শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ধর্ম দর্শন

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সমাজ সংস্কারক মহানবী (সা.)

মোঃ জাহেদ উল্লাহ মোমতাজী | প্রকাশের সময় : ১২ নভেম্বর, ২০২০, ১২:০১ এএম

বিশ্বমানবতার মুক্তির দিশারি বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) [৫৭০-৬৩২ খ্রিঃ] ছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সমাজ সংস্কারক। জাহেলিয়াপনায় কলুষিত, পাপাচারে নিমজ্জিত, ঘোর অন্ধকার সমাজ/ভূ-পৃষ্ঠে ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দের ২৯শে আগস্ট (১২ রবিউল আউয়াল, সোমবার প্রত্যুষে) মা আমিনার গর্ভে যাঁর শুভাগমন ঘটে। মহানবী (সাঃ) আরব সমাজের ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনীতিসহ সর্বক্ষেত্রে এক অভূতপূর্ব সংস্কার সাধন করেন যার মধ্যে সমাজ সংস্কার অন্যতম। তিনি শতধা বিভক্ত, মারামারি-হানাহানিতে লিপ্ত, দস্যুবৃত্তিতে পরিপূর্ণ, অন্ধকারাচ্ছন্ন সেই আরব সমাজকে পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে সভ্য, আদর্শপূর্ণ ও আলোকিত সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং তাঁরই হাতে গড়া আদর্শবান, উন্নত চরিত্রের অধিকারী সাহাবাদের সহযোগিতায় ন্যায়নীতি ও সাম্যের ভিত্তিতে আরবকে সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ জাতিতে পরিণত করেন। তিনি অল্প সময়ের মধ্যে বিশ্বব্যাপী তাঁর সংস্কারসমূহ ছড়িয়ে দিয়ে মহাবিপ্লব সাধন করতে সক্ষম হন। ঐতিহাসিক এডওয়ার্ড গিবন মহানবী (সাঃ) এর সংস্কারসমূহকে ‘এক অতিস্মরণীয় বিপ্লব বলে আখ্যায়িত করেছেন।’

আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে মহানবীর সংস্কার সম্পর্কে বলেছেন, “ আল্লাহর রাসূলের মধ্যে রয়েছে তোমাদের জন্য সর্বোৎকৃষ্ট আদর্শ।” সূরা আল-আহযাব, আয়াত:২১।

প্রাক ইসলামী যুগে আরব গোত্রে গোত্রে যুদ্ধ-বিগ্রহ, কলহ-বিবাদ, হত্যা-রক্তপাত বন্ধ করে সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করে আর্ত-মানবতার সেবা ও সামাজিক অন্যায়-অনাচারের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে বাল্যকালে রাসূল (সাঃ) ‘হিলফুল ফুযুল’ নামক শান্তিসংঘ গঠন করেছিলেন। শান্তিপ্রিয় সমমনা, নিষ্ঠাবান যুবকদের নিয়ে সমাজ সংস্কারে গঠিত এই শান্তিসংঘের অবদান ছিল কল্যাণকর ও সুদূরপ্রসারী এবং পৃথিবীর ইতিহাসে মানবতার কল্যাণে গঠিত এটিই ছিল প্রথম সাংগঠনিক প্রতিষ্ঠান।

মহানবী (সাঃ) আজীবন অসহায়-বঞ্চিত, নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের সামাজিক শান্তি ও মুক্তির জন্য সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। সমাজের মানুষকে অন্ধকার জগৎ থেকে মুক্তি দিয়ে সত্য ও আলোর পথে পরিচালিত করেছেন।

আল-আমিন উপাধিতে ভূষিত তিনিই প্রথম বিশ্বনেতা যিনি সমাজ থেকে অভিশপ্ত দাস প্রথার বিলোপ সাধন করেন এবং সমাজে সাম্য ও সমতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ঘোষণা করেন, “কোন আরব অনারবদের উপর মর্যাদাবান নয়, যেমন নয় কোন অনারব আরবদের উপর।”

তৎকালীন আরবে কন্যা সন্তানের জন্মকে সমাজে অভিশপ্ত ও লজ্জাকর মনে করা হতো তাই কন্যা শিশুকে জীবন্ত মাটির নিচে প্রোথিত করা হতো। মহানবী (সাঃ) এই কুসংস্কার ও জগন্য প্রথা বন্ধ করেন এবং নারী সমাজের প্রতি অবজ্ঞা ও অবহেলা দূর করতে রাসূল (সাঃ) ঘোষণা করেন, “তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি উত্তম, ভাগ্যবান, যার প্রথম সন্তান মেয়ে।” এবং নারী সমাজকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করতে এরশাদ করেন, “মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশ্ত।” (আহমদ, নাসাঈ)

এভাবে শরীয়তের বিভিন্ন বিধি-বিধান/আহকামসমূহ চর্চার মাধ্যমে মহানবী (সাঃ) সর্বপ্রথম নারী সমাজের মর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত করেন এবং পর্দাপ্রথা চালু করে একটি সুন্দর সমাজ ব্যবস্থা বিশ^বাসীকে উপহার দিয়েছেন।

৬২২ খ্রিস্টাব্দের ২৪ শে সেপ্টেম্বর পবিত্র মক্কা থেকে মদিনা শরীফে হিজরতের পর সেখানে বসবাসরত আওস, খাজরাজ, আনসার, মোহাজির ও ইহুদিদের দ্বিধা বিভক্ত গোত্রগুলোর মধ্যে শান্তি শৃঙ্খলা ও সম্প্রীতি স্থাপন করতে পৃথিবীর প্রথম লিখিত সংবিধান “মদিনা সনদ” প্রণয়ন করেন। এবং এই সনদের বাস্তবায়নের মাধ্যমে সব ধর্মাবলম্বী নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধান করেন এবং সন্ত্রাসবাদের চির অবসান ঘটিয়ে শান্তি, সম্প্রীতি স্থাপন করে একটি সৌহার্দ্যপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থা ও ইসলামী রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করেন। বিশ্বময় ইসলামের শান্তিময় সমাজব্যবস্থা ও আদর্শকে ছড়িয়ে দিতে রাসূল (সাঃ) ৬২৮ খ্রিস্টাব্দে মক্কার মুশরিকদের কুরাইশদের সঙ্গে দূরদৃষ্টি সম্পন্ন হুদায়বিয়ার ঐতিহাসিক সন্ধি বা চুক্তিতে আবদ্ধ হন। যা সমাজ বির্ণিমানে মহানবী (সাঃ) এর জীবনে Landmark বা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। পবিত্র কুরআনে একে ‘ফাতহুম মুবিন’ (Evident Victor) বা সুস্পষ্ট বিজয় বলে উল্লেখ করেছেন। এবং শত অত্যাচার-নির্যাতন ও নিপীড়নকারী যাদের কারণে মহানবী (সাঃ) পবিত্র মাতৃভূমি ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন, সেই কুরাইশবাসীকে মক্কা বিজয়ে সার্বজনীন ক্ষমা প্রদর্শন করে শান্তি, সৌহার্দ্যপূর্ণ সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার সফল বাস্তবায়নে সক্ষম হওয়ায় মহানবী (সাঃ) পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সমাজ সংস্কারক ও বিপ্লবী মহাপুরুষ হওয়ার গৌরব অর্জন করেন।


এই প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক উইলিয়াম মুইর যথার্থ বলেছেন, “The Prophet his real greatness- a master mind not only his own age but of all ages.” অর্থাৎ, হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর বিরাট ব্যক্তিত্ব ও অপূর্ব মননশীলতা শুধু তৎকালীন যুগের পরই নয়, সর্বযুগের ও সর্বকালের মহামানবের জন্য শ্রেষ্ঠত্বের পরিচায়ক।”

পরিশেষে বলা যায়, সর্বযুগের শ্রেষ্ঠতম সমাজ সংস্কারক রাসূল আকরাম (সাঃ) সমগ্র মানবজাতির জন্য শান্তি, কল্যাণ, নিরাপত্তা, ন্যায়নীতি ও ইনসাফ ভিত্তিক আদর্শপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠায় যে অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় ফর্মূলা ও সুন্নাহর প্রশিক্ষণ ও বাস্তবায়ন করে গেছেন তা কিয়ামত পর্যন্ত চিরভাস্মর ও বিদ্যমান থাকবে। যাকে আল্লাহ তায়ালা বিশ্ববাসীর জন্য রহমত হিসাবে আখ্যায়িত করে বলেছেন, “আমি আপনাকে সমগ্র বিশ্বজগতের জন্য রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছি।” (সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত:১০৭)

আসুন আমরা বিশ্বনবী (সাঃ) এর দেখানো আদর্শ ও সুন্নাহ মোতাবেক জীবন, সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ার প্রাণপণ চেষ্টা করি।
লেখকঃ প্রভাষক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি, খিলাবাজার স্কুল এন্ড কলেজ, চাঁদপুর।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
মো ফয়সাল মিয়া ৩ নভেম্বর, ২০২১, ১১:৪৮ এএম says : 0
Yes
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন