ঘটনাটি ঘটিয়েছে ব্রেনটন ট্যারেন্ট নামক অস্ট্রেলীয় এক শ্বেতাঙ্গ জঙ্গি। সে টুইটারে প্রায় ৮০ পাতার একটি ইশতেহার আপলোড করে বলেছে, ‘আমি মুসলিমদের অপছন্দ করি। আমি সেসব মুসলিমকে ঘৃণা করি, যারা অন্য ধর্ম থেকে এসে মুসলিম হয়’। হামলাকারী এসব মুসলিমকে রক্তের সঙ্গে প্রতারণাকারী বর্ণনা করে জানিয়েছে, ‘এসব প্রতারণাকারীর বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই’। ইশতেহারে সে এও বলেছে- ‘এটি একটি সন্ত্রাসী হামলা’। হামলার মাধ্যমে সে অনুপ্রবেশকারীদের (অভিবাসীদের) দেখাতে চায় যে, ‘আমাদের ভ‚মি কখনও তাদের ভ‚মি হবে না, যতক্ষণ শ্বেতাঙ্গরা জীবিত থাকবে’। নিজেকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একজন সমর্থক হিসেবে তুলে ধরে হামলাকারী বলেছে- ‘পুনরুজ্জীবিত শ্বেতাঙ্গ পরিচয়ের প্রতীক হিসেবে আমি অবশ্যই ট্রাম্পের একজন সমর্থক’। হামলাকারী জঙ্গি আরো বলেছে, ‘আমি ডিলান রুফসহ আরও অনেকের বই পড়েছি। তবে আমি প্রকৃতভাবে অ্যান্ডারস ব্রেইভিকের ওই হামলা থেকেই উদ্বুদ্ধ হয়েছি’। উল্লেখ্য, ২০১১ সালে নরওয়েতে অ্যান্ডারস ব্রেইভিক বোমা ও গুলি চালিয়ে ৭৭ জনকে হত্যা করেছিল। সা¤প্রতিক সময়ে মুসলিম বিদ্বেষ ও বর্ণবাদী রাজনীতির কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোতে হেইটক্রাইম বেড়ে গেছে। পশ্চিমা বর্ণবাদী ডানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর প্রোপাগান্ডায় একশ্রেণির বিভ্রান্ত উগ্রপন্থী মানুষ প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে এ ধরনের সন্ত্রাসী হামলায় লিপ্ত হচ্ছে।
নিউজিল্যান্ডের ২০১৩ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী দেশটিতে প্রায় ৪৬ হাজার মুসলমান বসবাস করেন, যা দেশটির মোট জনসংখ্যার ১ শতাংশ। সরকারের তথ্য অনুযায়ী, ওই ৪৬ হাজার মুসলমানের মধ্যে ২৮ শতাংশ এসেছেন ২০০৬ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে। আর এক চতুর্থাংশ জন্মগ্রহণ করেছেন নিউজিল্যান্ডে। নিউজিল্যান্ডে বসবাস করা অধিকাংশই ইসলামের শ্বাশ্বত নীতিতে বিমোহিত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন এবং এই সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। হামলাকারী জঙ্গি তা সহ্য করতে পারেনি। মুসলমানদের প্রতি হিংসা ও ঘৃণার কারণে সে এই হামলা চালিয়েছে। এই ঘটনার মাধ্যমে এক বিষাক্ত আপরাধের স্বাদ পেল নিউজিল্যান্ড। স্বয়ং নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী একে দেশের অন্ধকারতম দিনগুলির মধ্যে একটি বলে বিবৃতি দিয়েছেন।
হামলাকারীর দেয়া ইশতেহার ও আক্রমণের ধরন দেখে সহজেই অনুমেয় হয় যে, এই হামলাটি পূর্বপরিকল্পিত। এই ঘটনা কীভাবে ঘটল কেবল তা চিহ্নিত করাই এখন যথেষ্ট নয়। আরো অনেক কিছুই চিহ্নিত করতে হবে। এই জঙ্গি কীভাবে নজরদারীর আওতার বাহিরে থাকল, সে দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কী করল, এসব বিষয় খতিয়ে দেখতে হবে। হামলার আগেই টুইটারে হামলার ইশতেহার আপলোড করার পরেও নিউজিল্যাডের পুলিশ, গোয়েন্দা তথা নিরাপত্তা বাহিনীর কেউ কিছুই করতে পারলো না। এটা সত্যিই দুঃখজনক। এটা তাদের বড় ধরনের একটা ব্যর্থতা।
এই সাদা সন্ত্রাসীর ব্রাশফায়ারে মানুষ হত্যার নিন্দা ও নিহতদের প্রতি শোক, ক্ষোভ জানিয়েছেন বিশ্বের সর্বস্তরের মানুষ। কিন্তু শান্তির বাণী উচ্ছারণকারী অশান্তির কারিগর পশ্চিমারা মুখে নিন্দা ও শোক প্রকাশ করলেও কার্যত কোনো প্রদক্ষেপ নেবে কী না, তা তাদের শোক বার্তা থেকেই অনুমান করা যাচ্ছে। সমগ্রবিশ্বে অশান্তি সৃষ্টির কারিগর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘এটি খুবই ভয়াবহ একটা ঘটনা, কিন্তু এ দিয়ে শ্বেত জাতীয়তাবাদ বিস্তৃত হচ্ছে, সে কথার প্রমাণ হয় না’। তিনি বলেন, ‘নিউজিল্যান্ডে যা ঘটেছে তা খুবই ভয়াবহ একটি ঘটনা’। তার মন্তব্যে তিনি এই হামলার শিকার যে মুসলমানরা তা উল্লেখ করেননি। এটি একটি ‘জঙ্গি হামলা’ বা ‘সন্ত্রাসী হামলা’ এধরনের কোনো শব্দ উচ্চারণ করেননি। কারণ, হামলাকারী কোনো মুসলমান নয়। যদি তাদেরই প্ররোচনায় বিভ্রান্ত হয়ে কোনো মুসলমান কর্তৃক এরকম হামলার ঘটনা ঘটত, তাহলে মুহূর্তেই বিশ্ব শকুনের দল ও তাদের মিডিয়া এটাকে ‘জঙ্গি’ সন্ত্রাসী হামলা বলে চিৎকার শুরু করে দিতো। মসজিদে হামলাকারী ব্রেনটন ট্যারেন্ট শ্বেতাঙ্গ খ্রিস্টান হওয়ায় তাকে জঙ্গি বলতে তাদের মুখে ঠাডা পড়েছে। তারা বরাবরই এসব হামলার দায় ঢালাওভাবে মুসলমানদের উপর চাপিয়ে দেয়। অথচ, গেøাবাল টেররিজম ডাটাবেইসের হিসাব মতে, ১৯৮০ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে ঘটা মাত্র ৬ শতাংশ সন্ত্রাসী হামলায় মুসলিম সন্ত্রাসীরা জড়িত ছিল। মুসলমানরা বিশ্বের জনসংখ্যার ২৪ শতাংশ হলেও সন্ত্রাসী হামলায় তাদের অনুপাত ১৯৭০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত মাত্র ১০.৩ শতাংশ। এসব তথ্য জানান দিচ্ছে, বিশ্বের বেশির ভাগ সন্ত্রাসী হামলা ঘটেছে অমুসলিম জঙ্গিদের দ্বারা।
ইসলাম শান্তির ধর্ম। ইসলাম অন্যায়ভাবে কাউকে আক্রমণ করার শিক্ষা দেয় না। ইসলাম আক্রমণ প্রতিহত করার শিক্ষা দেয়। ইসলামের নবী সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) পৃথিবীতে ইসলাম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অশান্তির সমাজকে শান্তির সমাজে রূপান্তরিত করেছিলেন। সুতরাং কোনো প্রকৃত মুসলমান বিশ্বের কোথায়ও কোনো সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে জড়িত হতে পারে না। যখনই ইসলাম এবং মুসলমানদের উপর আঘাত এসেছে তখনই মুসলমানরা তা প্রতিহত করেছে। এই নীতি এখনও আছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে। আত্মরক্ষার লড়াই কখনো সন্ত্রাস হতে পারে না। কোনো মুসলমান কর্তৃক অন্যায়ভাকে হামলার যেসব তথ্য পাওয়া যায়, এগুলোর পেছনেও রয়েছে ইসলাম ও মুসলিম বিদ্বেষীদের চক্রান্ত। মুসলিম যুবকদের বিভ্রান্ত করে নানা ধরনের জঙ্গিবাদী সংগঠন গড়ে তুলে আত্মঘাতি হামলা ও জঙ্গিবাদী প্রচারণায় মদদ দেয়ার পেছনেও পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর স¤পৃক্ততার তথ্য পাওয়া যায়।
সাম্প্রতিক সময়ে পৃথিবীর আনাচে-কানাচে দলে দলে মানুষের ইসলাম গ্রহণ এবং মুসলমানদের জাগরণ ইসলাম বিদ্বেষী শক্তিগুলো বরদাশত করতে পারে না। তারা এই বিদ্বেষের কারণে সদা-সর্বদা মুসলমানদের অনিষ্ঠ সাধনে লেগে থাকে। নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের দুটো মসজিদে মুসলিম বিদ্বেষের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী জঙ্গি অস্ট্রেলীয় নাগরিক। সে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রা¤েপর উগ্র সমর্থক ক্যানডিস ওউনসের কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এই হামলা চালিয়েছে। নামাজরত শহীদ মুসল্লিদের রক্তের বন্যায় ভেসে যাক মুসলিম বিদ্বেষীরা। বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের জাগরণ ঘটুক। বিশ্ব মুসলিমদের আর নিরব বসে থাকার সময় নেই। জাগতে হবে এখনই। রুখে দাঁড়াতে হবে ইসলাম ও মুসলমানের শত্রæদের বিরুদ্ধে। ঐক্যবদ্ধভাবে ইসলামের শত্রæদের মোকাবেলা করতে হবে।
লেখক: শিক্ষক, জামেয়া আনওয়ারে মদিনা, পশ্চিম ভাটপাড়া, ইসলামপুর, সিলেট।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন