আশি বছরের বৃদ্ধ সাধু জানেন না বাড়ি ভেঙে গেলে তিনি কোথায় আশ্রয় নিবেন। হতাশ ও সর্বশান্ত এই বৃদ্ধ বললেন, ‘বাপ-দাদার সয়-সম্পদ সউগ গেইছে। মনে করছিনু থাকমো এবছর। কই থাকপের পাই। পইসাও নাই কিদি জাগা নিমো। কারো বাড়িত ধাপড়ি তুলি থাকা নাগবে।’
তার অসহায় অবস্থার অভিব্যক্তি থেকে গোটা নদী ভাঙনকৃত পরিবারগুলোর আঁকুতি যেন ঝড়ে পরছিল। বাড়ির পাশে এই বৃদ্ধের তিন বিঘা অবশিষ্ট জমিও গত এক সপ্তাহে গিলে খেয়েছে প্রমত্ত ব্রহ্মপূত্র নদ। কারো আশ্রয়, কারো খিদে মেটাবার পাকা ধানী জমি, প্রিয় গাছপালা এবং বাপদাদার কবরও রেখে যায়নি। কান্না চেপে রাখতে পারছিল না কেউই।
সোমবার সকালে সরজমিন কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার হাতিয়া ইউনিয়নে অবস্থিত ব্রহ্মপূত্র নদের ডানতীরে বসবাসরত ভাঙন কবলিতদের সাথে কথা বলে জানা যায় তাদের দুর্দশার কথা। এই ইউনিয়নের ১২শ মিটার এলাকা বাদ রেখে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে দুদিকে প্রায় ৫ কিলোমিটার ব্যাপী এলাকায় স্থায়ী নদীতীর সংরক্ষণ কাজ অনুমোদন পেয়ে কাজ শুরু করেছে। মাঝখানে ১২শ’ মিটার এলাকা উন্মুক্ত রাখায় ওই এলাকার ৪টি গ্রামের শতশত মানুষকে সর্বশান্ত করে ফেলেছে। গত ৫ বছরে এই গ্রামগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। বারবার নদী ভাঙনের ফলে নি:শ^ হয়েছে পরিবারগুলো। এতে ২ হাজার একর জমিন, দেড় হাজার পরিবার হারিয়ে তাদের সহায় সম্বল।
ওই এলাকার কলাতি পাড়া গ্রামের মৃত: মোহাম্মদ আলীর ব্যবসায়ী পূত্র আব্দুল হাই, নীলকণ্ঠ গ্রামের জহুরুলের পূত্র মহুবর দর্জি ও আব্দুস ছোবহানের পূত্র আব্দুল মোত্তালেব দর্জি জানান, হাতিয়া ইউনিয়নের উত্তরে পালেরঘাট এলাকার প্রফুল্ল পালের বাড়ি থেকে দক্ষিণে কলাতিপাড়া গ্রামের অপিজলের বাড়ি পর্যন্ত দেড় কিলোমিটার ব্যাপী এলাকা জুড়ে ব্রহ্মপূত্র নদের ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। এতে গত ৬মাসে নীলকণ্ঠ গ্রামের ২৫৯টি বাড়িসহ গোটা গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এছাড়াও হাতিয়া বিল গ্রামের ৬০টি বাড়ি, রামখানার ১১টি বাড়ি, কলাতিপাড়ার ৭০টি বাড়িসহ মোট ৩৯০টি পরিবার গৃহহীন হয়েছে।
সরজমিনে ভাঙন কবলিত এলাকায় গিয়ে দেখা যায় বিরুপ আবহাওয়া ও বৃষ্টির মধ্যে বাড়িঘর সড়াচ্ছেন দক্ষিণের কলাতিপাড়া গ্রামের শেষ বাড়ির সদস্য দিনমজুর অপিজল। তিনি জানালেন, একদিকে করোনা অপরদিকে নদী ভাঙন। আমরা শ্যাষ হয়া গেলাম। তিনি ক্ষুব্ধ কণ্ঠে জানালেন বৃষ্টি আর করোনার কারণে প্রতিবেশি কেউ তাকে সহযোগিতা করছে না। ভাঙনের কারণে এরই মধ্যে এখান থেকে অপিজলের ভাস্তে রহিম বাদশাসহ ৭টি পরিবার খোলা আকাশে আশ্রয় নিয়েছে। এছাড়াও পাশর্^বর্তী রিয়াজুল, সিরাজুল, আজিজুল, আহাম্মদ, মতি, আজিজ, বাবলু মন্ডল, বাহানন্দ, জায়দা, মমিনুল প্রস্ততি নিচ্ছে বাড়ি সড়ানোয়। নদী কুড়ি হাত দূর থেকে উন্মত্ত হয়ে ধেয়ে আসছে বসতবাড়ির দিকে।
চলতি নদী ভাঙনে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কলাতি পাড়ার মৃত: ঢোলো মিয়ার ৫ পূত্রের ৪২০ শতক আবাদি জমি ও গাছপালা। আইজলের ২২০শতকজমি, আব্দুল হাই এর ২০০ শতক জমি ও ৫ শতাধিক বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালা, মজিদ মুন্সির ৫৫ শতক আবাদি জমিসহ সামর্থবান প্রায় ৩৫/৪০জনের জমিজমা।
বারবার নদী ভাঙনের শিকার নি:শ^ পরিবারগুলো তাহলে কিভাবে ঠাঁই নেয়, এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানা গেল অলিখিত কিছু নিয়মের কথা। এলাকাবাসীরা জানালেন, বাড়ি ভেঙে গেলে স্থানীয়দের কাছ থেকে প্রতি শতক জমি ৩ হাজার টাকায় চুক্তি করে ৫বছরের জন্য লিজ নেয়া হয়। যাদের টাকা যেমন আছে তারা তেমনভাবে বাড়ির জন্য জমিতে থাকার অধিকার পায়। এই ৫বছরে নদীতে বাড়ি ভেঙে গেলে টাকা ফেরৎ পাবে না। ভাঙনকবলিতা সামর্থ অনুযায়ী ৫ শতক থেকে এক বিঘা পর্যন্ত জমি লিজ নিয়ে থাকে। এই ৫ বছরে কেউ সমর্থ হলে নিজেই জায়গা কিনে জমি ফেরৎ দিয়ে চলে যান।
হাতিয়া বাজারে পত্রিকা বিলি করে জীবিকা নির্বাহ করা মজিবরের পূত্র হকার ছকিয়ল জানান, নুরু পুলিশের জমিতে ১৫হাজার টাকায় ৫শতক জমি নিয়ে বসবাস করছিলাম। মাত্র দেড় বছরেই গত ১৮দিন পূর্বে নদী সব ভেঙে নিয়ে গেছে। এখন জায়গা জমি না পেয়ে নীলকণ্ঠ গ্রামে বোনজামাই মোন্নাফের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি। ভাঙন কবলিতরা সরকারিভাবে কোন সাহায্য পায় না।
বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে হাতিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবুল হোসেন জানান, ব্রহ্মপূত্র ডান তীর রক্ষা প্রকল্প ভেস্তে যেতে পারে মাঝখানে উন্মুক্ত হাতিয়া অঞ্চলে ভাঙন প্রতিরোধে ব্যবস্থা গ্রহন না করা হলে। হাতিয়ায় উন্মুক্ত এলাকায় দ্রুত কাজ বাস্তবায়নের দাবি জানান তিনি।
এ ব্যপারে কড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো: আরিফুল ইসলাম জানান, ব্রহ্মপূত্র নদের ডানতীরে ইতিমধ্যে অনুমোদনকৃত প্রকল্প থেকে ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার ব্যাপী স্থায়ী নদী সংরক্ষণ কাজ শুরু হয়েছে। পাশাপাশি উলিপুরের হাতিয়া ইউনিয়ন এবং ভাটিতে চিলমারীর জোড়গাছ এলাকায় ১৭৫০ মিটার এলাকা গ্যাপ রয়েছে। এটাও আমরা অনুমোদনের প্রক্রিয়া শুরু করেছি। আশাকরি এটা আমরা অনুমোদন পেলে দ্রুত স্থায়ী নদী সংরক্ষণের কাজ শুরু করবো। ইতিমধ্যে যেহেতু ভাঙন শুরু হয়েছে। আমরা উর্ধ্বতন কর্তপক্ষের অনুমোদন নিয়ে ভাঙন কবলিত হাতিয়া এলাকায় ১ হাজার মিটারে জরুরী অস্থায়ী প্রতিরক্ষা কাজ শুরু করেছি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন