বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

অভ্যন্তরীণ

বিলুপ্তির পথে দেশীয় মাছ

কচুরিপানার জটে দূষিত পানি

বি এম হান্নান, চাঁদপুর থেকে | প্রকাশের সময় : ১৯ এপ্রিল, ২০১৯, ১২:০৫ এএম

কচুরিপানার জট পুরো ডাকাতিয়া নদী ঘিরে ফেলায় নষ্ট হয়ে গেছে পানি। কোথাও কোথাও কচুরিপানার জট এতটাই চাপা যে, অনায়াসে এর উপর দিয়ে হেঁটে নদীর এপার থেকে ওপারে যাওয়া যায়। তার উপর জন্মেছে পরগাছা। পানি নষ্ট ও দূষিত হওয়ায় দেশিয় প্রজাতির মাছ মরে যাচ্ছে। অথচ সরকার প্রতি বছর দেশিয় মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে নদীসহ উন্মুক্ত জলাশয়ে লাখ লাখ টাকার মাছের পোনা অবমুক্ত করেন। 

ডাকাতিয়া নদীর উপর ভর করে চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার কয়েক হাজার জেলে পরিবার বেঁচে আছে। কিন্তু কচুরিপানার ভয়াবহ জটে দূষিত পানিতে দেশিয় প্রজাতির মাছ ক্রমাম্বয়ে বিলুপ্ত হওয়ায় জেলেদের বেঁচে থাকার স্বপ্ন ভেস্তে যেতে বসেছে। অথচ ডাকাতিয়া নদীর সুস্বাদু মাছের চাহিদা ছিল দেশের সর্বত্র। ডাকাতিয়ায় এক সময় দেশিয় প্রজাতির বিশেষ করে পাবদা, সরপুটি, বোয়াল, শিং, মাগুর, কই, শইল, ফইলা, চিতল মাছ প্রচুর পরিমানে আহরিত হতো। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে বাজারজাত হতো।
জানা গেছে, পানি উন্নয়ন বোর্ড কচুরিপানা দূরীকরণে নামমাত্র বরাদ্দ দিয়ে থাকে। যা দিয়ে ৬০ কিলোমিটার দীর্ঘ ডাকাতিয়া নদীর একাংশও পরিষ্কার করা সম্ভব হয় না। এছাড়া কর্মসৃজন প্রকল্পের মাধ্যমে কয়েক বছর আগে ডাকাতিয়া নদী সংরক্ষণে চাঁদপুর জেলা প্রশাসন উদ্যোগ নিলেও তা থেমে গেছে।
২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে ফরিদগঞ্জ উপজেলা পরিষদ ডাকাতিয়া নদী রক্ষা ও পর্যটনের স্থান হিসেবে চিহিৃত করতে ওই সময়ের সংসদ সদস্য ডিও লেটারসহ একটি প্রকল্প জমা দেন। পরিকল্পনা কমিশনে তা পড়ে থাকায় এখনো আলোর মুখ দেখেনি। তাই প্রকল্প নিয়ে উপজেলাবাসীর স্বপ্ন স্তিমিত হয়ে গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্প প্রস্তাবনায় ড্রেজিং করে ডাকাতিয়ার নাব্যতা ফিরিয়ে আনা, দু’পাড়ের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে বাঁধাই করা, দুই পাড়ে সড়ক ও সৃজনকৃত বনায়ন করা। ৪৬৯ কোটি টাকার প্রকল্প হলেও প্রকল্প তৈরিকারী প্রকৌশলী জানান, সরকার প্রকল্পটি গ্রহণ করে ধাপে ধাপে এর বাস্তবায়ন করলে ডাকাতিয়া নদী কিছুটা হলেও তার ঐতিহ্য ফিরে পাবে।
কচুরিপানা গো-খাদ্য ও ভালো সার হিসেবে পরিচিত। কিন্তু ডাকাতিয়া নদী দূষণমুক্ত রাখা, দেশিয় প্রজাতির মাছ রক্ষা এবং জেলেদের জীবিকা নির্বাহ অব্যাহত রাখতে কচুরিপানা পরিষ্কার করা ছাড়া বিকল্প কোন পথ নেই বলে মনে করেন মৎস্যজীবীরা।
স্থানীয়রা বলেন, এক সময়ের প্রমত্তা ডাকাতিয়া পণ্য পরিবহনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতো। এটিকে বাঁধ দিয়ে শুধু মৃতপ্রায় করা হয়নি, নদীর তীরভ‚মি অবৈধভাবে ভরাট করে স্কুল, কলেজসহ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, নোংরা আবর্জনা ফেলা, সুয়ারেজসহ হাট-বাজারের ড্রেনের পানির শেষ ঠিকানা হওয়ায় নদীটি এখন মরা খালে পরিণত। ফলে সবুজ কচুরিপানায় বিবর্ণ ডাকাতিয়া নদী এখন আবদ্ধ জলাশয়ে রূপ নিয়েছে।
ডাকাতিয়া একটি প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী নদী। এ নদী ঘিরে রয়েছে অনেক জনশ্রুতি। লোকমুখে শোনা, একসময় ডাকাতিয়া নদী তীব্র খরস্রোতা ছিল। মেঘনার এই শাখা নদী ডাকাতিয়ায় মেঘনার উত্তাল রূপ ফুটে উঠত। ফলে ডাকাতিয়ার করালগ্রাসে নদীর দুই পাড়ের মানুষ সর্বস্ব হারাত। ডাকাতিয়া পাড়ি দিতে গিয়ে বহু মানুষের সলিল সমাধিও ঘটেছে। ডাকাতের মতো সর্বগ্রাসী বলেই এর নাম হয়েছে ডাকাতিয়া।
অন্যদিকে নামকরণের অপর ইতিহাস থেকে জানা যায়, এই নদী দিয়ে মগ-ফিরিঙ্গি নৌ-দস্যুরা নোয়াখালী ও কুমিল্লা জেলায় প্রবেশ করতো। তাদের মাধ্যমেই ডাকাতি হতো। ডাকাতির উপদ্রবের কারণে নদীটির নাম ডাকাতিয়া হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
তৎকালীন কলকাতাস্থ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাউন্সিলের পক্ষে কোর্ট অব ডিরেক্টর সভার কাছে ১৭৫৮ খ্রিস্টাব্দের ১০ জানুয়ারি পেশকৃত একটি চিঠির মাধ্যমে নৌদস্যুদের উপদ্রবের চিত্র পাওয়া যায়। ডাকাতিয়া নদী বাংলাদেশ-ভারতের একটি আন্তঃসীমান্ত নদী। দৈর্ঘ্য ১৪১ কিলোমিটার (৮৮ মাইল), গড় প্রস্থ ৬৭ মিটার। ডাকাতিয়া নদী মেঘনার একটি উপনদী। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়ে কুমিল্লা জেলার বাগসারা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে এবং পরবর্তীতে চাঁদপুর ও ল²ীপুর জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। একই সাথে নদীটি কুমিল্লা-লাকসাম চাঁদপুরের শাহরাস্তি ও হাজীগঞ্জ উপজেলা অতিক্রম করে চাঁদপুর মেঘনা নদীতে মিশেছে। বর্ষাকালে ভারতের দিক থেকে যে পাহাড়ি প্রবাহ গ্রহণ করে তার পরিমাণ খুবই সীমিত। ফলে বছরের ৯ মাসই মেঘনার জোয়ারের পানি গ্রহণ করে থাকে

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন