ফ জ লে রা ব্বী দ্বী ন
লিমন অবাধ্য ছেলে। কারো কোনো কথাই সে শুনে না। নিজের মতো চলতে ফিরতে খুব পছন্দ করে। যখন যা ইচ্ছা তাই করে। স্কুলে যেতে মন চাইলে স্কুলে যায় আবার যেতে মন না চাইলে দুষ্টু ছেলেদের সাথে মার্বেল খেলায় বসে পড়ে। লিমন সিরাজগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। স্কুল শুরু হয় নয়টার সময় আর ও স্কুলের বারান্দায় পা রাখে ঠিক এগারটায়। এটাই তার নিত্যদিনের রুটিন। কেউ জিজ্ঞাসা করলে তাকে একটা ধমকে দিয়ে বলে, আমার ইচ্ছে করছে তাই এখন স্কুলে যাচ্ছি। প্রয়োজন পড়লে এখনই আবার বাড়ি ফিরে যাব। প্রতিদিনের মতো আজকেও হাঁটতে হাঁটতে স্কুলের গেইটে গিয়ে যখন সে পৌঁছাল তখন কোথা থেকে যেন সর্বনাশা একটা পাখির বিষ্টা উড়ে এসে পড়ল ঠিক তার গায়ের উপর। দুনিয়ার অতসব জায়গা থাকতে শেষমেষ কিনা তার গায়ের উপরেই...!’ ছিঃ ছিঃ, বলতে বলতেই লিমনের মাথাটা গরম হয়ে সোজা ত্রিশ ডিগ্রি থেকে পঞ্চাশ ডিগ্রিতে গিয়ে পৌঁছাল। এবার সে আর কোনোকিছু না ভাবতে পেরে সেই দুষ্ট পাখিটাকেই খুঁজতে শুরু করল। হঠাৎ মাথার উপর কড়ই গাছের পশ্চিম ডালটার দিকে তাকাতেই দেখে দোয়েল পাখি। বিষয়টা সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্ট হয়ে উঠল তার কাছে। হাতের কাছে ইটের মস্ত বড় একটা টুকরো পেয়ে সেটাই ছুড়ে মারল ঐ পাখিটার দিকে। কিন্তু বেশ ভারি ওজনের ইটটাকে ছুড়ে কাক্সিক্ষত জায়গায় লাগাতে পারল না লিমন। উল্টো সেই ইটটার টুকরো ফিরে এসে লাগল এক পথচারীর মাথায়। মুখ লুকিয়ে ফেলল লিমন। ভাবটা এমন যেন ও আসলে কিছুই জানে না। যেন নিষ্পাপ এক শিশু! দিক-বিদিক না দেখে সোজাসুজি এবার স্কুলের ভিতর গিয়ে ঢুকল। প্রথমেই এক স্যারের নজরে পড়ল লিমন। তারপর পূর্বেকার দিনের মতো আবারো স্যার তাকে অফিস রুমে ডাকল। অফিস রুমে সব স্যারেরাই বসে আছেন। তাকে সবার সামনে দাঁড় করিয়ে তার খামখেয়ালী কার্যকলাপের সব কারণ একটা একটা করে মুখ থেকে শুনতে চাইল স্যারেরা। কেন সে স্কুলে প্রতিদিন দেরিতে আসে? কেন অকারণে অন্যের সাথে খারাপ ব্যবহার করে? কেনই বা সে গুরুজনদের কথা শুনে না? ইত্যাদি সবকিছু। লিমনের মাথায় ততক্ষণে রাগের ভুতগুলো ফাল দিয়ে উঠেছে। কোনো উত্তর না দিয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকল অফিসকক্ষে। তাই দেখে বাংলা স্যার ক্ষেপে গিয়ে তার গালে বসিয়ে দিল এক থাপ্পর। লিমন থেমে থাকার ছেলে নয়। নিজেকে তখন আর কন্ট্রোল করতে না পেরে স্যারের দিকেই হাত তাক করে ফেলল। আর পরিমাণে উপহার পেল বরখাস্তের একটা সার্টিফিকেট এবং গলাধাক্কা। লিমন স্কুল থেকে বরখাস্ত হয়ে বাড়ি ফিরতে পারল না। কেননা বাড়িতে গেলেই বাবা আর আস্ত রাখবে না তাকে। এমনিতেই সকালে যে ব্যবহার করে এসেছে বাবার সাথে! এতক্ষণে বোধহয় তার চিন্তাতে নতুন একটা কিছু যোগ হয়েছে। কিন্তু সেই চিন্তাটা কি ভালোর জন্য কিছু? একদমই না। নতুন আরেকটা ভুল কাজের দিকে পা বাড়াল লিমন। তার মন্তব্যে কিছু অনুতপ্তের রেশ আছে। সকালে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময়ই মায়ের সাথে ঝগড়া করে এসেছিল। আর বাবার সাথে তো তেমনটা কথাই বলে না। সেজন্য মাঝেমধ্যে তার বাবা একলা ঘরে বসে বসে নিরালায় কাঁদে। লিমন সব দেখেও না দেখার ভান করে থাকে। আচ্ছা ও এত পাষাণ কেন? গ্রামের মানুষ সবাই বলাবলি করে এ নিয়ে। সারাটা দিন তার আজ খারাপ যাচ্ছে। এদিকে সকালে না খেয়ে আসায় পেটটা ক্ষিধে চোঁ চোঁ করছে। কিছুই মাথায় খেলছে না কী করবে এখন! হঠাৎ মাঠের মধ্যে দিয়ে হাঁটার সময় একটু দূরেই তাকিয়ে দেখে টমেটোর ক্ষেত। ক্ষেতে টকটকে রঙের টমেটোগুলো যেন অপেক্ষায় বসে আছে। টমেটো ক্ষেতের পাশে গাজরের ক্ষেতও রয়েছে। লোভটা আর সহ্য করতে পারল না লিমন। এক দৌড়ে ক্ষেতের ভেতর ঢুকে যা পারল তাই খেতে শুরু করল। হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন দৌড়িয়ে আসছে মনে হলো। খাওয়া একটু থামিয়ে যেই পেছন দিকে তাকিয়েছে অমনি দেখে একটা লোক লাঠি হাতে এদিকেই এগিয়ে আসছে। চুরি করে অন্যের জিনিস খাওয়ার শাস্তি তাকে আজ পেতেই হবে। তবুও বাঁচার জন্য প্রাণপণে দৌড় শুরু করল লিমন। কোন দিকে যাচ্ছে আর কোন মাঠ পেরুচ্ছে কিছুই তার খেয়াল নেই। সে শুধু জানে যা করছে সব জীবন বাঁচানোর জন্যই।
বেলা আড়াইটা। যমুনা নদীর পাড় ঘেঁষে বসে আছে লিমন। চুরি করে টমেটো খাওয়ার জন্য যে ধকল গেছে তা কি সহজেই ভুলা যায়? এখন সে অপেক্ষায় আছে একটা নৌকার। একটা নৌকা পেলেই ওপারের মতি সাহেবের ঘাটে যাওয়া যাবে। তারপর সেখানে বড় বড় খেয়াপারের অভাব নেই। সোজাসুজি বড় কোনো নৌকায় চড়ে ছুটে যাবে শেরপুরের উদ্দেশে। শেরপুরে তার নানার বাড়ি। নানার বাড়িতে গেলে আর কোনো ঝামেলা থাকবে না। নানি তাকে খুব আদর করে। শুধু মাঝেমধ্যে তার দুষ্টুমির জন্য বাদর বলে ডাকে।
লিমন একলা একলা নদীর পাড়ে বসে বসে ঢেউ দেখছে আর অনেক কিছু ভাবছে। কেন যে সে অবাধ্য ছেলে! কারো কোনো কথা শুনে না! আজ যদি মায়ের কথা শুনত তাহলে হয়ত এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হতো না। দুপুর পার হয়ে বিকাল আর বিকাল গিয়ে সন্ধ্যার কাছে পৌঁছাল। হঠাৎ একটা ছোট্ট ডিঙ্গি নাও কোথা থেকে যেন উড়ে আসল তার কাছে। আনন্দে তার দুই চোখ নদীর পানির মতো ঝলমল করছে। সেই নাও দিয়েই সে ওপার ঘাটে গিয়ে পৌঁছাতে পারল। ঘাটে গিয়ে দেখে নানি বাড়ি যাওয়ার মতো কোনো নৌকাই এখন আর নেই। অবশেষে জামালপুরের সরিষাবাড়ির উদ্দেশে একটা নৌকা ছেড়ে যাচ্ছে দেখে জলদি সেখানে উঠে পড়ল লিমন। নৌকায় তেমনটা মানুষের দেখা নেই। কেননা ততক্ষণে সন্ধ্যার প্রায় কাছাকাছি সময়। এদিকে আকাশের অবস্থাও ঠিক নেই। মেঘের পাহাড়ে ডুবে যাচ্ছে আকাশ। এমনিতেই বড় নদী। চারদিকে থৈ থৈ করছে অথৈ পানি। যেন এর কোনো কুলকিনারা নেই। ঢেউয়ের উপর ঢেউ। আর নৌকা যেন এখনই ডুবে যাবে। মনে হচ্ছে এই বুঝি যমুনা তাকে গ্রাস করে ফেলবে জোয়ার দিয়ে পিষে। বুকটা ধকধক ধকধক করতে লাগল। নৌকা ছেড়ে দেয়ার পাঁচ মিনিটও পার হয়নি। মাঝ নদীতে নৌকা এসে থেমে যাওয়ার মতো অবস্থা। মাঝি নিজেও আতঙ্কে যাত্রীদের শুধু হুশিয়ার করে যাচ্ছে। (চলবে)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন