আসর জুড়ে দুর্দান্ত সব প্রত্যাবর্তনের গল্প লিখেই উঠে এসেছিল ফাইনালে মঞ্চে। সেখানেও মোহাম্মদ সালাহর বিধ্বংসী আক্রমণ, সাদিও মানের বুলেট গতির শটে জেরবার অবস্থা। কিন্তু থিবো কোর্তোয়া অবিশ্বাস্য দৃঢ়তায় শুধু পোস্ট আগলে রাখলেন না, যেন ধরে রাখলেন রিয়াল মাদ্রিদের হাল। এর মাঝেই আচমকা এক প্রতি-আক্রমণে ব্যবধান গড়ে দিলেন ভিনিসিউস জুনিয়র। ব্যস, কার্লো আনচেলত্তির দল সাফল্যের রঙ-তুলি দিয়ে আঁকল চেনা ছবি। ইউরোপ সেরার মুকুট আবারও উঠল তাদের মাথায়। গতপরশু রাতে ফ্রান্সের প্যারিসে ১-০ গোলে জিতে রেকর্ড ১৪তম বারের মতো চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতল মাদ্রিদের দলটি।
ইউরোপ সেরার মঞ্চে রিয়ালের এবারের সাফল্যকে অবিশ্বাস্য বললেও বুঝি কম বলা হয়। নকআউট পর্বের প্রতিটি ধাপেই তারা পড়েছিল ছিটকে পড়ার দ্বারপ্রান্তে এবং হার না মানা, হাল না ছাড়া মানসিকতায় প্রতিবারই খাদের কিনারা থেকে দুর্দান্ত সব ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প লেখে দলটি। ফাইনালের মঞ্চে অবশ্য তেমন কোনো গল্প বা মহাকাব্য নয়, বরং প্রতিপক্ষের টানা আক্রমণের মুখে ঘর সামলাতেই ব্যস্ত সময় কাটে তাদের। তবে, এত চাপে একটুর জন্যও দিক হারায়নি দলটি। রক্ষণ জমাট রেখে কাটিয়ে দেয় সময় আর বিশ্বস্ত প্রহরীর মতো পোস্ট আগলে রাখলেন কোর্তোয়া। যদিও স্কোরশিটে লেখা ইতিহাস বলবে, রাতটা ভিনিসিয়ুয়েস। বলারই কথা, সেখানে শুধু গোলের সংখ্যা আর গোলদাতার নামই তো লেখা থাকে। তবে রেকর্ড ১৪তম চ্যাম্পিয়ন্স লিগের পথে স্বপ্নযাত্রার শেষ ধাপে যখন স্তাদ দে ফ্রান্সের ফাইনালে চোখ ফিরবে কোনো রিয়াল সমর্থকের, কল্পনায় বারবার ভেসে উঠবে এক জোড়া গøাভস। শুধু গøাভস কেন, হাত-পা-বুক-মাথা... শরীরের কোন অংশ দিয়ে গোল ঠেকাননি কোর্তোয়া!
মাঠে আক্রমণের হিসেবে লিভারপুলের দাপট কতটা ছিল, তা ম্যাচ পরিসংখ্যানেই স্পষ্ট ফুটে উঠছে। গোলের উদ্দেশ্যে ২৪টি শট নেয় তারা, যার ৯টি ছিল লক্ষ্যে। সেখানে রিয়াল নিতে পারে মোটে চার শট, লক্ষ্যে মাত্র দুটি। অভার তার একটি পায় পরিণতি। দারুণ এক পাল্টা আক্রমণে ৫৯তম মিনিটে তাদের হতভম্ব করে দেয় রিয়াল। ডি-বক্সে ডান দিক থেকে ভালভেরদে অসাধারণ এক কোনাকুনি পাস বাড়ান গোলমুখে। ওখান থেকে বিনা বাধায় বল জালে পাঠাতে ভিনিসিউসের কেবল একটা ছোঁয়ারই দরকার ছিল। আর তাতে মৌসুমে জুড়ে দুর্দান্ত খেলা ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ডের এবারের চ্যাম্পিয়ন্স লিগে গোল হলো চারটি। একবিংশ শতাব্দীতে জন্ম নেওয়া প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে গোল করলেন ২০০০ সালের ১২ জুলাই জন্ম নেওয়া ভিনিসিউস।
পরে আরো বেশ ক’বার জাল কাঁপালেও কর্তোয়া বাধা ডিঙাতে পারেননি সালাহ-মানেরা। পরিণতি, শেষের বাঁশি বাজতেই সেই চেনা দৃশ্য; হতাশায় মুখ ঢেকে নুয়ে পড়লেন লিভারপুলের অনেকে। আর পাশেই উল্লাসে ফেটে পড়ল রিয়ালের কোচ, খেলোয়াড় এবং গ্যালারির দর্শকরা। ২০১৭-১৮ আসরের ফাইনালে এই লিভারপুলকে ৩-১ গোলে হারিয়ে ত্রয়োদশ শিরোপা জিতেছিল রিয়াল। তাদেরকেই কাঁদিয়ে সংখ্যাটা ১৪-তে উন্নীত করল মাদ্রিদের দলটি।
লিভারপুল প্রতিশোধ নিতে পারল না। কিছুদিন আগেও দলটির আকাশে-বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল কোয়াড্রপল জয়ের স্বপ্ন। গত সপ্তাহে প্রিমিয়ার লিগের শেষ রাউন্ডে জিতেও ভেস্তে যায় শিরোপা সম্ভাবনা। তারপরও টিকে ছিল ট্রেবল জয়ের আশা। সেই আশাও নিভে গেল এবার। শেষ পর্যন্ত ওই লিগ কাপ ও এফএ কাপ জয়েই শেষ হলো তাদের দারুণ এক মৌসুম। উল্টো প্রতিশোধ নিল রিয়াল; ১৯৮১ সালে এই প্যারিসেই ইউরোপিয়ান কাপের ফাইনালে ‘অল রেড’ খ্যাত দলটির বিপক্ষে ১-০ গোলে হেরেছিল তারা।
তাতে অবিশ্বাস্য প্রাপ্তির এক চ‚ড়ায় পদচিহ্ন আঁকা হয়ে গেছে কোচ আনচেলত্তিরও। এই প্যারিসেই চার দশকের বেশি সময় আগে রিয়ালকে ঠিক এই স্কোরলাইনে হারিয়েই উৎসবে মেতেছিল লিভারপুল। এবার তারা ফিরল একরাশ বিষন্নতা নিয়ে। আর তাতে প্রথম কোচ হিসাবে চারটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতলেন আনচেলত্তি। এই ফাইনালের আগে আনচেলত্তির সঙ্গে সর্বাধিক তিনটি করে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা জয়ী ছিলেন রিয়ালের সাবেক কোচ জিনেদিন জিদান ও লিভারপুলের সাবেক কোচ বব পেইজলি। ১৯৯৬ সালে না ফেরার দেশে পাড়ি জমানো পেইজলি ওপারে বসেই আনচেলত্তির সাফল্য দেখেছেন কিনা, কে জানে; কিন্তু প্যারিসের গ্যালারিতে বসে জিদান ঠিকই দেখেছেন।
প্রথম কোচ হিসেবে একাধিক ক্লাবের হয়ে দুটি করে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের কীর্তি গড়লেন আনচেলত্তি। ৬২ বছর বয়সী এই কোচের হাত ধরে এসি মিলান দুইবার ইউরোপ সেরার প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল, ২০০২-০৩ ও ২০০৬-০৭ মৌসুমে।
রিয়াল কোচ হিসেবে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের প্রথম শিরোপা স্বাদ আনচেলত্তি পেয়েছিলেন ২০১৩-১৪ মৌসুমে। সেবার লিসবনের ফাইনালে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদকে ৪-১ গোলে হারিয়েছিল তারা। লিভারপুলের বিপক্ষে তাদের সবশেষ হারের স্মৃতিও ওটাই। এরপর থেকে এই নিয়ে আরও ছয়বার মুখোমুখি হয়ে রিয়াল জিতল পাঁচবার, অপরটি ড্র।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন