দুই হাজার উনিশ সালটি নানা কারনে মানুষের মনে থাকবে। বছরের শেষ ভাগে হঠাৎ শুরু হওয়া ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান বা শুদ্ধি অভিযান ছিল তাক লাগানো। এসব অভিযান একদিকে যেমন প্রশংসা পেয়েছে, তেমনি প্রশ্ন উঠেছে, আইন-শৃংখলা বাহিনী তাহলে এত দিন কী করেছে? তারা কি আগে থেকে এসব জানত না? অবৈধ ক্যাসিনো বাণিজ্যের সঙ্গে একশ্রেণির পুলিশ সদস্যের সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগও ওঠে ওই সময়। সন্দেহভাজন কিছু কর্মকর্তাকে এ সময় রাজধানরী থেকে সরিয়েও দেয়া হয়। কিন্তু তদন্ত আর আলোর মুখ দেখেনি। অগ্নিকান্ড ও সড়ক দুঘর্টনার ঘটনায় সমাজে নাড়া দিলেও সাধারণ অপরাধ বলতে গেলে পুলিশের নিয়ন্ত্রণেই ছিল। তবে বুয়েটে আবরার হত্যা, বরগুনায় রিফাত শরীফ হত্যা এবং ফেনীর নুসরাত হত্যা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের চাপের মুখে পড়তে হয় পুলিশকে। এ ছাড়া গুলশানে বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্র আবরার আহমেদ চৌধুরীসহ কয়েকজন সড়ক দুর্ঘটনার হতাহতের পর শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ঠেকাতে বেগ পেতে হয় পুলিশকে।
বিদায়ী বছরে পুরান ঢাকার চকবাজারে কেমিক্যালের আগুন এবং বনানীর এফ আর টাওয়ারের অগ্নিকান্ডের নির্মম দৃশ্য এখনও ভেসে ওঠে মানুষের মনে। বছর শেষে সেই আগুনেই দগ্ধ হন কেরানীগঞ্জের প্লাস্টিক কারখানার ৩১ শ্রমিক। এখন পর্যন্ত ১৪ জন মারা গেলেও বাকি সবাই মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন।
শুদ্ধি অভিযান
গত ১৮ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় হঠাৎ করেই ‘ক্যাসিনো’ বিরোধী অভিযান শুরু হল। এদিন যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে তার গুলশানের বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। অভিযান চালানো হয় চারটি ক্যাসিনো ক্লাবে। এর কয়েক দিন পর শুরু হয় শুদ্ধি অভিযান। এই অভিযানে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী ওরফে স¤্রাটসহ ১১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মাদকের মামলা হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশনও অবৈধ অর্থের অনুসন্ধানে নেমেছে। তারা ২৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে এবং ৩৪ জনের বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দেয়। সর্বশেষ ৩১ অক্টোবরের পরে আর কোনো অভিযান হয়নি। অনেকে বলছেন, শুদ্ধি অভিযান থিতিয়ে পড়েছে।
বুয়েট ছাত্র আবরারসহ কয়েকটি হত্যাকান্ড
গত ৬ অক্টোবর রাতে বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে হত্যা করে তার সহপাঠী ও সিনিয়ররা। ইসলামী ছাত্রশিবিরের কর্মী সন্দেহে তাকে শেরেবাংলা হলের ২০১১ নম্বর রুমে নিয়ে লাঠি ও ক্রিকেটের স্ট্যাম্প দিয়ে পেটানো হয়। ওই ঘটনায় উত্তপ্ত হয়ে ওঠে বুয়েট ক্যাম্পাস। ক্লাসের পাশাপাশি পরীক্ষা বর্জন করে শিক্ষার্থীরা। ভিসির পদত্যাগসহ লাগাতার কর্মসূচির ঘোষণা আসে। দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে এ আন্দোলন। অবশেষে আইন-শৃংখলা বাহিনী একে একে গ্রেফতার করে অভিযুক্তদের। বুয়েট ক্যাম্পাসে নিষিদ্ধ হয় সকল রাজনৈতিক কর্মকান্ড। ১৩ নভেম্বর ২৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দেয় ডিবি।
গত ২৬ জুন সকালের এক বীভৎস ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ছবিতে দেখা গেল, একদল তরুণ তাদের বয়সী আরেকজনকে কুপিয়ে চলেছেন আর তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন এক তরুণী। হতভাগা এই তরুণের নাম রিফাত শরীফ। তিনি মারা যান। অভিযোগ ওঠে, এই তরুণকে যারা খুন করেছেন, তাদের আশ্রদাতা স্থানীয় সাংসদের ছেলে। যদিও রাজনৈতিক চাপে তদন্তের মাঝপথে পুলিশ নিহত রিফাত শরীফের স্ত্রী আয়শা আক্তারকেও গ্রেপ্তার করে। তদন্ত শেষে ২৪ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। রিফাতের স্ত্রীকেও আসামি করা হয়। পরে তিনি হাইকোর্ট থেকে জামিনে ছাড়া পান।
ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার প্রিন্সিপাল সিরাজ উদদৌলার লালসার শিকার হয়ে সোনাগাজী থানার ওসির দ্বারস্থ হয়েছিলেন মাদরাসাছাত্রী নুসরাত জাহান। ওসি মামলা নিলেও আজেবাজে প্রশ্ন করে তার ভিডিও ফেসবুকে ছেড়ে দেন। অন্যদিকে মাদরাসার প্রিন্সিপাল মামলা তুলে নিতে চাপ দেন। রাজি না হওয়ায় ৬ এপ্রিল নুসরাতের হাত-পা বেঁধে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দেয় বোরকা পরা পাঁচ দুর্বৃত্ত। ১০ এপ্রিল বার্ন ইউনিটে মারা যান নুসরাত। ২৪ অক্টোবর এ ঘটনায় ১৬ জনকে মৃত্যুদন্ড দেন আদালত। থানার ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধেও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়। তার আট বছরের সাজা হয়েছে।
পুরান ঢাকায় কেমিক্যালের অভিশাপে অঙ্গার ৭১ জন
গত ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে চকবাজারের চুড়িহাট্টার ৬৪ নম্বর হাজী ওয়াহেদ ম্যানশনে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। ফায়ার সার্ভিসের ৩৭টি ইউনিট রাতভর চেষ্টা করে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। উদ্ধার করা হয় ৬৬ জনের অঙ্গার লাশ। আহত ও দগ্ধদের মধ্যে পরে মারা যান আরও ৫জন।নিমতলীর পর পুরান ঢাকাবাসীর জন্য সবচেয়ে বড় বেদনার ঘটনা এটি। এরপর দেশের সংশ্লিষ্ট সব নিয়ন্ত্রণ সংস্থা এক হয়ে পুরান ঢাকা থেকে নিষিদ্ধ কেমিক্যালের গোডাউন উচ্ছেদে অভিযানে নামে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। নিমতলীর শিক্ষার পর একই আশ্বাস দেয়া হয়েছিল। আশ্বাসও আছে, আছে পুরান ঢাকার কেমিক্যাল গোডাউনও।
সচিবের অপেক্ষায় ফেরি, মাঝপদ্মায় মারা গেল তিতাস
২৫ জুলাই সন্ধ্যা। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন নড়াইল কালিয়া পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র তিতাস ঘোষ (১১)। প্রথমে তাকে খুলনার একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকদের পরামর্শে রাতেই তাকে নিয়ে একটি অ্যাম্বুলেন্স ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়। রাত ৮টার দিকে কাঁঠালবাড়ী-শিমুলিয়া নৌ-রুটের শিবচরের কাঁঠালবাড়ী ১ নম্বর ভিআইপি ফেরিঘাটে পৌঁছায় অ্যাম্বুলেন্সটি। তখন কুমিল্লা নামে ফেরিটি ঘাটে যানবাহন পারাপারের অপেক্ষায় ছিল। তবে সেটি নির্ধারিত সময়ে ছাড়েনি। অ্যাম্বুলেন্সে কাতরাচ্ছিল তিতাস। খোঁজ নিয়ে তার পরিবার জানতে পারেন, সরকারের এটুআই প্রকল্পের যুগ্ম সচিব আবদুল সবুর মন্ডল পিরোজপুর থেকে ঢাকা যাবেন। এ কারণে ওই ফেরিকে অপেক্ষার জন্য জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে ঘাট কর্তৃপক্ষকে বার্তা পাঠানো হয়। দীর্ঘ অপেক্ষায় মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়ে মাঝপদ্মায় অ্যাম্বুলেন্সেই মারা যায় তিতাস।
বিষয়টি জানাজানি হলে দেশব্যাপী শুরু হয় প্রতিবাদ। পরবর্তীতে মাদারীপুরের জেলা প্রশাসন, নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ আলাদা তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটিতে ছিলেন খোদ অভিযুক্ত আবদুল সবুর মন্ডল। দীর্ঘ তদন্তের পর দেরিতে ফেরি ছাড়ায় যুগ্ম সচিবের কোনো দোষ পায়নি কমিটি।
ছেলেধরা গুজবের বলি রেনু নামের এক ‘মা’
‘পদ্মাসেতু নির্মাণে শিশুদের মাথা লাগবে। ইতোমধ্যে শিশু সংগ্রহ করতে সড়কে সড়কে ঘুরছে ছেলেধরা।’ বছরের মাঝামাঝি সময়ে একটি গ্রুপ ফেসবুকে এমন অপপ্রচার চালানোর পরপরই দেশব্যাপী শুরু হয় গণপিটুনি ও হত্যা। গ্রামে-গঞ্জে এমনকি শহর এলাকাতেও অপরিচিত কাউকে দেখলেই পিটুনি দেয়া শুরু হয়। ছেলেধরা গুজবের জনরোষে প্রাণ হারান তাসলিমা বেগন রেনু নামের এক ‘মা’। ২০ জুলাই সকালে বোরকা পরে বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মেয়েকে স্কুলে ভর্তির জন্য গিয়েছিলেন রেনু। দীর্ঘদিন ধরে মানসিক অসুস্থতায়ও ভুগছিলেন তিনি। স্কুলের গেটে তাকে দেখে সন্দেহ হলে কয়েকজন নারী তাসলিমার নাম-পরিচয় জানতে চান। তার উত্তর অদ্ভুত মনে হলে তাকে স্কুলের প্রধান শিক্ষকের কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে ততক্ষণে বাইরে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে যে, প্রধান শিক্ষকের রুমে ‘ছেলেধরা’ আটকে রাখা হয়েছে। ক্ষিপ্ত এলাকাবাসী ও অভিভাবকরা প্রধান শিক্ষকের ঘর থেকে রেনুকে বের করে মাঠে নিয়ে পেটায়। একপর্যায়ে মৃত্যু হয় তার।
বাংলাদেশ পুলিশের হিসাবে, নিরপরাধ আটজন মারা গেছে এমন গুজবের শিকার হয়ে গণপিটুনিতে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ সবজায়গায় ছিল মর্মান্তিক এ মৃত্যুর গল্প। এ ঘটনার পরপরই সোচ্চার হয় পুলিশ। গণপিটুনিতে অংশ নেয়াদের গ্রেফতার ও গুজবসৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে মামলা দেয়ার পর থামে এ হত্যাকান্ড।
বিমান ছিনতাইয়ের চেষ্টা
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিমান ছিনতাইচেষ্টার ঘটনা ঘটে। এদিন ১৪৮ যাত্রী নিয়ে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে দুবাইগামী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটটি মাঝআকাশে ছিনতাইয়ের চেষ্টা করা হয়। প্রায় দুই ঘণ্টা টানটান উত্তেজনার পর চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দরে কমান্ডো অভিযানে নিহত হন ‘পিস্তলধারী’ যুবক পলাশ আহমেদ। এদিকে পলাশের মৃত্যুর পর তার ব্যবহৃত অস্ত্রটি ‘আসল নাকি নকল’ এ নিয়ে ধূ¤্রজাল তৈরি হয়। এ ঘটনার রহস্য উদঘাটনে পলাশের সাবেক স্ত্রী সামসুর নাহার সিমলাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। বিষয়টি জনমনে ভালোই উদ্বেগের জন্ম দিয়েছিল।
বাসচাপায় নিহত আবরার
১৯ মার্চ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালে (বিইউপি) আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী আবরার আহমেদ চৌধুরীকে নর্দ্দায় যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে চাপা দেয় একটি বাস। ঘটনাস্থলে পড়ে থাকে তার নিথর দেহ। ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিক্ষুব্ধ বিইউপি শিক্ষার্থী ও এলাকাবাসী সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। এরপরই বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার গেট-সংলগ্ন সড়কে ফুটওভারব্রিজ তৈরি করে সিটি কর্পোরেশন।
বেলুন কিনতে গিয়ে ছিন্নভিন্ন শিশুর দেহ
৩০ অক্টোবর মিরপুরের রূপনগরে একটি ভ্রাম্যমাণ বেলুনের দোকান থেকে গ্যাসবেলুন কিনতে গিয়ে সিলিন্ডার বিস্ফোরণে প্রাণ হারায় ৫নিষ্পাপ শিশু। আহত হয় আরও ১৫ শিশু।
শুধু ক্রসফায়ার
মাদকের ভয়াবহতা রোধে গত বছরের ৪ মে থেকে দেশব্যাপী অভিযান শুরু হয়। মাদকবিরোধী অভিযানে এ পর্যন্ত বন্দুকযুদ্ধে ৪৭৪ জন মাদক ব্যবসায়ী নিহত হন। কক্সবাজারেই নিহত হন ৩ নারীসহ ১৯২ জন। এ সময় ১০২ জন মাদক ব্যবসায়ী আত্মসমর্পণ করেন। কিন্তু মাদক কেনাবেচা বন্ধ হয়নি।
বিপদের বন্ধু ৯৯৯
জনমনে চমক দেখিয়েছে জাতীয় জরুরি সেবা হেল্প ডেস্ক ৯৯৯। অসহায় ও বিপদগ্রস্ত মানুষের কল পেয়ে তাৎক্ষণিকভাবে সাড়া দিয়েছে এই সেবা। দুর্ঘটনায় সহায়তা, বাল্যবিবাহ রোধ, ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধে যুক্ত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার, গৃহকর্মী নির্যাতন রোধ, পারিবারিক নির্যাতন বন্ধ ইত্যাদিতে ৯৯৯ প্রশংসিত হয়েছে। ঝামেলা এড়িয়ে সহজে পুলিশ, ফায়ার সার্ভিসসহ বিভিন্ন জরুরি সেবা পাচ্ছে সাধারন মানুষ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন