলে যাবে। তবে শক্তিশালী বিরোধীদল তাকে হয়তো কিছুটা হলেও সংযত রাখবে। এক বুদ্ধিজীবী বলেন, যদি আওয়ামী লীগ দুই-তৃতীয়াংশের কম আসন পেয়ে সরকার গঠন করে, তাহলে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে তা সহায়ক হবে। অন্তত: আমাদেরকে ক্ষত উপশমের পথে নিয়ে যাবে।
কিন্তু সেই পথে আর যাওয়া যাবে না। দেশজুড়ে প্রায় ৪০ হাজার ভোটকেন্দ্রে ভোটাভুটি শুরু হতে না হতেই, কিছু ব্যালট বক্স সন্দেহজনকভাবে পরিপূর্ণ দেখা যেতে লাগলো। ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ঘুরে দেখা গেল আওয়ামী লীগের অসংখ্য ব্যানার আর পোস্টারের বিপরীতে বিএনপির পোস্টার পাওয়া যায় না বললেই চলে। প্রত্যেকটি বুথে বহু আওয়ামী লীগ সহায়তাকারীর বিপরীতে কোনো বিরোধী এজেন্ট পাওয়া গেল না। অর্থাৎ সেখানে ভোটাভুটি কিংবা ভোটগণনা প্রত্যক্ষ করার কেউ ছিল না।
আওয়ামী লীগের আধিপত্য আছে যেসব এলাকায়, সেখানে ভোট খুব দ্রুতই শেষ হয়ে যায়। ভোটার সারিও ছিল কম। ভোটদানে তেমন ঝামেলাও পোহাতে হয়নি। কিন্তু ঢাকা-১৫ আসনের মতো প্রতিদ্ব›দ্বীতাপূর্ণ এলাকায় দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। মনিপুর হাই স্কুলে হাজার হাজার ক্ষুদ্ধ নারী পুরুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্কুলের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। অনেকে শেষ অবদি রাগে-ক্ষোভে চলেও গেছেন। কারণ, পুলিশ ও আওয়ামী লীগের কর্মীরা খুবই সামান্য কিছু ভোটারকে একটি দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে দিচ্ছিলেন। অথচ ভেতরে ৩৬টি ব্যালট বক্স ছিল। দুপুরের মধ্যে দেখা গেল, একটি কক্ষে মাত্র ৪১ জন ভোটার ভোট দিতে পেরেছিলেন। অথচ এখানে ভোট দেয়ার জন্য নিবন্ধিত ছিলেন এক হাজার জন।
সারাদেশ থেকে একই ধরনের প্রতিবেদন আসতে শুরু করলো যে, বিরোধীদলের এজেন্টদের হুমকি দেয়া হয়েছে কিংবা মার দেয়া হয়েছে। অনেক ভোটারকে ঢুকতে দেয়া হয়নি। বুথ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে ‘মধ্যহ্নভোজে’র জন্য কিংবা ব্যালট শেষ হয়ে গেছে এই যুক্তিতে। নির্বাচনের দিন সহিংসতায় ১৯ জন মারা গেছেন।
প্রত্যাশিতভাবেই সরকার মনোনীত নির্বাচন কমিশন দাবি করেছে, ভোটাভুটি হয়েছে শান্তিপূর্ণভাবে। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক হিসেবে উপস্থাপিত এক অদ্ভূত গোষ্ঠীও সন্তোষ প্রকাশ করে। আঞ্চলিক দুই শক্তি চীন ও ভারত অভিনন্দন জানায়।
শেখ হাসিনা নিজেও অনেক ঘটনা উড়িয়ে দিয়েছেন। তার বক্তব্য, এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে যে, বিরোধীদলের হাতে আমাদের দলের কর্মীরা মারা গেছেন। তার নিজের আসনে তার জয়ের অনুপাত ছিল ১০০০:১-এরও বেশি। কিছু কেন্দ্রে বিরোধীদলের প্রার্থীরা একটি ভোটও পাননি, নিজেদের ভোটও নয়।
কাজ যখন হয়েই গেছে, সরকারী মন্ত্রীরা ফের উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির কাজে নেমে পড়ার কথা বলছেন। পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আছে রাষ্ট্র। বিদেশে আছে ক্ষমতাধর বন্ধু। আর সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত বিরোধীদল। ফলে এই মন্ত্রীরা এখন হয়তো ভালো করে ঘুমাতে পারবেন। কিন্তু ঢাকার এক শঙ্কিত শিক্ষক যেমনটা বলছিলেন, তারা যেটা বুঝতে পারছে না সেটা হলো, তাদের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকী হলো তাদেরই লাগামহীন ক্ষমতা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (14)
Manzu Manzu ৬ জানুয়ারি, ২০১৯, ১:০২ এএম says : 0
লাগামহীন ক্ষমতা মানেই লাগামহীন দূর্নীতি।
Total Reply(0)
MD Russel ৬ জানুয়ারি, ২০১৯, ১:০২ এএম says : 0
নির‌পেক্ষ ভোট হ‌লে হা‌সিনার জন‌প্রিয়তা গগনচু‌ম্বি না হ‌লেও মা‌টির সমান হত এটা নি‌শ্চিত বল‌তে পা‌রি।কারন এরকম ভোট দেওয়া জীব‌নে কখ‌নো দে‌খি নাই।একজন কে জি‌জ্ঞেস করলাম অাপ‌নি কয়টা দি‌য়ে‌ছেন বল‌লো 58 টা মাত্র।সা‌থে অামার টাও না‌কি দি‌ছে।
Total Reply(0)
আবু সায়মা ৬ জানুয়ারি, ২০১৯, ১:০৩ এএম says : 0
মোটা দাগে বলা যায়, যেসব আসনে বিএনপি এক তৃতীয়াংশের কম ভোট পেয়েছে নিশ্চিত ভাবে সেসব আসনে ভোট জালিয়াতি হয়েছে। কেন্দ্র ভিত্তিক ভোটের ফলাফল পর্যালোচনা করলে বোঝা যায় কত ব্যাপকভাবে দুর্নীতি হয়েছে।
Total Reply(0)
Sazzadur Rahman ৬ জানুয়ারি, ২০১৯, ১:০৩ এএম says : 0
Neropookko vote hole o sob nowka jitbe karon bnp kokono komotay ullek joggo kisu korene tara nejeder aker gorese.
Total Reply(0)
Mk Khalil ৬ জানুয়ারি, ২০১৯, ১:০৩ এএম says : 0
Very bad Awamilig
Total Reply(0)
palash mahbub ৬ জানুয়ারি, ২০১৯, ১:০৪ এএম says : 0
একটি অধিকতর অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলেও সম্ভবত শেখ হাসিনাই জিততেন।
Total Reply(0)
ফজলুল হক ৬ জানুয়ারি, ২০১৯, ১:০৬ এএম says : 0
সব ঠিক ছিল কিন্তু নেতাকর্মীরা এত বেশি ভোট দিয়েছে যাতে আর্ন্তজাতিক মহল নড়েচড়ে বসল
Total Reply(0)
Aslam Bhai ৬ জানুয়ারি, ২০১৯, ১:০৬ এএম says : 0
পশ্চিমা ভাই লোগ, আপনাদের গণতন্ত্রের প্রেসক্রিপশান আপনাদের পকেটে রাখুন।
Total Reply(0)
Mohammad Abdur Rahim ৬ জানুয়ারি, ২০১৯, ১:০৭ এএম says : 0
যে সব সংবাদমাধ্যম সঠিক নিউজ দিচ্ছে না, তাদের বয়কট করুন।
Total Reply(0)
Sayad Rabiul Islam ৬ জানুয়ারি, ২০১৯, ১:০৭ এএম says : 0
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের নিউজে কি উঠে এসেছে, নির্বাচন সুষ্ঠ হয়েছে কী হয়নি? তাহলে আমাদের গণমাধ্যম গুলো কী নিউজ করলো?
Total Reply(0)
Mohammad Younus ৬ জানুয়ারি, ২০১৯, ১:১৭ এএম says : 0
The best complement was given by Washington Post - Democracy like North Korea.
Total Reply(0)
shah Alam bhuiyan ৬ জানুয়ারি, ২০১৯, ১:১৮ এএম says : 0
EVERYBODY KNOWS THAT EVEN IN THE USA THE ELECTION WAS QUESTIONABLE. THE DEMOCRATIC PARTY BROUGHT ALLEGATION AGAINST THE REPUBLICAN TWICE ABOUT ELECTION RIGGING.
Total Reply(0)
Mohammed Kowaj Ali khan ৬ জানুয়ারি, ২০১৯, ৯:১৯ এএম says : 0
ইনশাআল্লাহ। ********* আমি জরিপ করিয়াছি যদি সত্যিকার নিরবাচন হইতো তবে এই ভোট চুর ভারতীয় দালাল একটি সিট ও পেতো না ভারত চুর হইতে এই চুর অনেক বড় চুর। জাতির সাথে যে বেঈমানী করিয়াছে একদিন জাতি ওদেরকে ধরিবেন। ইনশাআল্লাহ। ********* পাক হানাদারদের জাতি ক্ষমা করেন নাই এই দালাল দখলদারদেরকে জাতি ক্ষমা করিবেননা। ইনশাআল্লাহ। **********
Total Reply(0)
Mohammed Kowaj Ali khan ৬ জানুয়ারি, ২০১৯, ৯:১৯ এএম says : 0
ইনশাআল্লাহ। ********* আমি জরিপ করিয়াছি যদি সত্যিকার নিরবাচন হইতো তবে এই ভোট চুর ভারতীয় দালাল একটি সিট ও পেতো না ভারত চুর হইতে এই চুর অনেক বড় চুর। জাতির সাথে যে বেঈমানী করিয়াছে একদিন জাতি ওদেরকে ধরিবেন। ইনশাআল্লাহ। ********* পাকিস্তান হানাদারদের জাতি ক্ষমা করেন নাই এই দালাল দখলদারদেরকে জাতি ক্ষমা করিবেননা। ইনশাআল্লাহ। **********
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন