সে জয় জয়ই নয়, যা বিনা যুদ্ধে অনায়াসে লাভ হয়। সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী কিন্তু সে জয়ের জন্য যুগে যুগে সত্যের অনুসারীদেরকে অসত্যের বিরুদ্ধে কি কঠোর যুদ্ধ করতে হয়েছে। যেমন হযরত ইব্রাহীম (আ.), হযরত মুসা (আ.) প্রমুখ পয়গাম্বরগণকে যে কঠোর সাধনা করতে হয়েছে। বিশ্বনবী মুহাম্মাদ (সা.) এর জীবনী প্রাচীন ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি। যিনি ছিলেন আকৃতিতে পরম সুন্দর, প্রকৃতিতে পরম সুন্দর, যার চরিত্র ছিল অতি মনোহর। যার হৃদয় ছিল প্রেমময়, বাণী ছিল মধুময়, তাঁকে কে-না ভালোবাসে? বাস্তবিকই মহানবী (সা.) ছিলেন প্রাথমিক জীবনে সমস্ত দেশবাসীর পরমপ্রিয়। জন সাধারন্যে এই মুহাম্মাদ (সা.) কে খেতাব দিয়েছিল আলআমিন (অতি বিশ্বাসী) ও আস সাদিক (সত্যবাদী)।
চল্লিশ বৎসর বয়সে ৬১০ খৃস্টাব্দে তার উপর আল্লাহ যখন রিসালাতের দায়িত্ব অর্পন করলেন। তাঁর উপর আল্লাহ যখন কুরআন নাযিল করলেন। তিনি যখন ঈমানের দাওয়াত দিতে আল্লাহর পক্ষ থেকে আদিষ্ট হলেন। তখন তিনি প্রথমে একজন, দুইজন করে গোপনে ঈমানের দাওয়াত দিলেন। আস্তে আস্তে মক্কাবাসীগণের কিছু লোক যখন ঈমান কবুল করলেন। তখন নবী করিম (সা.) প্রকাশ্যে মক্কাবাসী কাফির মুশরিকদের কে সাফা পাহাড়ের পাদদেশে ডেকে হিকমতের সাথে ঈমানের দাওয়াত দিলেন এবং আল্লাহ তায়ালার পরিচয় জানিয়ে দিলেন। তাদেরকে প্রকাশ্যে ঈমানের দাওয়াত দিলেন, তোমরা বল যে, আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত কোন মাবুদ নাই মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহর রাসূল। তাহলে তোমরা সফলকাম হবে। ৩৬০টি দেবদেবী যেগুলো কাবা ঘরে রেখে তোমরা পূজা কর। যেমন লাত, মানাত, উজ্জাও হুবল এগুলোর পূজা ছেড়ে দাও তাহলে দুনিয়াতে শান্তি, আখেরাতের আযাব থেকে মুক্তি পাবে। এ আহ্বান শুনে তারা বুঝতে পারল মক্কার নেতৃত্ব আর আমাদের হাতে থাকবে না। একদিন না একদিন মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহর হাতে চলে পাবে। সাথে সাথে কাফেরদের নেতা আবু লাহাব মহানবী (সা.) কে পাথর মারল। প্রাথমিক দাওয়াতেই নবীকে রক্তাক্ত করে দিল। নবী (সা.) সাময়িক ব্যর্থ মনোরথ হয়ে, আল্লাহর উপর ভরসা করে সেখান থেকে ফিরে আসল। উৎবা বিন রবিয়া কুরাইশ নেতা তাঁকে একদিন নির্জনে পেয়ে বললো, হে ভাতিজা, তুমি মক্কা নগরীতে গণ্ডগোল শুরু করছ কেন?
আমরা মক্কাবাসীগণ বাপদাদার আমল থেকে লাত, মানাত ইত্যাদি দেবদেবীর পূজা করি। আজ তুমি নতুন ধর্মের প্রচারক হয়ে আমাদের বিরোধিতা শুরু করছ। এতে তোমার গোপন যদি কোন মতলব থাকে তাহলে বলতে পার। আমরা তোমার উদ্দেশ্য পূরণ করব। এই ধর্মের দাওয়াত থেকে তুমি যদি বিরত হও তাহলে আমরা তোমাকে বাদশাহ বানাব, যদি বাদশাহী চাও। যদি চাও, তাহলে অঢেল সম্পদের মালিক বানাব। যদি সুন্দরী রমনী চাও, তাহলে অতি সুন্দরী রমনি তোমার বিবাহ বন্ধনে ওয়াকফ করে দিব। তদুত্তরে রাসূলুল্লাহ (সা.) মুচকি হেসে বলে দিলেন। পৃথিবীর সম্পদ তো আমার কাছে তুচ্ছ। যদি আপনারা আমার একহাতে সূর্য ও আরেক হাতে আকাশের চন্দ্র এনে দেন, তাহলেও আমি আল্লাহর দেওয়া রিসালাতের দায়িত্ব পালন করা থেকে একচুল পরিমাণ ও নড়বো না। আমি আমরন ঈমানের দাওয়াত দিতে থাকব। আর আল্লাহর জমিনে আল্লাহর আইন কায়েমের আন্দোলন থেকে সামান্য পরিমাণ সরবোনা। বরং হে চাচা উৎবা বিন রবিয়া আপনারা ঈমানের দাওয়াত কবুল করে নিলে আমাদের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তায়ালা খুশি হবেন। উৎবা তখন বিড় বিড় করে বলতে বলতে চলে গেল ‘এটা একটা বদ্দ পাগল। একে নিশ্চয়ই শক্ত জ্বীনে পেয়েছে। এভাবে একবার দুইবার নয়, মক্কাবাসী কাফেরগণ নবুয়তের তের বছর মক্কী জিন্দেগীতে প্রায় ৫২ বার উপরোল্লিখিত প্রলোভন দেখিয়েছে, প্রিয় নবী (সা.) কে তিনি তাঁর সত্যের দাবীতে অটল ছিলেন। কুরাইশরা যখন দেখল প্রলোভন দিয়ে মহানবী (সা.) কে সত্যের পথ থেকে হটানো সম্ভব নয়। তারা তার চাচা আবু তালিবকে শাসিয়ে বললেন, আপনি যদি আপনার ভাতিজাকে বাপদাদার ধর্মের বিরোধিতা ও নতুন ধর্ম প্রচার থেকে বিরত না করেন তবে অবশ্যই আমাদেরকে বাধ্য হয়ে আপনার ও আপনার ভাতিজাসহ নিকট আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করতে হবে। অগত্যা একদিন আবু তালিব মহানবী (সা.) কে ডেকে বললেন, শোন ভাতিজা, তুমি যদি নতুন ধর্ম প্রচার না ছাড় তবে সমস্ত কুরাইশ গোষ্ঠী আমাদেরকে একঘরে করে রাখবে। তাতে বুঝতে পার আমাদের কী দশা হবে। বাবা, তুমি যে মতে আছ, সেই মতেই থাক। কিন্তু সেটা হাটে বাজারে ঘুরে ঘুরে প্রচার করে লাভ কী? তাতে কেবল গণ্ডগোলই সৃষ্টি হচ্ছে। তুমি যদি না থাম, তবে আমাকে বাধ্য হয়ে তোমাকে ছাড়তে হবে। সেটা খুবই দু:খের বিষয় হবে; কিন্তু উপায় কী? এখন বল তুমি কী করবে? মহানবী (সা.) দৃঢ়কণ্ঠে বললেন, চাচাজান আল্লাহর দ্বীনের প্রচার কার্য থেকে আমি কিছুতেই বিরত হব না। তাতে আমার নছীবে যা আছে তাই হবে। আর আপনি আমাকে ছেড়ে গেলেও আমার আল্লাহ আমাকে ছাড়বে না। অবশ্যই তিনি আমাকে সাহায্য করবেন।
এরপর সমস্ত কুরাইশ গোষ্ঠী মহানবী (সা.) সমেত আবু তালিবের পরিজনদেরকে একঘরে করে দিলো। সে কি সাংঘাতিক ব্যাপার! কেউ তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলবে না, খাওয়া-দাওয়া করবে না, তাদের কোনও জিনিসও তারা কিনবে না। এই বয়কটের ফলে তাদের যে কষ্ট সহ্য করতে হয়েছিল, তা বর্ণনাতীত। ক্ষুধা-তৃষ্ণায় ছেলেমেয়ে গুলো চিৎকার করে কাঁদছে, পাড়া-প্রতিবেশীরা কেউ এক টুকরা রুটি বা এক ফোঁটা পানি দিয়ে সাহায্য করে না। এমনকি খাদ্য পানীয়ের অভাবে তারা কিছু দিন গাছের পাতা খেয়ে জীবন ধারণ করতো। তাদের পায়খানা ছাগলের বড়ির মতো হয়ে গিয়েছে। তবে সকল মানুষ ত আর পাষাণ নয়! কুরাইশদের মধ্য থেকে কয়েকজন গোপনে রাত্রিবেলায় কিছু খাবার-দাবার ও পানি দিয়ে সাহায্য করত। এইভাবে অতিকষ্টে তাঁদের দিন চলছিল। কুরাইশরা তাঁদের বয়কটের একরারনামা কাবা ঘরে টাঙিয়ে দিয়েছিল। একদিন দেখা গেল, সেটা উইপোকার খেয়ে নষ্ট করে ফেলেছে। তখন কুরাইশরা বললো, ‘থাক গিয়ে, একরারনামা উইপোকায় খেয়ে ফেলেছে আর দরকার নেই। এখন নিশ্চয়ই মুহম্মদ শায়েস্তা হয়ে যাবে। তখন মুক্ত হয়ে মহানবী (সা.) মনে করলেন, মক্কার লোক ত আল্লাহর কথা শুনলো না; এখন যাই দেখি, তায়েফের লোক কি করে। তিনি বিশ্বাসী অনুচর যায়েদকে সঙ্গে নিয়ে তায়েফে ইসলাম প্রচার করতে গেলেন। তায়েফবাসীরা মহানবী (সা.) এর কথায় কান দিল না; তার উপর তাঁকে পাথর ছুঁড়ে মেরে গ্রাম থেকে বের করে দিল, সমস্ত শরীর তাঁর রক্তাক্ত। রক্তে পায়ের জুতো পর্যন্ত ডুবে গেছে। তিনি শ্রান্ত কান্ত হয়ে মাটিতে শুয়ে পড়লেন। পরে তিনি অতি কষ্টে উঠে একটি খোরমা গাছের ছায়ায় আশ্রয় নিলেন। আল্লাহর কাছে মুনাজাত করলেন, হে আমার রব, আমি তোমার কাছে আমার ফরিয়াদ জানাই। আমার দুর্বলতার জন্যে আর আমার ইচ্ছার অসারতার জন্যে আমি লোকের চোখে অতি নগন্য। হে পরম দয়াময়, হে দুর্বলের প্রভু, তুমি আমাকে ছেড়ো না, তুমি আমাকে বেগানার হাতে কিংবা আমার শত্রুদের হাতে ছেড়ে দিও না। তুমি যদি নারাজ না হও, তবে আমি নিরাপদ। আমি আশ্রয় লই তোমার জ্যোতিতে, যার দ্বারা সমস্ত আধাঁর ঘুচে যায় এবং ইহ-পরলোকে শান্তি আসে। তোমার ক্রোধ যেন আমার উপর না এসে পড়ে। তোমার যেন মর্জি হয়, আমার মুসকিল আসান কর। কোন শক্তি কোনও সাহায্য তোমার ভিন্ন আর কারো মধ্যে নাই। তারপর তিনি যায়েদকে সঙ্গে নিয়ে মক্কায় ফিরে এলেন।
কারণ কুরাইশরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণের কারণে হযরত ইয়াসির আর তাঁর স্ত্রী সুমাইয়াকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করলো। তারা তাদের ছেলে ‘আম্মারকে জ্বালা-যন্ত্রণা দিতে ত্রুটি করলো না। হযরত বিলালকে খালি গায়ে মক্কার বালিতে সন্ধ্যা পর্যন্ত চিৎ করে শুইয়ে রেখে বুকের উপর ভারী পাথর চাপা দিয়ে কত না যন্ত্রণা দিলো। প্রবল পিপাসায় তারা তাঁকে এক ফোঁটা পানিও খেতে দিলো না, খাবার দেওয়া ত দূরের কথা। তিনি কেবল বলতেন, ‘আহাদুন্! ‘আহাদুন্!! (আল্লাহ্ এক, আল্লাহ্ এক)’। শেষে হযরত আবু বকর বিলালের মনিবকে টাকা দিয়ে তাঁকে মুক্ত করেন। সাহাবীদের এই সমস্ত দুর্দশা দেখে তিনি তাঁদের হিজরত করবার অনুমতি দিলেন। এখন কুরাইশরা মহানবীর জীবননাশের জন্যে ষড়যন্ত্র করলো। আল্লাহ্ হুকুমে তিনি সেই খবর জানতে পেরে এক নিশীথ রাতে যখন কাফিররা তাঁর বাড়ি ঘিরে ছিল তিনি এমন নি:সাড়ে বেরিয়ে এলেন যে, কেউ টের পেলো না। তিনি হযরত আবু বকরকে সঙ্গে নিয়ে মক্কার নিকটবর্তী সওর পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নিলেন। পাছে তাঁর পায়ের চিহ্ন দেখে কাফিররা তাঁকে চিনতে পারে, এই জন্যে আবু বকর তাঁকে কাঁধে বসিয়ে এনেছিলেন। পাহাড়ের গুহায় রাসূলুল্লাহ্ (সা.) হযরত আবু বকরের রানে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়েছিলেন। গুহায় সমস্ত সুরঙ্গ গুলো আবু বকর নিজের কাপড় দিয়ে বুজিয়ে দিয়েছিলেন। কাপড়ের অভাবে একটি গর্ত বুজাতে পারেননি, সেখানে পায়ের তলা দিয়ে আটকে রেখেছিলেন একটি সাপ তার পায়ের তলায় বারবার ছোবল মারছিল; কিন্তু তিনি রাসূলের খাতিরে কিছুতেই পা হটিয়ে নেননি। (চলবে)
লেখক : আরবী প্রভাষক, কড়িহাটি ফাযিল মাদ্রাসা, চাটখিল, নোয়াখালী।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন