মুসলিম উম্মাহর কাছে একটি মহিমান্বিত, তাৎপর্যমন্ডিত ও ফজিলতপূর্ণ রাত পবিত্র শবে বরাত। শবে বরাত পালিত হয় শাবান মাসের পঞ্চদশ রজনীতে। রাসুলে পাক (সা:) হাদিসে এ মহিমান্বিত রাতকে ‘লাইলাতুন্ নিসফ্ মিন’ শাবান বা ১৫ শাবানের রাত বলেছেন। ফার্সি শব্দ ‘শব’ অর্থ রাত/রজনী। আর বারাআত অর্থ মুক্তি, নিষ্কৃতি, অব্যাহতি, পবিত্রতা ইত্যাদি। শবে বরাতের শাব্দিক অর্থ হল- মুক্তি, নিষ্কৃতি ও অব্যাহতির রজনী। এ রাতে যেহেতু আল্লাহ তা’আলা পাপী লোকদের ক্ষমা করেন, নিষ্কৃতি দেন ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন, সেহেতু এ রাতকে লাইলাতুল বারাআত বা শবে বরাত বলা হয়। শাবানের আরেকটি অর্থ হলো মধ্যবর্তী সুস্পষ্ট। যেহেতু এ মাসটি রজব ও রমজানের মধ্যবর্তী; তাই এ মাসকে শাবান মাস নামকরণ করা হয়। শাবান মাসটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি মাস। এ মাসের পূর্ণ নাম হলো ‘আশ শাবানুল মুআযযম’ অর্থ মহান শাবান মাস (লিসানুল আরব, ইবনে মানযূর (র:)। সুতরাং মানুষ যদি এ রাতে নিজ কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়ে চক্ষু হতে অশ্রæ প্রবাহিত করে তাহলে আল্লাহ তার পাপরাশি মুক্ত করে দেন। রাব্বে কারিম ইরশাদ করেন- হা-মীম, এ স্পষ্ট কিতাবের শপথ! নিশ্চয়ই আমি তা বরকতময় রাতে অবতীর্ণ করেছি। নিশ্চয়ই আমি সতর্ককারী। এ রাতে বণ্টন করে দেয়া হয় প্রত্যেক হিকমতের কাজ (সূরা দুখান, আয়াত ১-৪)। তাফসীরে জালালাইন শরীফে রয়েছেÑ নিশ্চয়ই আমি তা বরকতময় রাতে অবতীর্ণ করেছি। আর বরকতময় রাত হল লাইলাতুল ক্বদর (ক্বদরের রাত) অথবা লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান (শাবানের মধ্য রাত তথা শবে বরাত)। কেননা এই রাতে উম্মুল কিতাব (কোরআন শরীফ) ৭ম আসমান থেকে দুনিয়ার আসমানে (১ম আসমান) নাযিল হয়েছে। নিশ্চয়ই আমি সতর্ককারী (তাফসীরে জালালাইন ৪১০ পৃষ্ঠা)। তাফসীরে বাগভী শরীফে বর্ণিত আছে- নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ শবে বরাতের রাতে সকল বিষয়ের চূড়ান্ত ফয়সালা করেন এবং শবে ক্বদরের রাতে তা সংশ্লিষ্ট দায়িত্ববান ফেরেশতাদের কাছে ন্যস্ত করেন (তাফসীরে বাগভী, খÐ-৭, পৃষ্ঠা ২২৮)। তাফসীরে তাবারী শরীফে রয়েছে- তাফসীরে বিশিষ্ট তাবেয়ী হযরত ইকরামা (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, মধ্য শাবানের রাত্রিতে বছরের সকল ব্যাপার চূড়ান্ত করা হয়, জীবিত ও মৃতদের তালিকা লেখা হয় এবং হাজীদের তালিকা তৈরি করা হয়। এ তালিকা থেকে একজনও কমবেশি হয় না (তাফসীরে তাবারী শরীফ, খÐ-১০, পৃষ্ঠা ২২)।
হিজরি বর্ষের অষ্টম মাস হলো ‘শাবান’। এ মাসটি বিশেষ মর্যাদা ও ফজিলতপূর্ণ। হিজরতের প্রায় দেড় বছর পর এ মাসেই কিবলা পরিবর্তন হয়; অর্থাৎ পূর্ব কিবলা বাইতুল মুকাদ্দাসের পরিবর্তে কাবা শরিফ কিবলা হিসেবে ঘোষিত ও নির্ধারিত হয় এ মাসে। ‘বারবার আপনার আকাশের দিকে মুখমÐল আবর্তন আমি অবশ্যই লক্ষ করি। সুতরাং এমন কিবলার দিকে আপনাকে প্রত্যাবর্তন করে দেব, যাতে আপনি সন্তুষ্ট হন। অতএব, আপনি মসজিদুল হারাম (কাবা শরিফ) এর দিকে চেহারা ঘুরান। তোমরা যেখানেই থাকো না কেন ওই (কাবার) দিকেই মুখ ফিরাও।’ (সূরা-বাকারা: আয়াত ১৪৪)। প্রিয়নবী রাসুলে পাক (সা:)-এর প্রতি দুরূদ পাঠের নির্দেশনা সংবলিত অসাধারণ আয়াতটি এ মাসেই অবতীর্ণ হয়। ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা রাসুলে পাক (সা:)-এর প্রতি পরিপূর্ণ রহমত বর্ষণ করেন, ফেরেশতারা রাসুলে পাক (সা:)-এর জন্য রহমত কামনা করেন; হে মোমিনরা! তোমরাও তাঁর প্রতি দুরুদ পাঠ করো এবং যথাযথভাবে সালাম পেশ করো।’ (সূরা-আহযাব : আয়াত ৫৬)। রাসূলে পাক (সা:) রজব ও শাবান এই দুই মাসব্যাপী এ দোয়াটি বেশি বেশি পড়তেন : ‘আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফি রজব ওয়া শাবান, ওয়া বাল্লিগ না রমাদান।’ অর্থ : ‘হে আল্লাহ! রজব মাস ও শাবান মাস আমাদের জন্য বরকতময় করুন; রমজান আমাদের নসিব করুন।’ (মুসনাদে ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ., প্রথম খÐ : ২৫৯, বায়হাকি, শুআবুল ঈমান, ৩:৩৭৫)।
শবেবরাতের গুরুত্ব সম্পর্কে হাদিসে ব্যাপক আলোচনা বিদ্যমান রয়েছে। এক হাদিসে রয়েছে- রাসুলে পাক (সা:) ইরশাদ করেছেন, তোমরা রমজান মাসের জন্যে শাবান চাঁদের হিসাব রাখো। রাসুলে পাক (সা:) রমজানের রোজা ব্যতীত শাবান মাসে যতো অধিক রোজা রাখতেন, অন্য মাসে ততো অধিক রোজা রাখতেন না। এ জন্যেই রাসুলে পাক (সা:) শাবান মাসকে নিজের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছেন। হযরত আসমা ইবনে জায়েদ (রা:)-হতে বর্ণিত- রাসুলে পাক (সা:)-ইরশাদ করেন- শাবান আমার মাস, আর রমজান আল্লাহর মাস। হযরত আবূ মূসা আশয়ারী (রা:) রাসূলে পাক (সা:) হতে বর্ণনা করেন। রাসূলে পাক (সা:) ইরশাদ করেন- মধ্য শাবানের রাত্রিতে আল্লাহ পাক রহমতের তাজাল্লী ফরমান এবং তার সমস্ত বান্দাকে ক্ষমা করে দেন। কিন্তু মুশরিক বা শত্রæতাপোষণকারী ব্যক্তিকে ক্ষমা করেন না। (ইবনে মাজাহ)। হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা:) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন- রাসুলে পাক (সা:) হতে বর্ণনা করেন, রাসুলে পাক (সা:) হযরত আয়েশা (রা:) কে জিজ্ঞেস করলেন- হে আয়েশা! শাবান মাসের মধ্য রাতের মর্যাদা ও গুরুত্ব সম্পর্কে তুমি কি জান? তিনি আরজ করলেন ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা:) শাবান মাসের মধ্যবর্তী রাতের কি মর্যাদা রয়েছে? রাসুলে পাক (সা:) উত্তরে বললেন- আগামী এক বছরে কতজন আদম সন্তান ভূমিষ্ট হবে এবং কতজন আদম সন্তান মৃত্যুবরণ করবে তা এ রাত্রে লিপিবদ্ধ করা হয়। আর এ রাত্রিতে তাদের আমল আল্লাহ দরবারে উপস্থাপন করা হয় এবং তাদের রিযিক অবতীর্ণ কিংবা নির্ধারণ করা হয়। অত:পর হযরত আয়েশা (রা:)বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা:) “আল্লাহ রহমত ছাড়া কারো পক্ষে কি জান্নাতে যাওয়া সম্ভব নয়? রাসুলে পাক (সা:) বললেন, মহান আল্লাহ বিশেষ রহমত ও একান্ত অনুগ্রহ ছাড়া কারো পক্ষে জান্নাতে যাওয়া সম্ভব নয়। এ কথাটি রাসুলে পাক (সা:) তিনবার বললেন ( মিশকাত শরীফ, ফাজায়েলুল আওকাত )।
রাসুলে পাক (সা:) ১৫ শাবানের দিনে রোজা রাখা এবং রাতে ইবাদত করার জন্য বিশেষভাবে উৎসাহিত করেছেন। হযরত আলী (রা:) হতে বর্ণিত, রাসুলে পাক (সা:) ইরশাদ করেন : শাবানের ১৫তম রজনীতে তোমরা সে রাতে অধিক হারে আল্লাহ ইবাদত করো। অতঃপর দিনের বেলা রোজা পালন করো। সেদিন আল্লাহ সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে প্রথম আকাশে অবতীর্ণ হন এবং আহŸান করতে থাকেন- আছে কি কেউ ক্ষমা প্রার্থনাকারী, আমি তাকে ক্ষমা করবো; আছে কি কোনো রিজিক অন্বেষণকারী, আমি তাকে রিজিক দান করবো; আছে কি কেউ বিপদগ্রস্ত, আমি তাকে বিপদমুক্ত করবো। এমন আরো বিষয়ে কেউ প্রার্থনাকারী আছ কি? আমি তা সবই তোমাদেরকে দান করব। এভাবে সুবহে সাদিক পর্যন্ত আহŸান করতে থাকেন। (মিশকাত শরীফ)। হযরত আয়েশা (রা:) হতে বর্ণিত: তিনি বলেন- এক রজনীতে আমি রাসুলে পাক (সা:)-কে বিছানায় পেলাম না। এই জন্য তাঁর সন্ধানে বেরিয়ে পড়লাম। তারপর আমি জান্নাতুল বাকীতে গিয়ে নবীজিকে আকাশের দিকে মাথা মুবারক উঠানো অবস্থায় দেখতে পেলাম। তখন তিনি আমাকে বললেন, হে আয়েশা! তুমি কি এ ধারণা করছ যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসুলে পাক (সা:) তোমার উপর অবিচার করেছেন? হযরত আয়েশা (রা:) বললেন; আমি এমন ধারণা করিনি, ভেবেছিলাম আপনি আপনার অন্য কোন বিবির নিকট গমন করেছেন। তখন রাসুলে পাক (সা:) ফরমালেন নিশ্চয় আল্লাহ পাক শাবান মাসের ১৫ তারিখের রাত্রে প্রথম আকাশে তাজাল্লী ফরমান- অত:পর তিনি (আল্লাহ) বনী কালব গোত্রের: মেষের পশম সমূহের চেয়েও বেশী লোকের গুনাহ ক্ষমা করেন।”(তিরমিযী, মুসনাদে আহমদ)।
হাদিসে এসেছে- এ রাতে সূর্যাস্তের সাথে সাথে আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীর আকাশে নেমে আসেন এবং ফজর পর্যন্ত মানুষকে তাঁর কাছে ক্ষমা, রোগ মুক্তি, জাহান্নাম থেকে মুক্তি, রিজিক ইত্যাদি বৈধ প্রয়োজনীয় সবকিছু প্রার্থনা করার জন্য আহŸান করতে থাকেন। রাত জেগে ইবাদত করা। যেমন- নফল নামাজ, বেশি বেশি কাজা নামাজ আদায়, কোরআন তিলাওয়াত করা, জিকির-আজকার, তওবা-ইস্তিগফার ইত্যাদি। রাসুলে পাক (সা:) ইরশাদ করেছেন- ১৫ শাবানের রাত জেগে ইবাদাত কর এবং পরদিন রোজা রাখ। এ রাত্রে আপনজন যারা কবরে তাদের কবর যিয়ারত করা। স্ব স্ব এলাকার আওলিয়ায়ে কেরাম, বুজুর্গানে দ্বীনদের মাজার যিয়ারত করা অতি উত্তম। এতে ফয়েজ ও বরকত হাসেল হয়। তবে হ্যাঁ কবর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে সারা রাত্র ব্যয় করে দেওয়াটা বোকামী। যেহেতু সুন্নত আদায়ের লক্ষ্যে আয়ত্বের ভিতরে নিকটতম মাজার শরীফ ও কবর জিয়ারত করলে আদায় হয়ে যায়। কেনান, রাসুলে পাক (সা:) কে মা আয়েশা (রা:) শা’বানের ১৫ তারিখের রাতে জান্নাতুল বাকীতে মোনাজাতরত অবস্থায় পেয়েছেন। ( তিরমিজি, মুসনাদে আহমদ)। শবে বরাতে বর্জনীয় : বরকতময় এ রজনীতে তওবা-ইস্তেগফার ও ইবাদত-বন্দেগীর মাধ্যমে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে নিমগ্ন থাকাই মুমিনের কর্তব্য। তবে এ রাতে এমন কিছু কাজে লিপ্ত না হওয়া, যেগুলো ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ যেমন, বোমা ফাটানো, তারাবাজি, আতশবাজি, অতিরিক্ত আলোকসজ্জা, পোলাও-বিরানি ও হালুয়া-রুটি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়া ইত্যাদি।
রাসুলে পাক (সা:) স্বীয় জীবন এ রাত বারবার পেয়েছেন, আমল করেছেন। এ রাতে কি করতে হবে, কি ভাবে করতে হবে তা বলেছেন এবং সাহাবায়ে কেরামের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করে আমাদের শিখিয়ে গেছেন। তারপর সাহাবায়ে কিরাম, তাবেয়ীন, তাবে তাবেয়ীন এবং যুগে যুগে ওলামা ও মাশাইখগণ এ রাতে ইবাদাত করে গেছেন। তাদের রেখে যাওয়া আদর্শই হুবহু আমাদের অনুসরণ ও অনুকরণ করতে হবে। নিজের পক্ষ থেকে বাড়ানো-কমানোর কোনই অবকাশ নেই। রাব্বে কারিম আমাদের যথাযথভাবে শবে বরাত পালন করার তৌফিক দান করুক। আমিন।
মুক্তির রাত পবিত্র শবে বরাত
ওলীউর রহমান
শা’বান মাসের ১৫তম রাত্রি হলো লাইলাতুল বারাত বা শবে বরাত। এ রাতে আল্লাহর বান্দাগণ এবাদত বন্দেগির মাধ্যমে আল্লাহর গযব এবং জাহান্নামের আযাব থেকে মুক্তিও নিস্কৃতি লাভ করতে সক্ষম হয়। এ কারণে এ রাত কে শবে বরাত বা লাইলাতুল বারাত বলা হয়। -তাফসীরে কবীর-২৭,২৮
ইমাম বগভী বর্ণনা করেন যে, আল্লাহ তায়ালা সারা বছরের তাকদীর সংক্রান্ত বিষয়াদির ফায়সালা শবেবরাতে সম্পন্ন করেন এবং শবে কদরে এসব ফায়সালা সংশ্লিষ্ট ফেরেশতাগণের কাছে সোপর্দ করেন।- মাযহারী
হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে বললেন, তুমি কি জান এ রাতে অর্থাৎ শা’বানের ১৫তম রাতে কি হয়? আমি আরয করলাম- ইয়া রাসূলাল্লাহ! বলুন কি হয়। তিনি বললেন, এ রাতে এমন প্রত্যেক শিশুর নাম লিখে দেয়া হয়, যে পরবর্তী বছরে জন্ম গ্রহণ করবে। এছাড়া প্রত্যেক এমন ব্যক্তির নাম লিখে দেয়া হয় যে পরবর্তী বছর ইন্তেকাল করবে। এ রাতে নেক আমল সমূহ উপরে তুলে নেয়া হয় এবং এ রাতে মানুষের রিযিক বিতরণ করা হয়।- মেশকাত শরীফ
শবে বরাত হচ্ছে এমন এক রাত যে রাতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন অসংখ্য-অগণিত বান্দাদেরকে ক্ষমা করে দেন। হযরত মু’আজ বিন জাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আল্লাহ পাক শা’বান মাসের ১৫তম রজনীতে স্বীয় সৃষ্টিকুলের দিকে তাকিয়ে মুশরিক এবং বিদ্ধেষভাবাপন্ন লোক ব্যতিত আপন বান্দাগণকে ক্ষমা করে দেন। -শুআবুল ঈমান ৩/৩৮২, তারগীব তারহীব ২/২৪১
বাইহাকী শরীফের বর্ণনায় আছে যে, কিছু সংখ্যক মানুষকে শবে বরাতেও ক্ষমা করা হয় না। যেমন- ১. মানুষের প্রতি অন্যায় বিদ্ধেষ পোষণ কারী, ২.আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী, ৩. লুঙ্গি কিংবা পাজামা টাখনোর নিচে পরিধান কারী, ৪. পিতা-মাতার অবাধ্য ব্যক্তি, ৫. মদ্যপানে অভ্যস্ত ব্যক্তি এবং ৫. অন্যায় খুনী ব্যক্তি।
শবে বরাতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানুষের সমস্যাসমূহকে উল্লেখ করে করে ফজর পর্যন্ত ডাকতে থাকেন। হযরত আলী (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, যখন শা’বানের ১৫তম রাত আসে, তখন তোমরা নামাজে দন্ডায়মান থাকো এবং এর দিনের বেলায় রোযা রাখো। আল্লাহ তায়ালা এ রাতে সূর্যাস্তের সময় থেকেই নিকটতম আকাশের দিকে বিশেষ দৃষ্টি দেন এবং বলেন, কোন ক্ষমা প্রার্থী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করে দেব, কোন রিযিক প্রার্থী আছে কি? আমি তাকে রিযিক দান করব, কোন বিপদগ্রস্ত আছে কি? আমি তাকে বিপদ থেকে মুক্তি দান করব। কেউ অমুক বস্তুর প্রার্থনাকারী আছে কি? কেউ অমুক বস্তুর প্রার্থনাকারী আছে কি? এমনিভাবে আল্লাহ তায়ালা সুবহে সাদিক পর্যন্ত বলতে থাকেন। - ইবনে মাজাহ
শবে বরাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কবর জিয়ারত করেছেন বলে হাদীসে উল্লেখ আছে। তবে সেখানে কোন মেলা বসত না, আলোক সজ্জাও করা হত না এবং অনেক মানুষের সমাগম ও সেখানে হতনা। হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, এ রাতে আমার নিদ্রাভঙ্গ হলে আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বিছানায় পেলাম না, আমি তাঁর তালাশে বের হলাম এবং মদীনার কবরস্থান বাক্বীতে গিয়ে তাঁকে পেয়ে গেলাম। তিনি সেখানে মুসলমান নর-নারীদের জন্য মাগফিরাতের দোয়া করছেন। তিনি আমাকে দেখে বললেন, তুমি কি শংকিত হয়ে পড়েছ যে, আল্লাহও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তোমার প্রতি অবিচার করবেন? আমি আরয করলাম হ্যাঁ, আমার তাই ধারণা হয়েছিল যে, আপনি অন্য কোন বিবির কাছে চলে গেছেন। তিনি বললেন, আল্লাহ তায়ালা শা’বানের ১৫তম রাতে নিকটতম আকাশের দিকে বিশেষ মনোযোগ দেন এবং কলব গোত্রের ছাগলের চুলের চেয়েও অধিক সংখ্যক মানুষকে মাগফেরাত দান করেন। -তিরমিযি শরীফ
শা’বান মাসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অধিক হারে নফল রোযা রাখতেন। শা’বানের ১৫তম রাত নফল এবাদত যেমন- নফল নামায, তাসবীহ পাঠ, দোয়া, কোরআন তেলাওয়াত, দান খয়রাত করা, কবর জিয়ারত ইত্যাদি এবাদতের মাধ্যমে অতিবাহিত করা এবং দিনের বেলা রোযা রাখা সুন্নত। এ রাতে আল্লাহ তায়ালা পরবর্তী বছরে জন্ম গ্রহণকারী এবং মৃত্যুবরণকারীদের সম্পর্কে ফায়সালা করেন এবং এ রাতে মানুষের সৎকর্মসমূহ কবুলিয়াত বা গ্রহণযোগ্যতার স্তরে উন্নীত করা হয় এবং এ রাতে রিযিকবণ্টন করা হয়। অর্থাৎ, সারা বছরে কে কতটুকু রিযিক পাবে তা ফেরেশতাদেরকে জানিয়ে দেয়া হয়। তাই এ রাতে নিতান্ত একাগ্রচিত্তে কাকুতি-মিনতির সাথে নিজের মনের ব্যাথা-বেদনার কথা মহান রবের কাছে পেশ করা, পাপসমূহের জন্য অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চাওয়া, ইহকাল-পরকালের কল্যাণ কামনা করা এবং জীবিত-মৃত সকলের জন্য ক্ষমা চাওয়ার মাধ্যমে অতিবাহিত করা উচিত।
শবে বরাত সম্পর্কে আমাদের মাঝে কিছু বিভ্রান্তি রয়েছে। শবে বরাত উপলক্ষ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের সমাজে কিছু দোয়া-দুরুদ ও কোরআন খানি ইত্যাদির আয়োজন করা হয়। কেউ কেউ এসবের গুরুত্ব দিতে গিয়ে এসবকে অত্যাবশ্যকীয় মনে করেন। আবার কেউ কেউ এসব দোয়া-দুরুদকে বিদআত তথা অগ্রহণযোগ্য এবং নিন্দনীয় মনে করেন। অবশ্য উভয় ধারণাই অগ্রহণযোগ্য। মধ্যপন্থা অবলম্বন করাই শ্রেয়। অর্থাৎ এসব সম্মিলিত দোয়া-দুরুদ ইসলামের আবশ্যকীয় কোন বিধান নয়। আবার এগুলো অনর্থক এবং গর্হিত কোন কাজও না। হয়ত প্রক্রিয়াগত বা পদ্ধতিগত এবং পরিভাষাগত কিছু ভূল-ভ্রান্তি আছে, এসব সংশোধন করে বিতর্ক, বিভ্রান্তি এবং বিদ্ধেষ ছড়ানো থেকে বিরত থাকা উচিৎ। আর ইসলামের কোন বিধান বর্ণনার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরী। ইসলামের কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে যোগ্য আলেম ছাড়া মন্তব্য করা ঠিক না।
শবে বরাত উলক্ষ্যে কিছু অশুভ প্রবণতাও মাঝে মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। যেমন, আতশবাজী, শবে বরাতকে কেন্দ্র করে আলোক সজ্জা করা, মসজিদ অথবা বাসগৃহে অতিরিক্ত আলো-বাতি লাগানো, রাস্তার পাশে বা দেয়ালের উপর অথবা গোরস্থানে বাতি জ্বালিয়ে রাখা, পটকা ফোটানো, ফুলঝুরি জ্বালানো ইত্যাদি। এগুলো হচ্ছে অপসংস্কৃতি বা বিজাতীয় সংস্কৃতি। উপমহাদেশের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা আব্দুল হক্ব মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.) এ সম্পর্কে বলেন যে, এই আলোকসজ্জা এবং আতশবাজী অগ্নি পুজকদের সংস্কৃতি, পরিতাপের বিষয় হলো যে, মুসলমানরা এই সংস্কৃতিকে গ্রহণ করে নিয়েছে যা স¤পূর্ণ হারাম। -মাসাবাতা বিস সুন্নাহ। সুতরাং এসব থেকে আমাদের বিরত থাকা প্রয়োজন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন